রাজশাহীতে ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও পাঁচ ফ্লাইওভার: জনমনে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন
রাজশাহী নগরীতে ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি পয়েন্টে আরও পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এরই মধ্যে ফ্লাইওভার নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ ও নগরবাসী আরও পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণকে 'অপ্রয়োজনীয়' ও 'অপরিকল্পিত' উল্লেখ করে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরের শেষে ফ্লাইওভার পাঁচটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে হড়গ্রাম নতুন পাড়া সিটি বাইপাস সড়ক রেলক্রসিংয়ের ওপর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বন্ধগেট রেলক্রসিংয়ের ওপর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা, এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৩৫ শতাংশ; নতুন বিলসিমলা রেলক্রসিংয়ের ওপর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৩২ শতাংশ এবং শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান চত্বর রেলক্রসিংয়ে ওপর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও কাজ সম্পন্ন হয়েছে ১০ শতাংশ ।
ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণ ব্যাখ্যায় সিটি কর্পোরেশন থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে উদ্ভূত যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী ৫০/১০০ বছরের বাস্তবতায় রাজশাহী মহানগরীতে রেলক্রসিং-এ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান মুহূর্তে ফ্লাইওভার তৈরি করা না হলে ভবিষ্যতে তা করা কঠিন হবে, নির্মাণ ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। আপাত দৃষ্টিতে ফ্লাইওভারের ব্যবহার সীমিত মনে হলেও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ফ্লাইওভার নির্মাণ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।
এদিকে ফ্লাইওভার নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে নগরবাসীরা বলছেন, রাজশাহী শহরে কখনো সেভাবে যানজট তৈরি হয়না। আবার শহরে যে-সব গণপরিবহন রয়েছে সেগুলো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলার মতোও না। এক্ষেত্রে রাজশাহীতে ফ্লাইওভার একটি অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প।
ইয়ূথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাসের সভাপতি শামীউল আলীম শাওন বলেন, রাজশাহী একটি ছোট শহর। এই শহরে রিকশা, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ ছোট কিছু যানবাহন চলাচল করে। বাস, ট্রাকের মতো বড় কোনো যানবাহন চলাচল করে না। সেভাবে বড় কোনো গণপরিবহন নেই। এজন্য কোনো যানজটও সৃষ্টি হয় না। তবে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় যানজট তৈরি হয়েছে। কারণ এই ফ্লাইওভার তৈরির কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হলে এবং রাস্তা খুলে দেওয়া হয় তাহলে যানজট থাকবে না। সেক্ষেত্রে রাজশাহী শহরে এই ফ্লাইওভার নির্মাণ অযৌক্তিক। আমার মনে হয়, সরকার পুনর্বিবেচনা করে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিবেন।
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজের (বারসিক) রাজশাহী অঞ্চলের সমন্বয়কারী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্প আসলে কীভাবে হচ্ছে জনগণ তা জানে না। জনগণকে সাথে নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়নি। এজন্য এটা জনগণের প্রকল্প না। এই প্রকল্পের আসলে পরিবেশগত সমীক্ষা কিভাবে করা হয়েছে তাও জনগণ জানে না। আদৌও হয়েছি কিনা বলা সম্ভব হচ্ছে না।
নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা তৌহিদ হোসেন বলেন, দেশের অন্য জায়গায় ফ্লাইওভারের পাশে হাইরাইজ তেমন বিল্ডিং নেই। কিন্তু আমাদের এখানে রাস্তার দুইপাশে সুউচ্চ ভবন রয়েছে। ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে এইসব ভবনের কি অবস্থা দাঁড়াবে তা কিন্তু কেউ জানে না।
আতিকুর রহমান নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, নিউমার্কেট এলাকায় দুই পাশে চওড়া ওয়াকওয়েসহ ৪৭ ফুট রাস্তা রয়েছে। এই রাস্তার ওপর ৩০ ফুটের ব্যাসার্ধের ফ্লাইওভার তৈরি হলে রাস্তায় তো কোনো জায়গাই থাকবে না। এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। যদি কোনো প্রাইভেট কার পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে তো যানজট বেঁধে যাবে। তাহলে ফ্লাইওভার দিয়ে লাভটা কি হবে?
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোসা ইলমী ফরিদাতুল বলেন, ফ্লাইওভার প্রকৃতপক্ষে ট্রান্সপোর্টের একটা মেগাপ্রজেক্ট। যে-সব স্থানে ব্যাপক যানজট তৈরি হয় সেখানে ফ্লাইওভার দেওয়া হয়। অথচ আমরা এমন এমন পয়েন্টে ফ্লাইওভারের স্থান নির্ধারণ করেছি যার আদৌ প্রয়োজন নেই। রাজশাহীতে যেহেতু যানজট নেই এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা কম তাই ফ্লাইওভারের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা অপ্রয়োজনীয় ও অর্থের অপচয়ই শুধু নয়, সামাজিক অনেক সমস্যাও তৈরি করছে।
ড. ইলমী ফরিদাতুল আরও বলেন, একটি শহরে যখন ব্যাপক শিল্পায়ন হয় এবং ভূমির ব্যাপক ব্যবহার হয় তখন সে এলাকায় যানজট তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা ফ্লাইভার নির্মাণের প্রস্তাব দিতে পারি। কিন্তু রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত সেরকম সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, অবকাঠামোগত নির্মাণের আগে শুধু পরিকল্পনা প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলেই হবে না, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কি হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়েও এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।
তবে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশনায় প্রকল্পের কিছু কাটছাঁট করেই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় রাজশাহী কোর্ট স্টেশন রেলক্রসিং ও বর্নালী মোড় রেলক্রসিংয়ের অংশে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাজ বাতিল করা হয়েছে।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নবনিযুক্ত প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আমরা কথা বলেছি, যে প্রকল্পের একটা বড় অংশ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে সেগুলো এই মুহূর্তে বাতিল করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ রাষ্ট্রের অর্থ কিন্তু বিনিয়োগ হয়ে গেছে। হয়ত এই মুহূর্তে কম প্রয়োজনীয় মনে হলেও নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তখন কাজে লাগবে। যেগুলোর প্রয়োজন নেই সেগুলো আমরা বাতিল করে দিয়েছি।
তবে এ বিষয়ে ড. ইলমী ফরিদাতুল বলেন, বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে বলেই সেটা চলমান রাখতে হবে আমি মনে করি না। তবে মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া উচিত। একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর যদি তা জনগণের কোনো কাজে না লাগে তবে তা থেকে সরে আসাই উচিত। সবমিলিয়ে তো ৩০ শতাংশ কাজও হয়নি । এখন বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তারপর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
এর আগে কাজলা রুয়েট গেটের পূর্ব দিক থেকে খড়খড়ি বাইপাস পর্যন্ত ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮১০ মিটার ফ্লাইওভারসহ ৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করে গত বছর থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। কিন্তু উন্মুক্ত করার পর দেখা গেছে সড়কটির কাজলা রুয়েট চত্বর থেকে মেহেরচণ্ডী পর্যন্ত ফ্লাইওভারসহ ২.২৫ কিলোমিটার অংশটুকু ব্যবহার হয় না বললেই চলে। এ নিয়ে এবছরের মার্চে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে 'রাজশাহীর স্বল্প ব্যবহৃত ফ্লাইওভার: স্রেফ অর্থের অপচয়?' শিরোনামে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়।