দ্রব্যমূল্যের চাপ কমাতে ভোজ্যতেল, ডিমের ওপর শুল্ক কমালো সরকার
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে বিপর্যস্ত সাধারণ ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা দীর্ঘদিন ধরে ১০ শতাংশের ওপরে থাকা খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা সাধারণ ভোক্তাদের স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে।
মূল্য নিয়ন্ত্রণের এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ভোজ্য তেল ও ডিমের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো, পোলট্রি খাদ্যের আমদানি ও উৎপাদনের শুল্ক মওকুফ এবং সরাসরি কৃষকদের থেকে সবজি সংগ্রহ করে ফসল ডটকমের মতো বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় ঢাকায় খুচরা বিক্রির ব্যবস্থা করা।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম মজুমদার গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, "ডিমের আমদানি শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ভোজ্য তেলের শুল্ক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, ভোজ্য তেলের উপর ভোক্তা পর্যায়ে সংযোজন কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় গতকাল রাজধানীর ২০টি স্থানে ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) [খোলা বাজারে বিক্রয়] কর্মসূচি শুরু করেছে, যেখানে ডিম, পেঁয়াজ, আলু ও সবজিসহ ১০টি কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
আজ থেকে পোশাকশ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ওএমএস শুরু হবে। টঙ্গীর জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের কারখানায় যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং পোশাক শিল্পের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ গতকাল জানান, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার 'কঠোর অবস্থান' নেবে।
সচিবালয়ে এক বৈঠকে তিনি বলেন, বাজারে সিন্ডিকেটে জড়িত কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্য বৃদ্ধি করলে তাদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় আইনের মুখোমুখি করা হবে।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্য তেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, সরকার যে কোনো মূল্যে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে চায়।
গত এপ্রিলে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সর্বশেষ ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তবে এরপর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ১৫ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
কারখানা মালিকরা আরও দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছেন। দাম বাড়ানো না হলে আমদানি কমে সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে ক্রুড সয়াবিন তেলের ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮৭৩ মার্কিন ডলার, যা অক্টোবরে বেড়ে ১,০০২ ডলারে পৌঁছেছে। পাম তেলের দাম ৯১০ ডলার থেকে বেড়ে ১,০৮০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ বাণিজ্য ও শুল্ক কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এসব পরিবর্তনের ফলে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে ১৭২ টাকা এবং বোতলজাত পাম তেলের দাম ৮ টাকা বেড়ে ১৪৩ টাকা হতে পারে। বর্তমানে এই দাম যথাক্রমে ১৬৭ ও ১৩৫ টাকা।
বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা তেল কারখানার মালিকদের জানান, আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কমে যাবে।
তবে কারখানার মালিকরা এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম বাড়ানোর দাবিতে অটল ছিলেন।
সরকার কঠোরভাবে জানিয়েছে, তেলের দাম বাড়ানো যাবে না এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে মুনাফার হার কমানোর জন্য তেল কারখানার মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মো. সেলিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সরকার জনগণকে স্বস্তি দিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে চায়। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম প্রতি টনে প্রায় ২০০ ডলার বাড়লেও আমরা দাম বাড়াতে রাজী হইনি। বরং, দাম না বাড়ানোর জন্য আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা ব্যবসায়ীদের বাজার স্থিতিশীল রাখতে, দাম না বাড়াতে এবং আপাতত কম লাভ মেনে নিতে অনুরোধ করেছি।"
ডিমের দাম কমাতে উদ্যোগ
বাণিজ্য সচিব আরও জানান, ডিমের আমদানি শুল্ক এবং পোল্ট্রি খাদ্যের খরচ কমানোর মাধ্যমে ডিমের দাম কমানো হবে।
তিনি জানান, ভারতে ডিমের দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে পোল্ট্রি খাদ্যের খরচ বেশি হওয়ায় আমাদের উৎপাদন খরচও বেশি। এছাড়া, ভারতে ডিমের ওজন ৪৫ গ্রাম আর বাংলাদেশে ডিমের ওজন ৬৫ গ্রাম। ফলে আমাদের এখানে দাম তুলনামূলকভাবে বেশি।"
সরকার পোল্ট্রি খাদ্যের খরচ কমাতে উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে ডিম ও মুরগির উৎপাদন ব্যয় কমে।
সচিব বলেন, "যে কোনো প্রয়োজনীয় নীতি পরিবর্তন বা শুল্ক মওকুফের বিষয়টি এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, যাতে যে কোনো মূল্যে খাদ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা যায়।"
ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৪২ টাকা নির্ধারণ
আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) থেকে উৎপাদক পর্যায়ে ১০.৯১ টাকা, পাইকারিতে ১১.০১ টাকা এবং খুচরায় ১১.৮৭ টাকা দরে ডিম বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ডিম উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর সংস্থাটির পরিচালক আলিম আখতার খান সাংবাদিকদের জানান, বুধবার থেকে ভোক্তা পর্যায়ে ডজন প্রতি ডিমের দাম হবে ১৪২.৪৪ টাকা।
তিনি বলেন, "ডিমের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে হবে এবং মধ্যস্থতাকারীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই তা করতে হবে।" তিনি সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য মধ্যস্থতাকারীদের বাজারের কারসাজিকে দায়ী করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে গুদামজাতকরণের খবর এবং সরবরাহ সংকটের কারণে ডিমের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি বাজারে ডজনপ্রতি ডিম ১৮০ থেকে ১৯০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ১৬ সেপ্টেম্বর ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি পিস ১১.৮৭ টাকা নির্ধারণ করে। তবে, ডিম এখনো ১৫ টাকা বা তার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
সরকার সম্প্রতি সরবরাহ সংকট নিরসনে ৪.৫ কোটি ডিমের আমদানি অনুমোদন করেছে। তবে সেগুলো এখনও দেশে আসেনি।
সবজির দাম বাড়ার জন্য দায়ী মধ্যস্বত্বভোগীরা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সবজির দাম বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তবে, মধ্যস্থতাকারীদের সরিয়ে ফেলা কঠিন।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায়, মন্ত্রণালয় খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে সবজি বিক্রয় বাড়িয়ে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছে।
এছাড়াও, বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সবজি সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে, ফসল ডটকম নামক একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন ৮০ টন সবজি কৃষকদের থেকে সংগ্রহ করে ঢাকা শহরের তেজগাঁও থেকে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিতরণ করছে।
মন্ত্রণালয় এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং ঢাকার খুচরা ক্রেতাদের কাছে সবজি পৌঁছাতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেছে, যেখানে গুদামের মতো সুবিধা দেওয়া হবে।
বাণিজ্য সচিব সেলিম উদ্দিন বলেন, "এমন প্রতিষ্ঠানগুলো এই সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দেবে এবং সরকারি সহায়তা পাবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে খুচরা ক্রেতাদের কাছে সরাসরি সবজি বিক্রি করা সম্ভব হবে, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"
সুলভ মূল্যে দেওয়া হবে ১০ কৃষি পণ্য
সরকার গতকাল ভোক্তাদের জন্য ১০টি কৃষিজাত পণ্য সুলভ মূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ চালু করেছে।
ঢাকার খাদ্য ভবনের সামনে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, "এর উদ্দেশ্য হলো, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা।"
প্রাথমিকভাবে, এসব পণ্য রাজধানীর ২০টি স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে খাদ্য ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুর ১০, বাসাবো, বসিলা, রায়ের বাজার, রাজারবাগ, উত্তর ও দক্ষিণ মুগদা, পলাশি মোড়, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বেগুনবাড়ী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা এবং ঝিগাতলা।
এই কর্মসূচির আওতায় পণ্যের দাম: ১ কেজি আলু ৩০ টাকা, ১ ডজন ডিম ১৩০ টাকা, ১ কেজি পেঁয়াজ ৭০ টাকা এবং ১ কেজি সবুজ পেঁপে ২০ টাকা।