আজ থেকে সব বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিন; ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া কী?
দেশের সুপারশপের পর সকল ধরনের কাঁচাবাজারে আজ শুক্রবার (১ নভেম্বর) থেকে নিষিদ্ধ হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। তবে আগামী এক মাস পরিবেশ অধিদপ্তর বিবিন্ন কাঁচাবাজার মনিটরিং করবে, কিন্তু কোনো বিক্রেতাকে জরিমানা কিংবা আইন প্রয়োগ করা হবে না।
এই সময়ে পলিথিন উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে বাজারে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধে পুরোপুরি মাঠে নামবে সরকার।
সরকারের এ উদ্যোগ সাহসী পদক্ষেপ হলেও পলিথিনের বিকল্প বাজারে সহজলভ্য না হওয়ায় তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাটসহ পরিবেশবান্ধব ব্যাগ উৎপাদন ও বিক্রিতে খরচ কমিয়ে আনতে সরকারকে দরকার হলে প্রণোদনা দিতে হবে। একইসাথে জনগণের মধ্যে পলিথিনের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের সচেতনতা বৃদ্ধিরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
১ নভেম্বর থেকে পলিথিন নিষিদ্ধের খবরে কারওয়ান বাজারের পলিথিন ব্যাগ পাইকারি বিক্রেতারা ইতোমধ্যেই তাদের মজুত শেষ করেছেন।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. শান্ত বলেন, "নিষেধাজ্ঞার খবর শোনার পর, আমরা আমাদের মজুত শেষ করেছি। কাওরানবাজারের সকল পাইকারি বিক্রেতারাই একই কাজ করেছেন কোনো ধরনের সরকারি অভিযানে জরিমানা বা সমস্যার মুখোমুখি না হতে। "
অন্যান্য দোকানদারও একই কথা জানিয়েছেন। যদিও কিছু খুচরা দোকানে এখনও পলিথিন মজুত রয়েছে, সেগুলোও আজকে রাতের মধ্যে সরিয়ে ফেলা হবে।
নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে অনেক বিক্রেতা (সবজি বিক্রেতা) স্বাগত জানালেও , অধিকাংশই এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান। বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই মনে করছেন, সরকার হয়ত পুরোপুরি পলিথিন নিষিদ্ধ করতে পারবে না, কারণ তারা আগে এ ধরনের অভিজ্ঞতা দেখেছেন। অনেকেই বাজারে পলিথিনের কম খরচে বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা মনিরুজ্জামান বলেন, "গত মাসে পলিথিন নিষিদ্ধের খবর শুনলাম। এর আগে ২০০৬ সালেও একবার পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু কয়েকদিন পরই আবার বাজারে পলিথিন ফিরে আসে। কিছুদিন পরই মানুষ নিষেধাজ্ঞার কথা ভুলে যায় এবং সেই থেকে এখনও এর ব্যবহার হচ্ছে। তাই এবারও নিষেধাজ্ঞার সফল বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।"
যদি পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে বিকল্প হিসেবে সবাইকে জাল বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে, যা পলিথিনের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতাদের মতে, ১ কেজি পলিথিনের দাম ১৮০ থেকে ২১০ টাকা। অন্যদিকে, ১০০টি জাল ব্যাগের দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা, এবং ১০০টি কাপড়ের ব্যাগের দাম ১৮০ থেকে ৩৪০ টাকার মধ্যে। ব্যাগের আকার অনুযায়ী দাম ভিন্ন হয়।
সরকারের এ উদ্যোগের সমালোচনা করে ক্রেতা মো. আশরাফ বলেন, "কখনও কখনও আমরা বাজারে মাত্র ১০০ গ্রাম আদা বা ধনেপাতা কিনতে আসি। এতো কম পরিমাণ কেনার জন্য ব্যাগ কেনা সম্ভব নয়। সরকারের এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।"
তবে অনেক ব্যবহারকারী ও বিক্রেতা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন। সবজি বিক্রেতা মো. মনসুর আলী খান বলেন, "প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ২০০ টাকা পলিথিনে খরচ করতে হয়। যদি পলিথিন নিষিদ্ধ হয়, তাহলে গ্রাহকরা নিজেদের ব্যাগ নিয়ে আসবেন। ফলে আমাদের পলিথিন ব্যাগের খরচ কমে যাবে, যা পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। তাই আমরা নিষেধাজ্ঞায় খুশি।"
ক্রেতা হাসিবুর রহমান বলেন, "কাল থেকে আমরা ধীরে ধীরে বাজারে ব্যাগ নিয়ে আসার অভ্যাস গড়ে তুলব বা প্রয়োজন হলে ব্যাগ কিনব। এ নিষেধাজ্ঞা পরিবেশে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে"।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধন-২০০২) অনুযায়ী, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবে সরকার পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এই আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সর্বনিম্ন শাস্তি ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং পলিথিন ব্যবহারকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
আজ শুক্রবার থেকে সরকার পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও, পরিবেশ অধিদপ্তর আগামী এক মাস ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের আগে সচেতন করবে এবং কোনো জরিমানা বা শাস্তি প্রয়োগ করবে না। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগানো হবে।
সম্প্রতি একটি সেমিনারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, "আইন অনুযায়ী পলিথিন বর্জনের কার্যক্রম ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। শপিং সেন্টার ও দোকান মালিকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই কার্যক্রম চলছে। আমরা কোনো বিষয় চাপিয়ে দেইনি। আমরা কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, বরং দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনতেই আমাদের এ কার্যক্রম। সাথে সাথে আমরা আমাদের পাট শিল্প ফিরিয়ে আনতে চাই। পাট বিদেশে রপ্তানি করে কিন্তু দেশে অবহেলিত।"
বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার কেমন?
দেশে পলিথিন ব্যবহারের চিত্র আঁতকে ওঠার মতো। আর এ পলিথিন ব্যাগ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করাও সম্ভব নয়। ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পরে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছিল দেশের মানুষ। কিন্তু ২০০৭ এ সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার ও উৎপাদন রোধে সরকার তেমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে গত ১৮ বছরে দেশে এ নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার ও উৎপাদন বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইএসডিও) ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে এবং এর প্রায় সবগুলোই বর্জ্য ও পরিবেশের সাথে মিশে যাচ্ছে।
আর বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার কারখানায় প্লাস্টিক ও পলিথিন তৈরি হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ ব্যাগ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে রাজধানীর পুরান ঢাকায়।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল ড. শাহরিয়ার হোসেন দ্য বিজেনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশ বড় একটি দূষণ থেকে বাঁচবে। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হলেও সাধারণ মানুষ অভ্যাসে নিয়ে আসলে আর সমস্যা থাকবে না। সুপারশপে বন্ধ হওয়ার পরে তো মানুষ সেখান থেকে কেনাকাটা বন্ধ করে দেয়নি। বরং অনেক মানুষ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। এখন সাধারণ বাজারগুলোতে বন্ধ হলে ক্রেতা-বিক্রেতা নিজেরাই বিকল্প খুঁজে নিবে, যেমনটা ২০০২ সালের দিকে নিয়েছিল।"
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সরকার এতোদিন পরে এসে হলেও পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধে যে কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে আমাদের কিছু সমস্যা হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকার দোকান মালিকদের সময় দিচ্ছে, যে সময়ে পলিথিনের বিকল্পে অভ্যস্ত হয়ে যাবো। আমরা দোকান মালিকরাও বিভিন্ন বাজারে ব্যানার, ফেস্টুন লাগিয়ে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি"।