বন্যায় ক্ষতি ও মেরামতের বিলম্বে বেহাল দশায় মহাসড়কগুলো
প্রতি কিলোমিটারে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক – নির্মাণের মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বেহালদশা হয়ে পড়েছে। জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে সড়কের (বিটুমিন) কার্পেটিং। সড়ক জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট বড় গর্ত আর খানাখন্দ। অনেক স্থানে সড়কের পাথর আর খোয়া সরে গিয়ে মাটি বের হয়ে এসেছে।
দেশের বিভিন্ন জাতীয় মহাসড়ক আর বিভিন্ন জেলাকে সংযুক্ত করা আঞ্চলিক সড়কেরও একই অবস্থা; এরমধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অঞ্চলে– বিশেষত কুমিল্লা ও ফেনীতে, এবং তা গত জুলাইয়ের বিধ্বংসী বন্যার পর থেকেই।
তবে যেসব এলাকা বন্যামুক্ত ছিল– সেখানেও সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। রাস্তাগুলোর দূরবস্থা হয়েছে দিনে দিনে।
অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজের জেরে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে সিলেট নগরীতে প্রবেশ করাটাই যেন এক দুর্ভোগ। উন্নয়ন কাজ শেষ হলে দুই লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল মহাসড়কটির; একইভাবে পাঁচ বছর ধরে চলছে ঢাকা-শরীয়তপুর হাইওয়ে চার লেনে সম্প্রসারণের কাজ।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে, সড়কপথে যানবাহন চলাচল ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক সড়কের এতই অবনতি হয়েছে যে দিনে দিনে এটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের সর্বশেষ উন্নয়ন কাজ হয় দুই বছরেরও কম সময় আগে, কিন্তু সেটিও এখন খানা-খন্দে ভরা, কার্পেটিং উঠে মাটি ও পাথর বেড়িয়ে আছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মতে, সড়কের বেহালদশার দিক থেকে সবচেয়ে প্রভাবিত হচ্ছে কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চল; তারপরেই রয়েছে রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ের বন্যা, ভারী বৃষ্টি, বিভিন্ন কারণে মেরামতে বিলম্বসহ নির্মাণকালে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও ঠিকাদারদের জবাবদিহির উদ্যোগ সেভাবে না থাকায় মহাসড়কগুলোর অবনতি হয়েছে।
এলজিইডির ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়কের বড় অংশরেই ভগ্নপ্রায় দশা। চলতি অর্থবছরে, ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১ হাজার ৯৯৮ কিলোমিটার মহাসড়ক মেরামতের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশজুড়ে সড়কের ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনার কাজ চলছে, তবে এগুলো মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'দেশব্যাপী সড়ক নেটওয়ার্কের ছোটবড় ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য অতিরিক্ত ৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ লাগবে।'
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে নিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুমিল্লা (চৌদ্দগ্রাম), ফেনী (মহীপাল ও লালপুল) এবং চট্টগ্রামের কিছু এলাকা সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সেগুলো মেরামতের কাজ চলছে, যানবাহনও চলাচল করছে দেশের অর্থনীতির জন্য অতি-গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে। বন্যায় বিভিন্ন অংশে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পর্যালোচনা করতে দৈনিক মনিটরিং-ও করা হচ্ছে।
বন্যায় কুমিল্লায় দেড় কিলোমিটার সড়ক ডুবে যায়, এতে ৫০০ মিটার সড়কের মাঝের অংশের ক্ষতি হয়েছে, ৩০০ মিটারের পিচ উঠে গেছে, এবং মোট ২৭ হাজার ৯০০ বর্গমিটার জুড়ে ওপরের স্তরের ক্ষতি হয়েছে।
কুমিল্লা জোনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত কাজের জন্য ৫ হাজার ১১২ কোটি টাকা দরকার বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রামে বন্যায় ডুবে গিয়েছিল ২ কিলোমিটার মহাসড়ক, এতে ওপরের স্তর বা সারফেসের ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার ২২৫ বর্গমিটার। ফেনীতে ডুবেছিল ১৭.৭ কিলোমিটার, সেখানে ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ২৮ হাজার ২৯০ বর্গমিটার।
সিলেটের প্রবেশমুখেই দুর্ভোগ
সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে দুই লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। উন্নয়ন কাজের জন্য পুরো সড়কজুড়েই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ সিলেট নগরের প্রবেশমুখে।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চন্ডিপুল থেকে হুমায়ুন রশীদ চত্বর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। চন্ডিপুল থেকেই সিলেট নগরের শুরু। চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, এই তিন কিলোমিটার সড়ক পুরোটাই বড় বড় খানাখন্দে ভরা।
বাইকচালক কায়সার আহমেদ বলেন, ভাঙাচুরা সড়কের কারণে প্রায়ই বাইকের যন্ত্রপাতি ভেঙে যায়। আর সবসময়ই যানজট লেগে থেকে। বৃষ্টি হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হয়। সড়কের সব গর্তে ময়লা পানি জমে থাকে।
সম্প্রতি কিছু সংস্কার কাজ করা হলেও ট্রাকচালক ইউসুফ বলেন, রাস্তাটি ব্যাপকভাবে ভেঙেচুড়ে গেলেও– কোনোরকম মেরামতের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সিলেট জোনে ছোটবড় মেরামত কাজের জন্য ৬৩৬ কোটি টাকার দরকার।
পদ্মা সেতু যানবাহনের চাপ বাড়িয়েছে খুলনার সড়কগুলোয়
২০২০ সালের জুনে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশস্ত করা হয় খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক সড়কের ৩৩ কিলোমিটার। কিন্তু চার বছর না পেরোতেই চুকনগর বাজার এলাকার প্রায় ২ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা – এমনই করুণ দশা।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পঅর থেকেই সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে ঢাকাতে পন্য পরিবহনের পরিমাণ বেড়েছে। তাই অতিরিক্ত ভার বহন না করতে পারাই সড়কের অবস্থা বেহাল হয়েছে।
দিনে কমপক্ষে ১০০টির বেশি ডাম্প ট্রাক এখান দিয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল করে। যার ফলের রাস্তায় পিচ দলা পাকিয়ে যায় বা গর্তের সৃষ্টি করে বলে জানান তাঁরা।
সওজের খুলনা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আনিছুজ্জামান মাসুদ বলেন বলেন, 'যখন খুলনা–সাতক্ষীরা সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তখন এটি ছিল আঞ্চলিক মহাসড়ক। এর সর্বোচ্চ ভার বহনের ক্ষমতা ছিল ২২ মেট্রিক টন। তবে এখন যেসব ভারী ট্রাক চলছে– তাতে ওজন থাকে ৫০ মেট্রিক টনের উপরে। আর যানবাহন চলাচলের পরিমাণও অত্যন্ত বেশি। তাই এই অবস্থা হয়েছে।'
যশোরের এবড়োখেবড়ো সড়ক
যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার উন্নয়নের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হয় ২০২২ সালের জুনে। এতে ব্যয় হয় ৩২১ কোটি টাকা। কিন্তু নির্মাণকাজ চলার সময়েই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও ৮ কিলোমিটার রাস্তা, এজন্য ৪ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে পিচ ঢালাইয়ে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হয়। আরও ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই কিলোমিটার সড়কে পুনরায় ঢালাই করা হবে।
যশোরের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে এই সড়ক মেরামত করতে হয়েছে সাতবার, যেখানে ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার উপরে।
কর্মকর্তারা জানান, আগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও– কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
শরীয়তপুর-ঢাকা সড়ক সম্প্রসারণে বিলম্ব
পাঁচ বছর ধরে চলছে তো চলছেই – শরীয়তপুর-ঢাকা সড়কের ২৭ কিলোমিটার সম্প্রসারণের একটি প্রকল্প, এপর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ৫২ শতাংশ। এই বিলম্বের কারণে এই সড়কে যাতায়াতের সময় যেমন বেশি লাগছে, তেমনি ক্ষয় হচ্ছে যানবাহনের যন্ত্রপাতি।
স্থানীয়রা বলছেন, বৃষ্টি হলেই রাস্তার খানাখন্দগুলো ভরে যায় পানিতে। তখন একসাথে দুইদিক দিয়ে যানবাহন চলাচলই অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার রোদ থাকলে– ধুলাবালিতে ভরে যায় রাস্তা। এছাড়া, কীর্তনখোলা নদীর ওপর দুটি সেতুর নির্মাণকাজও স্থবির অবস্থায় রয়েছে, ফলে বাধ্য হয়ে পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে যানবাহনকে।
সওজের শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে নানান বিরোধ ও জটিলতাটাই এখানে মূল বাধা। 'প্রকল্পটি এখন ২০২৬ সালের জুনে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
চলাচলের অনুপযোগী ফরিদপুরের মহাসড়ক
গত বর্ষার পর থেকেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ফরিদপুর-খুলনা এবং ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কের ৩২ কিলোমিটার রাস্তা। ফরিদপুর-ভাঙ্গা সেকশনের রাজবাড়ী রাস্তার মোড় থেকে ধুলদী পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ।
ফরিদপুরে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ সাইফুল্লাহ সরদার জানান, 'ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কটি কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান থাকায় এই মুহুর্তে বড় ধরনের মেরামতের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সাময়িকভাবে সংস্কার করার কাজ চলমান রয়েছে, যদিও অনবরত বৃষ্টি থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'এই প্রকল্পের টাকা এসে গেছে। এখানে কিছু কাজ ফরিদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত। জেলা প্রশাসক কার্যালয় কাজগুলো শেষ করতে পারলেই আমরা অতি দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে চলে যাব।'
উত্তরের মহাসড়কগুলোর অবস্থা তুলনামূলক ভালো
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুরের মডার্ন মোড় পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এই মহাসড়কে এখন যান চলাচলে কোনো সমস্যা নেই। বরং রাস্তার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। চালকরা বলছেন, এই রাস্তা পুরোপুরি চালু হলে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে যাবে।
এই মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকৌশলী মামুন কায়সার বলেন, এই মহাসড়ক নির্মাণ উত্তরের জনগণের জন্য আর্শীবাদ। কিছু জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জটিলতা না থাকলে এতদিনে কাজ শেষ হতো। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে। তখন আরও সুবিধা পাবে এই জনপদের মানুষ।
রাজশাহীতে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হাকিম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী মহাসড়কে বৃষ্টির পানির কারণে সড়কে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে। যা মেরামতের জন্য আমরা ইতিমধ্যে টেন্ডার দিয়েছি। এই সড়কে ৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামতের জন্য ১৩ কোটি টাকার দরপত্র দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের গোদাগাড়ীর গোপালপুর এলাকায় ১০০ মিটার এলাকার পিচ উঠে গেছে। আবার ওই সড়কের অনেক স্থানে মাঝে মাঝে গর্ত তৈরি হয়েছে। 'এছাড়া বানেশ্বর-চারঘাট থেকে ঈশ্বরদী বাইপাস পর্যন্ত সড়কেও বৃষ্টির পানির জন্য কিছু গর্ত তৈরি হয়েছিল– সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। এই সড়কটি এখন ভালো আছে। আবার যদি বৃষ্টির পানিতে কোনো সমস্যা তৈরি হয়, যদি প্রয়োজন হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরও সংস্কার করে দিবে।'
টিবিএসের ফরিদপুর প্রতিনিধি সঞ্জীব দাস, যশোরের মনোয়ার আহমেদ, খুলনার আওয়াল শেখ, শরীয়তপুরের কাজী মনিরুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের সাবিত আল হাসান, সিলেটের দেবাশীষ দেবু, বগুড়ার খোরশেদ আলম ও রাজশাহীর বুলবুল হাবিব এই প্রতিবেদন প্রস্তুতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।