দর বেশি থাকায় বেশি জমিতে আলুর চাষ, এখন ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় কৃষকরা
গত বছর আলুর দাম ভালো পাওয়ায় সারাদেশে কৃষকরা এ বছর আলুর চাষ বাড়িয়েছেন। ২০২৪ সালের তুলনায় এবারের মৌসুমে প্রায় ৬৪,০০০ হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। তবে এরপরেও প্রত্যাশিত দাম অর্জন হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন কৃষকরা।
দিনাজপুরের সদর উপজেলার বড়বন্দরের কৃষক মো. সোহাগ আহমেদ প্রায় দেড় একর জমিতে ফসল চাষ করেন। এরমধ্যে প্রতিবছর ৭০-৮০ শতাংশে চাষ হয় আলু। বাকি জমিতে ভুট্টা ও অন্য ফসল করেন। তবে গত বছর আলুর দাম বেশি থাকায় এবার পুরো দেড় একর জমিতেই আলু চাষ করেছেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে সোহাগ বলেন, "আমরা অর্ধেক জমিতে আলু চাষ করতাম। কিন্তু এবার পুরোটায় আলু চাষ করেছি। এখন বাজারে যে দাম, তাতে উৎপাদন খরচ তুলতে পারবো কি না শঙ্কায় আছি।"
"গত বছর বাজার ভালো ছিল। এ কারণে আমরা চাষ বাড়িয়েছিলাম। আমাদের এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ এবার আলুর চাষ বাড়িয়েছেন," বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ৪ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে এরই মধ্যে আবাদ হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে, গত অর্থবছরে আলুর আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ, গতবছরের তুলনায় এবার ১৩ শতাংশ হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে।
দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়তি লাভের আশায় কৃষকরা আলু চাষ বেশি করলেও দাম পাওয়া নিয়ে এ বছর শঙ্কা রয়েছে। তাদের মত, সরকার থেকে বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে, যেন কৃষক বা ভোক্তা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
বগুড়ার শাহজাহানপুরের কৃষক জান্নাতুল নাঈম বলেন, "ভালো দাম দেখে আমরা ১৩ বিঘা (৪২৯ শতাংশ) জমিতে সূর্যমুখী ও লাল আলু চাষ করেছি, আগেরবার করেছিলাম ৭-৮ বিঘায়। বর্তমানে পাইকারিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ৭০,০০০-৭৫,০০০ টাকা। প্রতি বিঘায় প্রায় ৬০ মণ আলু হবে আশা করছি। কিন্তু দাম কমে গেলে আমাদের লোকসান হবে।"
মুন্সীগঞ্জ, রংপুর ও পাবনার কৃষকরাও একই ধরনের শঙ্কায় আছেন।
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারি পদক্ষেপের আহ্বান
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, "গতবছর যেহেতু আলুর দাম বেশি ছিল, এবার কৃষকরা বেশি আলু চাষাবাদ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ফলন বেশি হলে কৃষকরা দাম না পাওয়ার একটা শঙ্কা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে এমন পলিসি হাতে নিতে হবে, যেন কৃষকও দাম পায়, আবার বাজারে কৃত্রিম সংকটও তৈরি না হয়।"
তিনি আরও বলেন, "আলু যেহেতু আমাদের অন্যতম প্রধান ফসল, সরকারের উচিৎ আলু প্রকিউর করা। ভারতে ২৩টি পণ্য প্রকিউর করা হয়। সরকার ১০ শতাংশ আলু প্রকিউর করলে কৃষকের দাম নিশ্চিত হবে। আবার বাজারে সংকট তৈরি হলে, তখন সরকার আলু বাজারে ছাড়তে পারবে। এক্ষেত্রে দুইদিকেই একটা সামঞ্জস্য থাকবে।"
আলুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহার বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আলুর বেশি উৎপাদন প্রয়োজন আছে। কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার।"
"শুধু আইন-কানুন করে বা নিয়ম করে যে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না, তা আমরা এবার দেখেছি। এ কারণে কার্যকরী পদক্ষেপ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
আগাম উত্তোলনে দাম কমার শঙ্কা
সাধারণত, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে পুরো মার্চজুড়ে মূল মৌসুমের আলু উত্তোলন করেন কৃষকরা। তবে গত বছর আলুর ভরা মৌসুমেই দাম ছিল বেশি। এরপর মে মাসে তা ৫০ টাকা অতিক্রম করে। নভেম্বরে দাঁড়ায় প্রতিকেজি ৮০ টাকা— যা ছিল ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ইতোমধ্যে চলতি মৌসুমের আগাম আলু উত্তোলন করছেন কৃষকরা। এর প্রভাবে দামও কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে রাজধানীতে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, কোল্ড স্টোরেজগুলোর ধারণক্ষমতা ৪৫ লাখ টন। এর সাথে আরও ৩৫-৪৫ লাখ টন মে-জুন পর্যন্ত কৃষকরা সংরক্ষণ করতে পারেন।
"তবে ৯০ লাখ টনের বেশি উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সরকারের উচিৎ এখনই রপ্তানির পরিকল্পনা নেওয়া, যেন কৃষকরা ভালো দাম পান। সরকারের মধ্য থেকে জরিপ করতে হবে আলুর ঠিক উৎপাদন কত হতে পারে? এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে," বলেন তিনি।
আলু প্রকিউরের বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান টিবিএসকে বলেন, "গতবছর আলু ও পেঁয়াজের দাম বেশি ছিল, এ কারণে এবার কৃষকরা আগ্রহী হয়েছেন। এখনও আলু উঠেনি। কী পরিমাণ উৎপাদন হবে, তা আরও পরে জানা যাবে। কারণ নানা কারণে আলুর ফলন ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারে।"
"সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেই। উৎপাদন বেশি হলেও আমাদের চাহিদা রয়েছে। তখন পরিস্থিতি হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে," যোগ করেন তিনি।