‘জমি না থাকায় কাউকে সরকারি চাকরি বঞ্চিত করা অসাংবিধানিক’
নিজেদের জমি না থাকায় বরিশালের আসপিয়া ইসলাম ও খুলনার মিম আক্তারকে পুলিশের ট্রেইনি কনস্টেবল পদে নিয়োগ না দিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংবিধান ও আইনের সাথে সাংঘর্ষিক।
পৈত্রিক জেলা ভোলা হলেও ১৫ বছরের বেশী সময় ধরে বরিশাল জেলায় আসপিয়ার বসবাস। আর মিমের পৈত্রিক জেলা বাগেরহাট হলেও প্রায় ৩২ বছর ধরে খুলনা জেলায় তাদের বসবাস। এরপরেও পুলিশ ভেরিফিকেশনে বলা হয়, স্থায়ী ঠিকানার গড়মিল হওয়ায় এই দুইজনকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা পরিবারের ভূ-সম্পত্তি থাকার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি বাধ্যবাধকতা নেই স্থায়ী ঠিকানারও। কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হলেই যে কেউ প্রজাতন্ত্রে নিয়োগ লাভের অধিকারী হবেন।
এছাড়াও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, দেশের কোনো নাগরিক কোনো জেলায় তিনবছর বসবাস করলেই তিনি সেই জেলার স্থায়ী নাগরিক বলে গণ্য হবেন।
ভূ-সম্পত্তি থাকার বাধ্যবাধকতা নেই
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্থায়ী ঠিকানা ছাড়া চাকরি হবে না, কোনো চাকরির ক্ষেত্রেই এ ধরণের কোন আইন বাংলাদেশে নেই। বরং সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন নাগরিকের সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
তিনি বলেন, এটি পুলিশের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালের একটি প্র্যাকটিস যা শুরু হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকে।
"কোন আইন নেই বরং এটা তাদের ধরে নেয়া একটি নীতি যা আইন অনুযায়ী একটি চরম বৈষম্য মাত্র। কারও ভূমি না থাকলে ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী সে সরকারের কাছ থেকে জমি পেতে পারে"।
কিন্তু ভূমিহীন বলে কোন নাগরিককে চাকরি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ আইনে নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের বহু জেলায় নদীভাঙ্গনে বহু পরিবার ঘরবাড়ি হয়েছে। এসব পরিবারের অনেকে ছেলে-মেয়ে পরবর্তীকালে শিক্ষিত হয়ে চাকরিও করছে। কিন্তু ভূমিহীন বলে চাকরি না হওয়ার ঘটনা তেমন একটা শোনা যায়নি।
স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার শর্ত কনস্টেবল নিয়োগে
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক টিবিএসকে বলেন, অন্যান্য সরকারি চাকরিতে যেভাবে 'সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বিধিমালা' অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই বিধিমালা অনুসরণ করা হয়। তবে পুলিশের নিয়োগ কার্যক্রম শৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য জেলায় জেলায় পৃথকভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ শাখার কনস্টেবল নিয়োগ নির্দেশনা অনুযায়ী, সকল কনস্টেবলকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয় এবং কনস্টেবলের এ সরাসরি নিয়োগ পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার কর্তৃক পরিচালিত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের শর্তগুলোর মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে প্রার্থীকে।
কিভাবে শনাক্ত হবে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, বরিশালের আসপিয়া ও খুলনার খুলনার মিম আক্তারের বিষয়ে পুলিশ ভেরিফেকশন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে অজুহাত দিয়ে বলেছেন, 'নিজেস্ব ভূ-সম্পত্তি না থাকায় তাদেরকে ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না', তা সম্পূর্ণ আইনের পরিপন্থী।
এই আইনজ্ঞ বলেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৮ এর ২১ বিধিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞায় স্পষ্ট বলা আছে, ''(স্থায়ীভাবে বসবাসের স্থান) অর্থ কোন ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা বা কোন ব্যক্তি যে কোনো স্থানে ন্যূনতম ৩ (তিন) বৎসর যাবৎ বসবাস করিতেছেন অথবা নদীভাঙ্গনে বা অন্য কোন কারণে স্থায়ী ঠিকানা বিলুপ্ত হওয়ায় নূতন কোন স্থানে যে কোন সময়ের জন্য বসবাস করিতেছেন বা নূতন কোন স্থানে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করিয়া যে কোন সময়ের জন্য উক্ত স্থানে বসবাস করিতেছেন।''
জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যেকোনো স্থানে ন্যূনতম ৩ (তিন) বছর বসবাস করলেই সে ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবে।
এ হিসেবে আসপিয়া ও মিম যদি চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন, তারা হাইকোর্টে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী।
বরিশালের আসপিয়া টিবিএসকে বলেন, তার বিষয়ে ভেরিফিকেশন করার পর হিজলা থানার ওসি জানিয়েছিলেন, চাকরি পেতে হলে নিজেদের জমিসহ ঘর দেখাতে হবে। বরিশালের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান তাকে বলেছিলেন, 'আইনে বাধা থাকায় কিছু করার নেই'।
তবে বরিশালের পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন রোববার টিবিএসকে বলেন, আসপিয়াদের নিয়োগ সংক্রান্ত চূড়ান্ত ফলাফল এখনো প্রকাশ হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনে যেগুলো বিধান রয়েছে, তার সবগুলো মেনে আসপিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আইনি ব্যত্যয় ঘটবে না।
আসপিয়া আরও বলেন, মেডিকেল, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ সবকটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে চাকরির যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি। কিন্তু চূড়ান্ত নিয়োগের আগে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আসপিয়া ও তার পরিবারকে ভূমিহীন উল্লেখ করা হয়। ভূমিহীন হওয়ায় আসপিয়ার চাকরি হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
পৈত্রিক নিবাস ভোলা জেলায় হলেও বরিশালের হিজলা উপজেলায় আসপিয়ার পরিবার গত প্রায় দেড় দশক বাস করলেও তাদের স্থায়ী কোন ঠিকানা নেই।
আসপিয়ার চাকরি হচ্ছে না, বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তার পরিবারের জন্য জমি ও তাকে চাকরি দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আলোচিত এই ইস্যুর সূত্র ধরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেতে ভূ-সম্পত্তি বা স্থায়ী ঠিকানা থাকা না থাকার প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে।
স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় খুলনায় মিম আক্তারের পুলিশে চাকরি না হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাহবুব হাসান। তিনি বলেছেন, স্থায়ী ঠিকানা নয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট হওয়ায় তাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে মিম টিবিএসকে বলেন, পুলিশের কনস্টেবল পদে সাধারণ নারী কোটায় আবেদন করেন তিনি। গত ২৫ অক্টোবর থেকে তিন দিন খুলনা জেলা পুলিশ লাইনসে শারীরিক যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২৮ ডিসেম্বর খুলনা সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হওয়া লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন।
মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন। ফল প্রকাশের পর জানতে পারেন, তিনি মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন। এরপর খুলনা জেলা পুলিশ লাইনসে সাধারণ মেডিক্যাল পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। গত ১২ নভেম্বর রাতে তাকে নেওয়া হয় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে। সেখানে ১৩ নভেম্বর সকালে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়। তারপর খুলনায় ফিরে আসেন। এরপর পুলিশ ভেরিফিকেশন শুরু হয়। সোনাডাঙ্গা থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও সিটিএসবি থেকে তাদের বাসায় তদন্তে আসে।
তিনি বলেন, "তাদের কাছে ভূমিহীন সনদ জমা দিয়েছি। ৭ ডিসেম্বর জেলা পুলিশ লাইনসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়। এরপর আর কিছুই জানায়নি। ১০ ডিসেম্বর জেলা পুলিশ লাইনসে খোঁজ নিয়ে কিছু জানতে পারিনি। ১১ ডিসেম্বর খুলনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে যাই। ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভির আহম্মেদ জানান, আমার সব ঠিক আছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় চাকরিটা দিতে পারছেন না। এরপর কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসি।"
মিমের বাবা রবিউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "১৯৮৮ সাল থেকে খুলনার সোনাডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছি। মিমের জন্ম খুলনায়। এখানে আমাদের কোনও জমি নেই। পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারি থানার বড়বাড়িয়া গ্রামে। আমার বাবা আব্দুল লতিফ শেখ জীবিত আছেন। ভিটাবাড়ির জমি তার নামে। আমার নামে কোনও জমি নেই। এ কারণে আমার মেয়েটার চাকরি হচ্ছে না।"
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ জানান, বিভিন্ন জেলায় ট্রেইনি কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে অনেক সময় দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এজন্য এই চাকরির নিয়োগের জন্য কঠোরভাবে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়ে থাকে। তবে যদি কোনো প্রার্থী আইন অনুযায়ী, ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তার চাকরি পেতে যাতে কোনো জটিলতা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে সঠিকভাবে নজর রাখতে হবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে।