১০০ বছরের পুরনো আইনে চলছে কারখানার বয়লার পরিদর্শন
প্রায় শতবর্ষের পুরনো আইন দিয়ে চলছে শিল্পকারখানার বয়লার পরিদর্শনের কাজ। সে আইনে অবৈধভাবে বয়লার ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে বয়লারের মালিককে অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা যায়। ফলে ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণের মতো প্রাণঘাতি দুর্ঘটনায় শুধুমাত্র আইনি সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে বড় ধরনের কোন জরিমানা করা যায় না কারখানা কর্তৃপক্ষকে। অন্যদিকে বয়লার পরিদর্শক বা ইন্সপেক্টর এবং কারখানার বয়লার অপারেটরদের প্রশিক্ষণের জন্য এখনো দেশে কোন স্বতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাই এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরীতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকার মাল্টিফ্যাবস নামক একটি পোষাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন শ্রমিক মারা যায় এবং আহত হয় অর্ধশতাধিক। ঐদিন কারখানাটি আংশিক চালু থাকায় হতাহতের সংখ্যা ছিল কম। পুরো কারখানাটি চালু থাকলে হতাহতের সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যেত। দুর্ঘটনার পর জানা গেল, বয়লারটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।
এছাড়াও ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানায় বিস্ফোরণে ৩১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হয় কয়েকশত শ্রমিক-কর্মচারী। দুর্ঘটনায় কারখানাটির একটি অংশ লণ্ডভণ্ড হয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ঘটনার সূত্রপাত, ধারণা করা হয়। যদিও জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা যে বয়লার বিস্ফোরণেই হয়েছিল, তেমনটি উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনাটির জন্য ৭টি কারণ চিহ্নিত করেছিলেন, যাদের মধ্যে ৫টি কারিগরি ও ২টি প্রশাসনিক কারণ ছিল। তদন্তে দেখা গিয়েছিল, বয়লারের প্রেসার গেজটি নষ্ট ছিল। সুপারভিশন ঠিক ছিল না এবং এটি চালু করতে সংশ্লিষ্ট মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ারের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অপারেটররা প্রেসার রিলিজ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন অর্থাৎ দক্ষতার অভাব ছিল অপারেটরের। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবং কারখানার পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্ত এত প্রাণহানির পরও কারখানার মালিক বা কর্তৃপক্ষকে বড় ধরনের কোন জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯২৩ সালে প্রণীত বয়লার আইনে চলছে বয়লার নবায়ন, স্থাপন ও শাস্তি প্রদানের মতো সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড। বয়লার আইন ১৯২৩ এর ৮-ধারা অনুযায়ী, বয়লার ব্যবহারের প্রত্যয়নপত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে নবায়নের জন্য আবেদন করতে হবে এবং ২৩-ধারা অনুযায়ী সনদপত্র নবায়ন ব্যতীত বয়লার চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বয়লার আইন ১৯২৩ এর ২৩ ধারায় অবৈধভাবে বয়লার ব্যবহারের শাস্তির বিধান হিসেবে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন যেক্ষেত্রে বয়লার ব্যবহারের জন্য সনদপত্র অথবা সাময়িক আদেশের প্রয়োজন হয়, সেইক্ষেত্রে যদি বয়লারের কোন মালিক কোন সনদপত্র বা আদেশ ব্যতীত অথবা অনুমোদিত চাপমাত্রার বেশি চাপে বয়লার ব্যবহার করেন, তাহলে তাকে অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
প্রতিটি শিল্পকারখানার জন্য বয়লার একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রধান যন্ত্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, চিনিকল, টেক্সটাইল, পেপার মিল, ফিড মিল, আটো রাইস মিল, ঔষধ শিল্প, পোষাক শিল্পে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। কিন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ যন্ত্রটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্র। ফলে এটি কোন কারণে বিস্ফোরিত হলে বা কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপকভাবে জানমালের ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই নিরাপদ বয়লার চালনা নিশ্চিত করতে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত অফিসগুলোর মাধ্যমে বয়লার পরির্দশন, স্থাপন, নবায়ন, জরিমানা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে গাজীপুরের দুর্ঘটনাটির পর শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ এ জেলায় ২০২১ সালের জানুয়ারীতে উপ-প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এতে করে বয়লার পরিদর্শন কাজ অনেক সহজ হয়েছে। কারণ এ অফিস স্থাপনের আগে স্টেকহোল্ডারদেরকে মতিঝিলের হেড অফিসে গিয়ে সব কাজ করতে হতো। অন্যদিকে পরিদর্শকরাও ঢাকা থেকে এসে কাজ করতেন।
গাজীপুর অফিসের উপ-প্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী প্রণব কুমার সরকার জানান, গাজীপুরে বিভিন্ন কারখানায় ৩ হাজার ১৫০টি বয়লার রয়েছে। এসবের মধ্যে ৯২৭টি বয়লার বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। অনেক বয়লার নষ্ট হয়ে গেছে আবার করোনার সময় অনেক কারখানা বন্ধ থাকায় এসব বয়লার বন্ধ রয়েছে। তিনি জানান, এ অফিসে বর্তমানে ৯ জন পরিদর্শক রয়েছেন। তারা প্রতিদিন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কারখানার বয়লার পরিদর্শন করে থাকেন।
বয়লার পরিদর্শন অফিসের প্রধান কাজ মূলত ৫টি। এগুলো হচ্ছে- বয়লার আমদানির জন্য ড্রয়িং ও ডিজাইন যাচাইপূর্বক ছাড়পত্র বা এনওসি প্রদান, বয়লারের ড্রয়িং, ডিজাইন পরীক্ষণ ও বয়লার পরিদর্শনপূর্বক নিবন্ধন ও প্রত্যয়নপত্র প্রদান, বার্ষিক ভিত্তিতে বয়লার পরিদর্শনপূর্বক বয়লার ব্যবহারের প্রত্যয়নপত্র নবায়ন, স্থানীয়ভাবে তৈরীকৃত বয়লারের পরিদর্শনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বয়লার নির্মাণ সনদ প্রদান এবং শিক্ষানবিশদের পরীক্ষাগ্রহণপূর্বক কৃতকার্য প্রার্থীদের বয়লার পরিচারক যোগ্যতা সনদ প্রদান।
গাজীপুর অফিসের কয়েকজন বয়লার পরিদর্শকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুরের শিল্পকারখানায় বর্তমানে কোন ত্রুটিপূর্ণ বয়লার নেই। কোন ত্রুটি বা অসঙ্গতি দেখা দিলে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া যারা বয়লার অপারেটর রয়েছে, তাদের সনদপত্র আপডেটেড আছে কিনা , তা কঠোরভাবে যাচাই করা হয়। বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মুরছালিন আহমেদ জানান, "আমাদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরিদর্শনের জন্য আমাদের নিজস্ব কোন যানবাহন নেই। এছাড়া কিছু যন্ত্রপাতি আমাদেরকে হেড অফিস থেকে নিয়ে আসতে হয়। যেমন- ভিডিও স্কোপিং,আল্ট্রাসোনিক থিকনেস গেজ, আল্ট্রাসোনিক ফ্লো মিটার, স্টিম ট্রাপ টেস্টিং, আল্ট্রাসোনিক ফ্লু ডিটেকটরসহ টেস্টিং এর জন্য উন্নত কোন যন্ত্রপাতি এ অফিসে নেই।"
উপ-প্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী প্রণব কুমার সরকার জানান, "প্রায় শতবর্ষের পুরনো আইনে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন ১০ হাজার টাকার বেশি জরিমানা করা যায় না। একটি কারখানা মালিকের জন্য ১০ হাজার টাকা কোন ফ্যাক্টর নয়। আইনে কোন মোবাইল কোর্ট নেই, তাই আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে কোন শাস্তি প্রদান করতে পারি না। প্রতিটি বয়লার প্রতিবছর নবায়ন করতে হয় কিন্ত বার্ষিক নবায়ন ফি ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৯ হাজার টাকা মাত্র । এটাও বাড়ানো উচিত।"
তবে তিনি জানান, পুরনো আইন সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি আরো জানান, পরিদর্শকদের জন্য দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার। তাহলে তাদের দক্ষতা আরো বাড়বে। অন্যদিকে অপারেটরদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে এখনো কোন স্বতন্ত্র্য ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেনি। ফলে বিভিন্ন সময় বুয়েট, তেজগাঁওয়ের বিটাক এবং নরসিংদীতে অবস্থিত ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠান থাকলে দেশে দক্ষ বয়লার অপারেটর সহজলভ্য হবে।
তিনি বলেন, "বয়লার দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এ অফিসের মাধ্যমে প্রতিবছর স্টেকহোল্ডারদেরকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের পরামর্শ প্রদান, তাদের মধ্যে প্রচারণা চালানো ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। আমরা সবাই যদি সচেতন হই , তবে বয়লার দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।"