পোশাক খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ
পণ্যের গুণমান, লিড টাইম এবং টেকসইতার দিক থেকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে এ খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ১২টি মানদণ্ডের ১০টিতেই হ্যানয়ের পিছিয়ে রয়েছে ঢাকা।
পোশাক রপ্তানির লিড টাইম হল কার্যাদেশ দেওয়া এবং ফিনিশড প্রোডাক্ট সরবরাহের মধ্যবর্তী সময়। প্রতিবেদন অনুসারে, কাঁচামালের সোর্সিংয়ে ভিয়েতনামের সক্ষমতা বেশি। দেশটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজেদের বন্দরে আমদানিকৃত চালান ছেড়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে পোশাক শিল্পের জন্য আমদানিকৃত কাঁচামাল ছাড়তে বাংলাদেশের ৪৮ ঘণ্টা থেকে এক মাস সময় লাগে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পোশাক কারখানার মালিকেরা। তারা বলেন, ভিয়েতনামের শ্রমিকরা উৎপাদনে ১০-১৫ শতাংশ বেশি দক্ষ। দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন আগে ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে চূড়ান্ত পণ্য সরবরাহ করতে পারে।
বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারক স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য আনা-নেওয়াতেই আমাদের ডেলিভারির সময়সীমার বড় একটা অংশ চলে যায়। সার্বিক লজিস্টিক সাপোর্টে ভিয়েতনাম অবশ্যই আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।'
এরপরই আসে চালানের সময়। ভিয়েতনাম সরাসরি নিজের সমুদ্রবন্দর থেকে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠালেও বাংলাদেশ তা পারে না।
গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকায় ফিডার ভেসেলগুলোকে পণ্য সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে ইউরোপ ও আমেরিকায় চালানের জন্য পণ্য মাদার ভেসেলে স্থানান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, 'বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে লিড টাইম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।' তিনি আরও বলেন, বন্দর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে ২০২০ সালে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টপকে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক পোশাক রপ্তানিকারকে পরিণত হয়। অনানুষ্ঠানিক তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে ভিয়েতনামের চেয়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় করে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান পুনরুদ্ধার করেছে।
অন্তত ১৫০ রপ্তানিকারক এবং ৩০টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও বিক্রেতার ওপর জরিপ চালিয়ে ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনের অন্যান্য প্রধান মানদণ্ডগুলো হলো—মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা, উদ্ভাবন, দক্ষতা, কার্যাদেশের পরিমাণের ফ্লেক্সিবিলিটি, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ দশ সূচকে ভিয়েতনামের ফ্যাশন শিল্প বাংলাদেশের চেয়ে অন্তত এক স্কোর এগিয়ে রয়েছে। টেকসইতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ব্যবধান যথাক্রমে ১.৫ ও ২। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টসহ (আঙ্কটাড) জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি কয়া হয়েছে।
শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও সস্তা শ্রমের সুবাদে কেবল দুটি সূচকে—মূল্য ও শুল্ক সুবিধা—ভিয়েতনাম ও চীনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়ার অন্য তিন স্বল্পোন্নত দেশ কম্বোডিয়া, লাওস ও নেপালের তুলনায় কয়েকটি সূচকে একটু এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্প্যারো গ্রুপের এমডি শোভন ইসলাম বলেন, সরবরাহ শৃঙ্খলে যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে দক্ষতার ওপর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, 'একটা ফ্যাব্রিক যদি সময়মতো বন্দরে না আসে, সাপ্লাই চেইনে যদি বিঘ্ন ঘটে অথবা শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা আমাদের সাথে ঘটছে।'
তবে বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতকে ভিয়েতনামের পেছনে দেখানো সব সূচকের সঙ্গে তিনি একমত নন।
তিনি দাবি করেন, 'অর্ডারের পরিমাণের ফ্লেক্সিবিলিটির ক্ষেত্রে আমাদের থেকে আর কারও এগিয়ে থাকার কথা নয়। আমরা এতটাই ফ্লেক্সিবলি অর্ডার নিই যে ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে কয়েক হাজার পিস থেকে শুরু করে মাত্র কয়েকশ পিস কাপড়ও নিতে পারে।'
বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের গুণমাণের পক্ষেও কথা বলেন বিকেএমইএ সহসভাপতি। তিনি করে বলেন, 'ক্রেতারা যেমন চায়, তেমন পণ্য তৈরি করি আমরা। বাংলাদেশ মান দিয়ে ব্র্যান্ডগুলোকে সন্তুষ্ট করতে পারছে, তাই আমাদের দেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি বেশি কার্যাদেশ পাচ্ছে।'
অবশ্য উচ্চ মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক উন্নতি করতে হবে, এ ব্যাপারে ফজলে শামীম এহসান একমত।
বিকেএমইএর সহ-সভাপতির মতো, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসানও বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেদনটি বিস্ময়করভাবে গত এক দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রগতিকে কমিয়েছে।
"প্রতিবেদনে পরিবেশগত সম্মতি সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলিকে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিংয়ের একটি নেতিবাচক দিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে শিল্প কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, শ্রমিকদের সুস্থতা এবং পরিবেশগত টেকসইতাকে রূপান্তর করতে বিশাল অগ্রগতি করেছে। রেটিংটি অনুপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে," তিনি উল্লেখ করেছেন।
বিকেএমইএ সহসভাপতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসানও বলেন, প্রতিবেদনটিতে কিছু ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে গত এক দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রগতিকে খাটো করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রতিবেদনে পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলোকে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিংয়ের একটা অসুবিধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েয়ে। অথচ এ শিল্প কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, শ্রমিক কল্যাণ এবং পরিবেশগত সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিতে বিশাল অগ্রগতি করেছে। রেটিংটিকে যথাযথ মনে হচ্ছে না।'
এফডিআই ও এফটিএ-তে এগিয়ে ভিয়েতনাম
প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর বড় সুবিধা হলো পোশাক খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) শক্তিশালী উপস্থিতি। এটি এই দেশগুলোকে উন্নত মান এবং দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে।
তিনি আরও বলেন, 'আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ইইউয়ের পোশাকের বাজারে বাংলাদেশ সম্ভবত অগ্রাধিকার সুবিধা হারাবে। কিন্তু উন্নয়নশীল ভিয়েতনাম এফটিএ (মুক্তবাণিজ্য চুক্তি) করায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।'
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ২০২৯ সালের পর বাংলাদেশ আর শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার পাবে না। তবে ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা পাবে দেশ। নিরবচ্ছিন্ন বাজার প্রবেশাধিকারের জন্য ঢাকাকে তখন বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্য ব্লকের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল প্রতিবেশী ভুটানের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) রয়েছে বাংলাদেশের।
ড. রাজ্জাক বলেন, 'অনেক ক্রেতাই শুল্কমুক্ত অবস্থাকে সোর্সিং সিদ্ধান্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক মনে করে। যদিও সমস্ত সোর্সিং ভিয়েতনামে কেন্দ্রীভূত হবে না, তবু হলেও বাংলাদেশ একদিকে যেমন শুল্কসুবিধা হারাবে অন্যদিকে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কার মতো বাজার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তরফ থেকে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক চাপের মুখে পড়বে।'
প্রতিবেদনে বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানিতে যে আঘাত আসতে পারে, তাতে সম্ভাব্য রপ্তানির ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
তবু থাকবে কার্যাদেশ
ডব্লিউটিওর রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা খরচ, স্পিড টু মার্কেট, ফ্লেক্সিবিলিটি, তৎপরতা এবং কমপ্লায়েন্স ঝুঁকিসহ বিভিন্ন সোর্সিংয়ের ওপর জোর দেয়।
চীন ও ভিয়েতনামকে ক্রিটিক্যাল সোর্সিং ভিত্তি হিসেবে দেখে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। আর বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস, নেপালের মতো স্বল্পোন্নত দেশকে দেখে তাদের বিভিন্ন সোর্সিংয়ের অংশ হিসেবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ইইউভিত্তিক ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর আরেকটি প্রধান সোর্সিং গন্তব্য হলো তুরস্ক। আর সীমিত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ইইউভিত্তিক ক্রেতারা বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস এবং নেপাল থেকে কমপ্লেক্স পণ্য (পোশাক এবং বহির্বাস) কম কেনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরেও বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস ও নেপাল ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় সোর্সিং গন্তব্য মনে হতে পারে। প্রধান ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের বিশ্বাস, এলডিসি থেকে উত্তরণ এসব দেশের সোর্সিংকে খানিকটা প্রভাবিত করতে পারে।
এছাড়া আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া থেকে তারা তাদের সোর্সিং আরো বাড়াবে বলেও প্রতিবেদনে উঠে আসে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। এসব পরিবর্তনের ফলে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হবে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা ও যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, 'প্রতিবেদনে যেসব বিষয় এসেছে, বাংলাদেশ তা নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু এতে আরো গতি বাড়ানো দরকার। আমরা সঠিক ট্র্যাকে আছি, কিন্তু এমন গতি হওয়া উচিত নয়, যাতে ট্রেন মিস হয়ে যায়। এফটিএ ও পিটিএ নিয়ে আরও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা দরকার।'
তিনি আরও বলেন, 'জিএসপি [জেনারেলাইজড সিস্টেম অভ প্রিফারেন্সেস] সুবিধার আওতায় না থাকা সত্ত্বেও আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হারে চীন ও ভিয়েতনামের চেয়েও এগিয়ে রয়েছি।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ইউরোপের বাজারে আরও পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০৩১ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা যাতে পাওয়ার চেষ্টা করবে বাংলাদেশ।
'এছাড়া পিটিএ, এফটিএ করে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চলতি বছর এই চুক্তি করতে হবে,' মন্তব্য করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।