মরণদূত ময়লার ট্রাক!
২৩ জানুয়ারি রোববার রাত দেড়টা থেকে পৌনে দুইটার দিকে তেজগাঁও থানা এলাকার রাওয়া ক্লাবের সামনে মহাখালী ফ্লাইওভারের পশ্চিম মাথার ঢালের উপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী শিখা রানী ঘরামী ৫৫) ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, সে সময় মহাখালী থেকে বিজয় সরণির দিকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে সিটি করপোরেশনের সাদা রংয়ের ময়লাবাহী একটি গাড়ি দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে এসে তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। শিখা রানী ঘরামী ফ্লাইওভারের রেলিংয়ের উপর দিয়ে নিচে পাকা রাস্তায় পড়ে যান। মাথায় গুরুতর আঘাত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম লাগায় তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। রোববার তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলায় এভাবেই লিখেছেন শিখা রানী ঘরামীর ছেলে খোকন ঘরামী (২৪)। মধ্যরাতে এভাবে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে প্রাণ গেছে খোদ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর।
কয়েক মাস আগে এক ঠিকাদারের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নেন শিখা রানী। মাসে সবমিলিয়ে ৫০০০ হাজার টাকার মতো পেতেন, তাই দিয়েই কোনমতে থাকতেন মহাখালী আদর্শনগরের সাততলা বস্তিতে। রোববার সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে মায়ের লাশ নিতে গিয়ে নিথর চোখে চাইছিলেন শিখা রানীর খোকন। বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করতে করতে বলেন, "শনিবার রাতে তুমি কী সুন্দর বাসা থেকে বের হয়ে গেলা, আর এখন ডাক্তাররা আমাকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়েছে। জলজ্যান্ত একটা মানুষ কাগজ হয়ে গেল, কি ডাকাত ময়লার গাড়ি!"
তেজগাঁও থানার (ইন্সপেক্টর তদন্ত) শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, খবর পাওয়ার সাথে সাথে উপ-পরিদর্শক জেসমিন বেগমের নেতৃত্বে একটি টিম তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান বলে চিকিৎসকরা জানান। নিহতের ছেলে বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন, তবে এখনো কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। এজন্য অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার গাড়ির ধাক্কায় কতজন নিহত হয়েছেন তার কোন পরিসংখ্যান রাখে না দুই সিটি করপোরেশনের কেউই। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এ নিয়ে আলাদা করে তথ্য সংগ্রহ করে না। তবে গণমাধ্যম থেকে নেয়া গত ৫ বছরের খবর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই বছরগুলোতে অন্তত ১৮ জন সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির আঘাতে মারা গেছেন। গত এক বছরেই মারা গেছেন অন্তত ৮ জন। এই তালিকায় আছে কলেজছাত্র, সংবাদকর্মী, শ্রমিক, শিক্ষিকা ও সাধারণ মানুষ। প্রতিটি ঘটনাতেই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে; কিন্তু প্রতিবারই দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করা হয়েছে। ফলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কোনো বিচার পায়নি। বন্ধ হয়নি ময়লার গাড়িতে মৃত্যুর মিছিল।
এর আগে, সবশেষে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর আন্দোলনে দুই সিটি করপোরেশনের যানবাহন ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে আসে। এতে দেখা যায়, বেশিরভাগ গাড়িচালকই অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন। সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত চালকদের কেউই ময়লার গাড়ি চালান না।
ময়লার গাড়িতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান
২০১৬ সালের ৪ মার্চ রাজধানীর উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় ময়লার ট্রাকের চাপায় আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যবসায়ী মারা যান। একই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ সিটির গাড়িচাপায় আবু তাহের নামে এক বিজিবি জওয়ান নিহত হন।
২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সবুজবাগ বৌদ্ধ মন্দিরের সামনের রাস্তায় সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় রিমন (২৫) ও শারিন (২২) নামে দুই খালাতো ভাইবোনের মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর বংশালে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নূরজাহান বেগম (২১) এক গৃহবধূ নিহত হন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তার স্বামী মো. শফি উল্লাহ।
২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মিরপুরে ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় আবদুল খালেক হাওলাদার (৬৭) নামে একজন ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা নিহত হন।
গত বছরের ১৭ জানুয়ারি গেণ্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের স্টাফ খালিদের (৫০) মৃত্যু হয়। এ ঘটনার ১১ মাস অতিবাহিত হলেও বিচার পায়নি পরিবারটি।
১৬ এপ্রিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় এক রিকশাচালক নিহত হন। সে সময় উত্তেজিত জনতা সিটি করপোরেশনের গাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
এছাড়া ২ মে রাজধানীর শাহজাহানপুর টিটিপাড়ায় ময়লার ট্রাকচাপায় স্বপন আহমেদ (৩৩) নামে এক ব্যাংক কর্মচারী নিহত হন। এ ঘটনায় ট্রাকচালক নূরুল ইসলামকে আটক করা হয়। গত ১৩ মে উত্তর সিটির ময়লার গাড়ির চাপায় সাভারের অদূরে মিরা আরফিম (৩৫) নামে এক নারী মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।
২৪ নভেম্বর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়িতে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম ও পরদিন ২৫ নভেম্বর রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির সামনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান সংবাদকর্মী আহসান কবির খান (৪৬)।
২ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় এক নারী গুরুতর আহত হন।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ভোরে ওয়ারি এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মারা যান স্বপন কুমার সরকার (৬২)।
উদ্যোগ বাস্তবায়ন নেই সিটি করপোরেশনের
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি রয়েছে ১৬৫টি। বিপরীতে স্থায়ী চালক আছেন মাত্র ৬২ জন। এর বাইরে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া চালক আছেন ২০ জন। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ময়লাবাহী গাড়ি ৩১৭টি। বিপরীতে চালক ৮৬ জন।
গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং ২৫ নভেম্বর উত্তর সিটির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রথম আলোর একজনের মৃত্যুর পরে দুই সিটি কর্পোরেশনই সিদ্ধান্ত নেয় দিনে কোনো ময়লার গাড়ি চলাচল করবে না এবং ড্রাইভারের লাইসেন্স ব্যতীত কেউ ভাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না।
তখন থেকেই দুই সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেশ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হয়েছিল, রাতের বেলা তাদের ময়লাবাহী গাড়ি ময়লা নেয়। নিজেদের ড্রাইভারের পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও তাদের গাড়ি চলছে। তখন থেকে যাদের ভারী যানের লাইসেন্স ছিল না তারা ভারী গাড়ি চালাতে পারবেন না। লাইসেন্স ছাড়াও কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। এছাড়া অপর্যাপ্ত ড্রাইভারের বিষয়ে তারা খুব জলদিই মাস্টাররোলে নিয়োগের পাশাপাশি প্রায় ৯৪ জন ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ড্রাইভারকে নিয়োগ দেয়নি উত্তর সিটি।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এস এম শরিফ-উল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ড্রাইভার নিয়োগ দিতে পারিনি তবে প্রক্রিয়া চলছে। এজন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে। নিয়োগের বিষয়ে একটু সময় লাগে। ৪৬ বা ৪৭ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান।"
দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, "কার গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারিনি। এজন্য পুলিশ কাজ করছে। আর গাড়ি চিহ্নিত হলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো।"
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কোন ধরনের সহযোগিতা করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "যিনি মারা গেছেন তিনি আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন। তিনি আমাদের ঠিকাদারের আন্ডারে কাজ করেন। সিটি কর্পোরেশন থেকে তার পরিবারকে সহযোগিতা করা হবে তবে কোন ধরনের সহযোগিতা সেটা এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।"
গত ৩০ নভেম্বর গুলশানের নগর ভবনে ডিএনসিসিতে কর্মরত পরিবহন চালকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় মেয়র আতিকুল চালকদের হুঁশিয়ার করে বলেন, গাড়ি চালানোর জন্য যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তাকেই গাড়ি চালাতে হবে। সব গাড়িতে আধুনিক জিপিএস ও ড্যাস কামেরা স্থাপন করা হবে।
মেয়রের মিছে আশ্বাস!
"আপনি আমার ছোট বোন, আপনার পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিলাম। পরিবারের খরচ ও সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির খান (৪৮) নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রীকে ফোনে সান্ত্বনা দিয়ে এ কথাগুলোই বলেছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও পাঠানো হয়েছিল ওইদিন।
কিন্তু কবিরের পরিবারের অভিযোগ, দুর্ঘটনার পর গত দুই মাসে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে একবারও খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি কোন আর্থিক সহায়তাও। গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে ডিএনসিসি ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন মোটরসাইকেল আরোহী কবির খান। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাদিরা পারভিন রেখা (৪০) বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা করেন। পরিবারের খরচ নির্বাহ ও দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন নাদিরা পারভিন। ছেলে সাদমান শাহারিয়ার কাইফ (১৫) ও মেয়ে সাফরিন কবির দিয়া (১০) দুজনকে নিয়ে অকূল পাথারে যেন তিনি।
দুর্ঘটনার দিন ২৫ নভেম্বর রাতেই উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাসার মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, 'নিহত আহসান কবির খানের দুই সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। ইতিমধ্যে ডিএনসিসি মেয়রের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা, নিহতের নিজ বাড়ি ঝালকাঠিতে মরদেহ পরিবহন ও যাতায়াতের জন্য একটি ফ্রিজার ভ্যান এবং একটি মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে।'
পরে নিহত কবির খানের স্ত্রীকে সান্ত্বনা জানিয়ে মোবাইলে কথা বলেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম।
কবির খানের চাচাতো ভাই জহির ইলিয়াছ খান বলেন, "ওই রাতে সমঝোতার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দিতে আসেন ডিএনসিসির (কারওয়ান বাজার) অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ। তিনি লাশ ঝালকাঠি গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেওয়ার কথা জানান। তখন শোকাহত পরিবারটি কোনো টাকা নেয়নি। তবে ডিএনসিসির অ্যাম্বুলেন্সের আশ্বাসে অন্য অ্যাম্বুলেন্সও ঠিক করা হয়নি। রাতে সিটি কর্পোরেশন থেকে কেউ যোগাযোগ রাখেনি, অ্যাম্বুলেন্সও পাঠায়নি।"
এরপর তিনি একবারও এই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেননি।
নিহতের স্ত্রী নাদিরা পারভিন বলেন, "সিটি করপোরেশনের মিথ্যা প্রচারণার কারণে স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই ভাবছেন, আমরা বেশ ভালো আছি, মেয়র আতিকের অনুদান পেয়েছি। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে আমরা কিছুই পাইনি।"