ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির কারণে বাংলাদেশ কোভ্যাক্সের ভ্যাকসিন বেশি পেয়েছে
ভ্যাকসিন সংকটের কারণে টিকা দেওয়া শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে থমকে গিয়েছিলো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কর্মসূচী। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে বাংলাদেশে এখন চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন মজুদ আছে; দেশে বুস্টার ডোজও দেয়া শুরু হয়েছে। কোভ্যাক্সের আওতায় সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ। সরকারের ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির কারণে এই সাফল্য এসেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
সার্বিকভাবে, সারা বিশ্বে প্রায় ৯.৮ বিলিয়ন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ৯১টি দরিদ্র দেশের প্রায় ৮২% ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দিয়েছে কোভ্যাক্স।
শীর্ষ কোভ্যাক্সের ভ্যাকসিন প্রাপ্তদের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৩.০৬ মিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়া ৮৭.৯৫ মিলিয়ন, পাকিস্তান ৭৭.১৬ মিলিয়ন, ফিলিপাইন ৬৫.১৪ মিলিয়ন, নাইজেরিয়া ৬০.০৭ মিলিয়ন, মিশর ৫৪.২২ মিলিয়ন, ভিয়েতনাম ৪৯.৬১ মিলিয়ন, উগান্ডা ৩০.৯২ মিলিয়ন, নেপাল ২২.৯৩ মিলিয়ন এবং ইথিওপিয়া ২২.৪৬ মিলিয়ন ভ্যাকসিন নিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্স কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, "কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ সরকারের পুরো টিম এক সাথে কাজ করেছে। আমাদের যখন ভ্যাকসিন সংকট দেখা দিলো তখন সরকারের সব মিশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে যা কোভ্যাক্সের মাধ্যমে দেশে এসেছে। এখানে কোন ব্যক্তি নয়, পুরো টিম কাজ করেছে, আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সরাসরি তদারকি করেছে।"
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৯.২৪ কোটি মানুষ, দুটি ডোজ পেয়েছেন ৫.৮৩ কোটি মানুষ দুটি ডোজ এবং এখন পর্যন্ত বুস্টার ডোজ গ্রহণ করেছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
দেশে ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য মানুষের আগ্রহ আছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিশেষ ক্যাম্পেইন করে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পেইন করে দিনে ৭০ লাখের বেশি ভ্যাকসিন দেয়ারও রেকর্ড আছে।
ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা আরও বলেন, "কোভ্যাক্স সাধারণত ভ্যাকসিন ইউটিলাইজেশনের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোকে ভ্যাকসিন দেয়। এটিও বাংলাদেশের বেশি ভ্যাকসিন পাওয়ার একটি কারণ। বাংলাদেশে যেহেতু ভ্যাকসিন ইউটিলাইজেশনের হার ভালো সেজন্যও বাংলাদেশ বেশি ভ্যাকসিন পাচ্ছে।"
গত বছরের ১ জুন কোভ্যাক্সের আওতায় প্রথম ফাইজার/বায়োএনটেকের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ১০৬,০০০ ডোজ টিকা দেশে আসে। এরপর কোভ্যাক্সের আওতায় এখন পর্যন্ত ফাইজার, মর্ডানা, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।
কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশ বিনামূল্যে ও কস্ট শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কিনেছে। সরকারের হাতে এখন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন থাকলেও ভ্যাকসিন পেতে কোভ্যাক্সের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, "প্রয়োজনে আমাদের ভ্যাকসিন টার্গেট চেঞ্জ হতে পারে, তখন আরো ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। ভ্যাকসিন পেতে আমরা আজও (রোববার) কোভ্যাক্সের সাথে মিটিং করলাম। কারণ আমরা ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও ভ্যাকসিন দেয়ার কথা ভাবছি, তখন ফাইজারের ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২ বছরের কম বয়সীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার নির্দেশনা দিলেই আমরা তাদের ভ্যাকসিন দিবো। এছাড়া আমরা সব মানুষকে পর্যায়ক্রমে বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা করছি সেজন্য ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে।"
উপহার, কেনা ও অনুদান- এই তিন উপায়ে বাংলাদেশ মোট ২৪ কোটি ১৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, সদস্য দেশগুলোর অন্তত ২০% জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে কোভ্যাক্সের। বাংলাদেশের জনগণ ৪০% টিকা পাবে কারণ আমাদের এখানে টিকা দেওয়ার হার ভালো।
কিন্তু বাংলাদেশ এখনও তার ২০% জনসংখ্যার জন্য বরাদ্দকৃত ভ্যাকসিই পায়নি; এই চালান গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এসে পৌঁছানোর কথা ছিল বলে জানান তিনি। তবে আমরা যে অনুদান পেয়েছি তা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি বলেও ডা. আলমগীরউল্লেখ করেন। ভবিষ্যতে আসা কোভ্যাক্সের ভ্যাকসিনগুলো বুস্টার ডোজের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে জানান।
অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা ও ডা. আলমগীরের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় দেশের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সাবেক উপাচার্য ডা. অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কথায়। তিনি বলেন, কোভ্যাক্স ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সতর্ক হওয়া উচিত যেন কোনভাবেই ভ্যাকসিনের অপচয় না হয়।
"বয়স্ক ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদানের আওতায় আনা উচিত এবং মানুষের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত সহজতর করা উচিত," পরামর্শ দেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ মিলে মোট ১৫ কোটি ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে এখনো প্রায় ৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আছে।
শুক্রবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ৯ কোটি টিকা এখনো আছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দেশের ৭০% অর্থাৎ সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে।