শাবিপ্রবি সঙ্কট: ‘চাপে’ নমনীয় আন্দোলনকারীরা
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে নতুন মোড় নিয়েছে মঙ্গলবার। নানামুখী চাপে পড়ে মঙ্গলবার অনেকটাই নমনীয় হয়ে এসেছেন আন্দোলনকারীরা। যারা অনশন করছেন, তাদের অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ করেছেন অন্য আন্দোলনকারীরা। তবে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এর আগে সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকা থেকে শাবিপ্রবির ৫ সাবেক শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই পাঁচজন আন্দোলনকারীদের অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন, এমন অভিযোগে তাদের আটক করা হয়।
আর সোমবার থেকে আন্দোলনকারীদের কাছে টাকা পাঠানোর সবগুলো বিকাশ, নগদ ও রকেট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এছাড়া ক্যাম্পাসের ভেতরের সবগুলো খাবারের দোকান ও টং দোকান মঙ্গলবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতেও বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
এই তিন ঘটনায় অনেকটাই চাপে পড়ে যান আন্দোলনকারীরা। এরপর মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে পরবর্তী করণীয় নির্ধরণে উন্মুক্ত সভা করেন তারা। তাতে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সন্ধ্যায় আবার সভা করেন। এতে সিদ্ধান্ত হয় উপাচার্যের পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তবে অনশনকারীদের অনশন ভাঙার জন্য সবাই মিলে অনুরোধ করারও সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আন্দোলন চলিয়ে যাওয়ার শপথও পাঠক করেন শিক্ষার্থীরা।
সভার সিদ্ধান্তের পর উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনস্থলে গিয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙার অনুরোধ জানিয়েছেন আন্দোলনকারী অন্য শিক্ষার্থীরা। অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ায় তাদের এই অনুরোধ জানানো হয়।
তবে অনশনকারীরা প্রথমে অনশন ভাঙতে রাজি হননি। পরে অন্য শিক্ষার্থীদের অনুরোধে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য তারা একঘণ্টা সময় চান।
অনশন ভাঙার জন্য শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমনুল বাশার রাজ বলেন, 'আমরা আন্দোলনকারীদের কষ্ট আর নিতে পারছি না। তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছেন। এভাবে চলতে পারে না। তাদের জীবন আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান। তাই আমরা তাদেরকে অনশন ভাঙার অনুরোধ করি।'
রাজ আরও বলেন, 'অনশন ভঙ্গ করলেও উপাচার্যের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।'
আটক ৫ সাবেক শিক্ষার্থী সিলেটে
ঢাকায় আটক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক ৫ শিক্ষার্থীকে সিলেট মহানগর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেল ৫টার দিকে ওই পাঁচজনকে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ।
তিনি বলেন, 'ঢাকায় আটক ৫ জনকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থ জোগান দেওয়ার বিষয়ে আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি।'
আটক পাঁচজন হলেন হাবিবুর রহমান স্বপন, রেজা নূর মঈন দীপ, নাজমুস সাকিব দ্বীপ, এ কে এম মারুফ হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ।
এর মধ্যে হাবিবুর বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে ২০১২ সালে পাস করেছেন। একই বছর আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে পাস করেছেন রেজা নূর মঈন দীপ ও নাজমুস সাকিব দ্বীপ।
উপাচার্যের জন্য শিক্ষক সমিতির খাবার
নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ থাকা শাবিপ্রবি উপাচার্যের জন্য এবার খাবার নিয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির নেতারা। তবে যথারীতি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আপত্তির কারণে উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি তারা। তবে শিক্ষকরা যাওয়ার পর খাবারগুলো পুলিশের মাধ্যমে উপাচার্যের বাসায় পৌঁছে দেন শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার দুপুরে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাশ, সাধারণ সম্পাদক মহিবুল আলমের নেতৃত্ব শিক্ষক নেতারা খাবার নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আসেন।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় প্রক্টর ড. আলমগীর কবীরের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক এবং দুপুরে সিলেট সিটি করপোরেশনের দুজন কাউন্সিলর উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন উদ্দিনের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন। তাদেরও উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করতে দেননি শিক্ষার্থীরা।
গত রোববার সন্ধ্যা থেকে উপাচার্য ভবনে পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর রাত ৮ টার দিকে তার ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন শিক্ষার্থীরা। যদিও সোমবার মধ্যরাতে বিদ্যুৎ সংযোগ আবার চালু করেন তারা।
উপাচার্য ভবনে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ওই ভবনের ফটকের সামনে মানববর্ম তৈরি করে রেখেছেন। কেউ ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দিচ্ছেন। ফলে প্রক্টর আর দুই কাউন্সিলরের মতো মঙ্গলবার শিক্ষক সমিতির নেতারাও উপাচার্যের জন্য আনা খাবার তার কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি।
উপাচার্য ভবনে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাশ বলেন, 'উপাচার্য অসুস্থ। এরমধ্যে অনেকদিন ধরেই তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। তাই আমরা কিছু খাবার নিয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।'
তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা দাবির সাথে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। খাবার নিয়ে এসেছি মানবিকতা থেকে।'
খাবার নিয়ে আসার দুদিন আগে শনিবার জরুরি সভা করে শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। সভা শেষে এক বিবৃতিতে শাবি শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের পদত্যাগ 'সরকারের এখতিয়ারের বিষয়' উল্লেখ করে। এতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উপাচার্যের জন্য আনা খাবার ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সাব্বির আহমদ বলেন, 'উপাচার্য অসুস্থ হলে আমরা তার ওষুধের ব্যবস্থা করব। প্রয়োজনে আমরা খাবার দেবো। কিন্তু আমাদের এইভাবে অনশনে রেখে তিনি নিজ বাসভবনে বসে নানাজনের সাথে খোশগল্প করবেন, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করবেন, তা আমরা মেনে নিতে পারি না।'
শিক্ষকদের প্রবেশ করতে না দিলেও তাদের খাবার উপাচার্যের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।