মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ৭ মার্চ ভাষণের রেকর্ড
'সালাহ্উদ্দিন দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে রেসকোর্স গেলেন। পরে ভাষণটি রেকর্ড আকারে প্রকাশ করতে উদ্যোগী হন। দীর্ঘ ভাষণটিকে নিজেই বসে বসে এডিট করেন যেন একটি রেকর্ডে (৪৫ আরইপিএম ইপি রেকর্ড, বঙ্গবন্ধু ভাষণটি দিয়েছিলেন ১৯ মিনিট ধরে) ধারণ করার মতো সময়ের মধ্যে আনা যায়। হটকেকের মতো বিক্রি হয় রেকর্ডটি। সাভার ফ্যাক্টরি থেকে রেকর্ড তৈরি হয়ে আসত ৩০ নং ইন্দিরা রোডে। আমার কাছে থাকত রেকর্ডের হিসাব বা স্টক। শেখ সাহেবের ভাষণের এতো চাহিদা তৈরি হয়েছিল যে কুলানো যেত না। অফিসের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিত ডিলাররা। মোল্লা নামে অফিসের এক পিয়ন ছিল। সে সাভার থেকে রেকর্ড আনত অফিসে এবং অফিস থেকৈ স্লিপ ইস্যু করলে ডিলারদের রেকর্ড সরবরাহ করা হতো। মোল্লা স্টুডিও আর অফিস দৌড়াদৌড়িতে ভাষা সংকুচিত করে বলত, ভাবী ৫০০ শেখ সাহেব দেন। সবার হাসি পেয়ে যেত। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খন্দকার সাহেব ধমক দিয়ে বলতেন, শেখ সাহেব কিরে? বলবি, শেখ সাহেবের রেকর্ড দেন। হাঁপাতে হাঁপাতে মোল্লার উত্তর, আমি সমানে দৌড়ের উপরে, তাই কথা কম।' বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রকাশিত হারুনর রশিদের গ্রন্থ 'সালাহ্উদ্দিন' এ রুহিয়া সালাহ্উদ্দিনের স্মৃতিচারণা। উল্লেখ্য 'মেঘের অনেক রং' (১৯৭৬) চলচ্চিত্রের নির্মাতা হারুনর রশিদ ছিলেন সালাহউদ্দিনের একসময়কার সহকারী।
আর সালাহ্উদ্দিন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার। তার 'রূপবান' (১৯৬৫) ছবিটি দিক বদলে দিয়েছিল। ততদিনে 'ধারাপাত', 'রাজধানীর বুকে' বা 'হারানো দিনে'র মতো মননশীল বাংলা ছবি নির্মিত হলেও জনপ্রিয় হতে পারছিল না। রূপবানই বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় ধারা সূচনা করে। ছবিটি দেখতে দূর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে করে লোক আসত শহরের সিনেমা হলে। পাশের মাঠে তাঁবু করে থাকত। পরদিন শো দেখে আবার বাড়ির পথ ধরত। রূপবানের আগে পর্যন্ত উর্দু ছবিরই দাপট ছিল বেশি। যাহোক সালাহ্উদ্দিন আগ্রহী ছিলেন বাংলার লোকগীতি, জারি-সারি আর পল্লীগীতিতেও। কারণ এইচএমভি লাহোরে অফিস করেছিল, ঢাকাকে তারা আমলে নেয়নি। তাই একরকম চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৬৮ সালে সালাহ্উদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা রেকর্ডস। ফেরদৌসি রহমানসহ আরো পরে জনপ্রিয় খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, জানে আলম, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, আব্দুর রহমান বয়াতী, কিরণ চন্দ্র রায় প্রমুখ সকলেই যুক্ত ছিলেন ঢাকা রেকর্ডের সঙ্গে।
শিল্পী ফকির আলমগীর যেমন তার স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা রেকর্ড প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ তার (সালাহ্উদ্দিন) কারখানা থেকে রেকর্ড করে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। পচিশে মার্চের পর সালাহ্উদ্দিনকে ধরার জন্য পাকবাহিনী উঠে পড়ে লাগে। তিনি বিদেশে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
যা ঘটেছিল ২৫ মার্চ
'সালাহ্উদ্দিন ২৫ মার্চ সকাল থেকেই ছিলেন সাভারের কারখানায়। ঢাকায় কী ঘটছে জানতেও পারেননি। গভীর রাতে গাড়ি ভর্তি রেকর্ড নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সব শুনে তো তিনি হতভম্ব।' জানাচ্ছেন সালাহ্উদ্দিনের স্ত্রী রুহিয়া। আরো জানাচ্ছেন,' আমার শাশুড়ি বললেন, বৌমা তাড়াতাড়ি লুকাও রেকর্ডগুলো। মিলিটারি যে কোনো সময় হামলে পড়তে পারে। গোপনে তাই রাত জেগে বাড়ির পেছনে গর্ত করা হলো। গর্ত খুঁড়ে ভাষণের সব রেকর্ড মাটিচাপা দেওয়া হলো পলিথিন ভরে। ওই রাতেই শুরু হলো অনিশ্চিত যাত্রা। পরদিন মিলিটারি আমাদের দেশে এসে তন্ন তন্ন করে রেকর্ড খুঁজেছে আর বলেছে, 'কাহা সালাহ্উদ্দিন ? কাহা রেকর্ড।' আমরা প্রথমে গিয়ে সাভার কারখানায় লুকিয়েছিলাম তারপর কুল্যা গ্রামে। মিলিটারি খবর পেয়ে কুল্যা গ্রামও তছনছ করেছিল। সালাহ্উদ্দিন অনেক কষ্টে ইংল্যান্ড চলে যেতে পেরেছিল।'
উল্লেখ্য ঢাকা রেকর্ডের প্রতীক ছিল কোকিল। সুইডেন আর জার্মানীর যন্ত্র দিয়ে সাজানো হয়েছিল কোম্পানীটি। সালাহ্উদ্দিনের জন্ম নোয়াখালীতে ১৯২৬ সালে। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সায়েন্স ল্যাবে ডেমনস্ট্রেটর ছিলেন। চলচ্চিত্রাঙ্গনে সহকারীরা তাকে স্যার বলেই ডাকত। স্বল্পভাষী , চিন্তাশীল ও ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। তার প্রথম চলচ্চিত্র 'যে নদী মরুপথে' মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। ধারাপাত, আলোমতিও তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র। তিনি ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন ছবির প্রযোজক। ২০০৩ সালে তিনি আমেরিকায় মারা যান।
তথ্যচিত্র দি স্পিচ
ভুবনমাঝি বা গণ্ডিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফাখরুল আরেফিন খান। তিনি ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ডিংয়ের (অডিও, ভিডিও) সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। শুরুর দিকেই আছে এম এ খায়েরের (১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত এমএনএ) বক্তব্য। তিনি বলছিলেন, যখন ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন স্থগিত করলেন তখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। আমাদেরকে বঙ্গবন্ধু ডাকলেন হোটেল পূর্বানীতে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার যা বলার ৭ মার্চ বলব। আমরা ভাবলাম, নিশ্চয়ই সেদিন দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। তাই ঢাকা রেকর্ডের পক্ষ থেকে ভাষণটি রেকর্ড করার কথা ভাবলাম। সালাহ্উদ্দিন ছিলেন চেয়ারম্যান আমি ছিলাম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমরা এটাও ভেবেছিলাম যে রেকর্ডটি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে (১৭ মার্চ) উপহার দেব।
তথ্যচিত্রে তারপর এমএ মবিনকে কথা বলতে দেখা যায়। তিনি তখন ডিএফপির ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তারা ভিডিও রেকর্ড করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এমএ খায়ের সাহেবকে বলেছিলেন যেন বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে রাখে মুখটা ক্যামেরার দিকে একটু ঘুরিয়ে রাখে যেন মাইক্রোফোন পুরোটা আড়াল করতে না পারে। মবিন সাহেবরা ৭ মার্চ একটা সাইলেন্ট ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেটির উপস্থিতির ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। মবিন বলছিলেন, 'অনন্য এক রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবদিক তিনি সামলে চলতে পারতেন।'
এমএ মবিন অনেক কৌশল করে রিলগুলো এফডিসি থেকেই নেগেটিভ করিয়ে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মাত্র তিনি মোহাম্মদপুরে তার এক গুরুস্থানীয় ব্যক্তির বাড়িতে সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন ১৫ দিন। তারপর ভাবলেন এগুলো শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো। আমজাদ আলী খন্দকার ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান। তিনি দুরুদুরু বক্ষে একটা বেবিটেক্সিতে করে ফিল্ম ক্যানগুলো নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বখশীবাজার পার হয়ে একটি বাস পান। বাসের ওপরে ক্যানগুলো চড়িয়ে নিজেও বসেছিলেন। বাস থেকে নেমে আরো কিছুটা পথ ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে নবাবগঞ্জ-দোহারে রেখে এসেছিলেন ক্যানগুলো।
এমএ খায়ের জানিয়েছেন, অডিও রেকর্ডের একটি কপি তিনি কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। সেখান থেকেও রেকর্ডটি অনেকবার কপি করা হয়েছে।
এরপর নূরে আলম সিদ্দিকীরও দেখা পাই পর্দায়। তিনি তখন ছাত্রলীগের সভাপতি। ইয়াহিয়া অধিবেশন ভেস্তে দেওয়ার পর থেকেই সারা দেশ ৭ মার্চের অপেক্ষায় ছিল। জল্পনা-কল্পনা চলছিল সব মহলেই- কী বলবেন বঙ্গবন্ধু। নূরে আলম সিদ্দিকী বলছিলেন, 'আমরা তেসরা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করি। ৭ মার্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের ছাত্রনেতাদের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।'
অদ্ভুত একসময় পার করেছে বাঙালি ওই ১ থেকে ৭ মার্চের মাঝখানের দিনগুলোতে। ছাত্ররা দাবি করছিল, বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ওদিকে একটু বয়স্করা বঙ্গবন্ধুর কৌশলী হওয়ারই পক্ষে ছিলেন। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা এলে পাকবাহিনী বম্বিংও শুরু করতে পারে। ৬ মার্চ বিকালে বঙ্গবন্ধুকে খুব গম্ভীর আর শান্ত দেখাচ্ছিল। কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? কী বলবেন বাঙালির মুক্তির দূত? ওই সময় এটা গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
এর মধ্যেই পর্দায় আমরা হাজী মো. গোলাম মুরশিদ সাহেবকে দেখি। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর পিএ ছিলেন। ৩টায় ছিল সমাবেশের সময়। তবে দুপুর ১২টার আগেই লক্ষ লোক জড়ো হয়েছিল। টিভি ব্যক্তিত্ব ও তখনকার ছাত্রনেতা ম. হামিদ জানাচ্ছিলেন, ১০ লক্ষ লোক জড়ো হয়ে থাকবে ৭ মার্চের সমাবেশে। মুরশিদ সাহেব বলছিলেন, 'দুইটার দিকে আমরা ৩২ নম্বর থেকে বেড়িয়েছিলাম। গাড়ি আমিই চালাচ্ছিলাম। সাত মসজিদ রোডে বেরোনোর পর বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, কী বলবেন আজ? তিনি বললেন, আল্লাহ যা মুখ দিয়ে বের করে তা-ই বলব।'
৭ মার্চ সভামঞ্চে আওয়ামী লীগের সব নেতারাই উপস্থিত ছিলেন তবে বক্তৃতা কেবল বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট) ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী বলছিলেন, 'ভাষণটিতে আপনি সব পাবেন– সতর্কীকরণ (পাক বাহিনীকে), অসহযোগ, প্রতিরোধ, প্রত্যাখ্যান, জনগণের করণীয়, প্রশাসনের করণীয় আর শেষে আছে বিপ্লবের আহ্বান। মানে এই ভাষণটি রাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধনীতির এক অপূর্ব সমন্বয় ।'
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামও বলছিলেন, তিনি সেদিন বুঝি কেবল একজন মানুষ নন, ইতিহাসের দেবদূত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বস্তুতই তিনটি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
আমিন আহমেদ চৌধুরী আরো বলছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি– এই কথার ওপর ভর করেই কিন্তু পরের দিন মানে আট মার্চ আমি, মেজর জিয়া, কর্নেল অলি এবং কর্নেল এমআর চৌধুরী করণীয় নিয়ে স্টেডিয়ামে সভা করি।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কথা ভাবলাম। ফেনী নদীর ওপর শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে প্রতিরোধের সূচনাকেন্দ্র ভাবতে থাকি।'
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। তাই পুলিশ, বিডিআরে কর্মরত বাঙালিরাও নির্দেশনা পেয়ে গিয়েছিলেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার) ছিলেন চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর হেডকোয়ার্টারে। বলছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কথা- আমরা ছিলাম বিচ্ছিন্ন। আমাদের কাছে না ছিল কোনো রাজনৈতিক নির্দেশন, না অন্য কিছু। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বারবার শুনলাম আর বিশ্লেষণ করে বুঝলাম নির্দেশনা তো সবই এর মধ্যে দেওয়া আছে। তারপর আর প্রতিরোধ গড়তে দেরি করিনি।'
আমীরুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেছিলেন, 'আসলে ভাষণটি এক অনুপম কবিতা।'
আমিন আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, 'আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ আমরা স্কুলে পড়েছি। আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেটিকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।'
উল্লেখ্য ২০১৭ সালে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর
বাড়ি ফিরে সালাহউদ্দিন পরিবার মাটির গর্ত থেকে রেকর্ডগুলো আবার আলো বাতাসে আনেন। ধুয়ে মুছে সাফ করে সেগুলো বিক্রিও করেন। তারপর তো অডিও ক্যাসেটেরই বাজার বড় হয়ে যায়। ক্যাসেটে ধারণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ।
১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। আশির দশকের কোনো এক সময় ডিএফপি থেকে ভিডিও রেকর্ডটি পায় ফিল্ম আর্কাইভ। কিন্তু ততদিনে রিলগুলোর ওপর ধুলো জমেছিল। কোথাও কোথাও ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল ছবি। পাওয়ার পর আর্কাইভ সেগুলোর ডিউপ নেগেটিভ (অরিজিনাল নেগেটিভ থেকে কপি নেগেটিভ, মাস্টার পজিটিভ থেকেও ডিউপ নেগেটিভ হয়) করায় কিছু সংস্কার সাধন করে।
আরো অনেক পরে ২০১১ সালে আর্কাইভ একটি ডিজিটাল ট্রান্সফার মেশিন পায়। এটি আসলে একটি স্ক্যানার। ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান সিনটেলের। এ দিয়ে ৩৫ মিমির রিল থেকে স্ক্যান করে ছবি কম্পিউটারে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. রাশেদুল আলম গাজী বলছিলেন, এই স্ক্যানার দিয়ে আমরা প্রথম ট্রান্সফার করি ফতেহ লোহানীর আসিয়া ছবিটি। ওই স্ক্যানার ফ্রেম বাই ফ্রেম স্ক্যান করে। ফলে সময় লাগে অনেক বেশি। আমার মনে হয় ৭ মার্চের ভাষণও ২০১১ সালের শেষ দিকে অথচ ২০১২ সালের শুরুর দিকে স্ক্যান করেছিলাম। ভাষণের আগের ছবি দেখবেন অনেক জায়গায় ঝাপসা, অনেক ডাস্টও ছিল। আমরা সেগুলো পরিস্কার করতে পেরেছিলাম , তাই এখনকার ছবি দেখবেন বেশ ঝকঝকে। ডিজিটালি ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার পর সুবিধা হলো এডিট অপশন অনেক বেড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত ছবির ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করা যায়। ২০১৭ সালে আমরা আরো আধুনিক স্ক্যানার পেয়েছি। এটি দিয়েও আবার ৭ মার্চের স্ক্যান করেছি। অডিও ক্লিপটাও এখন অনেক পরিস্কার আর লাউড শুনতে পাবেন। আমাদের এখন ফোর কেতেও এক্সপোর্ট দেওয়ার সক্ষমতা আছে। আমাদের করা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১১.৫০ মিনিট। ডিএফপির একটি ডিভিডি আছে যার দৈর্ঘ্য ১৬ মিনিট। আমাদের থেকেই নিয়ে সরকারের আইসিটি ডিভিশন ভাষণটির রঙিন সংস্করণ তৈরি করেছে।'
সবশেষে আর্কাইভের ফিল্ম অফিসার মো. ফখরুল আলম দোতলার ফিল্ম ভল্টে নিয়ে গেলেন যেখানে মাইনাস আট ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ফিল্ম ক্যান। কবি নির্মলেন্দু গুণ এমন লিখেছেন, ওই সাত মার্চেই স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হয়েছিল।