বাংলার সমৃদ্ধি’র জন্য ২২.৮ মিলিয়ন ডলার বিমা দাবি করেছে শিপিং কর্পোরেশন
ইউক্রেনে রকেট হামলার পর পরিত্যাক্ত ঘোষিত জাহাজ 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে ২২.৮ মিলিয়ন ডলার বিমাদাবি করেছে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ।
"সকল আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন মেনেই আমরা বিমাদাবি করেছি। এখন বিমা কোম্পানি প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দাবি পরিশোধ করবে"- বলছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, যিনি বিএসসি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে গত ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর চ্যানেলে নোঙর করা অবস্থায় রকেট হামলার শিকার হয় শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ- 'বাংলার সমৃদ্ধি'।
বাণিজ্যিক এই জাহাজটি ডেনমার্কের চার্টারার ডেল্টা কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ভাড়ায় চলছিল।
মিসাইল হামলায় জাহাজটির সম্মুখ অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় আর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। এরপর জাহাজটির ২৮ জন নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। বুধবার (৯ মার্চ) তাদের দেশে ফেরার আশা করা হচ্ছে।
হামলার পর বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন দাবি করে, জয়েন্ট ওয়ার কমিটি জায়গাটি 'যুদ্ধাঞ্চল' ঘোষণার পরও ওই বন্দরে জাহাজ ছিল পাঠানো শিপিং কর্পোরেশনেরই ভুল।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো: শাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি বিষয়টি তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের আহ্বান জানান।
নাবিকদের উদ্ধারের পর জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "একটি জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তা সম্পন্ন করেই পরিত্যাক্ত করা হয়েছে।"
"জাহাজটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করলেও যুদ্ধাবস্থায় সেটি দেখাভালের জন্য কোনো ওয়াচম্যান পাওয়া যায় কিনা সেটাও খোঁজ করা হচ্ছে। যদিও এই সময় ওয়াচম্যান পাওয়া কঠিন হবে," যোগ করেন তিনি।
খালিদ মাহমুদ বলেন, কেউ কেউ বলছেন যুদ্ধাবস্থায় জাহাজটির যাওয়া ঠিক হয়নি। তবে জাহাজ পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ভুল হয়নি। কারণ যেসময় জাহাজ গেছে, ওইসময় বন্দরে প্রবেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এটা মার্চেন্ট জাহাজ হওয়ায় না যাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না।"
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ছয়টি জাহাজ ক্রয় করে, যার তিনটি অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। আর এই বাল্ক ক্যারিয়ারগুলির একটি হলো- বাংলার সমৃদ্ধি।
এই ছয়টি জাহাজ কিনতে বাংলাদেশ সরকারকে ১,৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেয় চীন, যার মেয়াদ ২০ বছর।
চীন থেকে ২০৪ কোটি টাকায় কেনার পর বাংলার সমৃদ্ধি ২০১৮ সালে শিপিং কর্পোরেশনের বহরে যুক্ত হয়।
দুটি জাহাজ আগেই কেনা হয়েছে। এর আগে বেশি পুরোনো হওয়ায় ৩৬টি জাহাজ বাদ দেয় সরকার।
শিপিং কর্পোরেশনের বহরে মোট ৮টি জাহাজ ছিল, যার মধ্যে একটি পরিত্যাক্ত ঘোষণার পর ৭টি জাহাজ অবশিষ্ট থাকল।
২০২০-২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে শিপিং কর্পোরেশনের মোট আয়ের ৭৮ শতাংশ এসেছে সর্বশেষ সংযোজিত ছয়টি জাহাজ থেকে। আর অবশিষ্ট ২১.৫৪ শতাংশ আয় এসেছে লাইটারেজ উপখাত থেকে।
২০২০-২১ অর্থবছরে জাহাজ পরিচালনা ও অন্যান্য উৎস থেকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের আয় হয় ২৪৩.০৮ কোটি টাকা। আর নীট মুনাফা দাঁড়ায় ৭২ কোটি টাকা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে শিপিং কর্পোরেশনের মুনাফা ৪০০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৬ কোটি টাকা, প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ।
মূলত, আন্তর্জাতিকভাবে জাহাজ ভাড়া বড় মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্পোরেশনের আয় ও মুনাফা দুইই বেড়েছে গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়।
জাহাজে মিসাইল হামলা পর শিপিং কর্পোরেশনের বক্তব্য:
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে হামলার পর পাঠানো ভুল ছিল– এমন অভিযোগ ওঠার পর নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।
গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি হিসাবে প্রকাশিত বিএসসির বক্তব্যে বলা হয়, আন্তজার্তিক শিপিং আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনপূর্বক সম্পাদিত চুক্তিপত্র (চার্টার পার্টি) অনুযায়ী, ডেনমার্কের চার্টারার ডেল্টা কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি অনুযায়ী জাহাজটি ভাড়ায় চলছিল।
বাংলার সমৃদ্ধি গত ২৬ জানুয়ারি মুম্বাই বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই নিয়ে তুরস্কের ইরেগলিতে পণ্য খালাস করে পূর্বনির্ধারিত ভয়েজ অর্ডার অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে পৌঁছায়। এর পরের দিন বন্দর পাইলটের মাধ্যমে একত্রে ২১টি জাহাজ কনভয় আকারে ইনার অ্যাংকরেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইউক্রেন থেকে সিরামিক ক্লে নিয়ে জাহাজটি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল। তবে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে অনতিবিলম্বে লোডিং বাতিল করে বন্দর ছেড়ে আসার জন্য মাস্টারকে নির্দেশ প্রদান করে শিপিং কর্পোরেশন।
কিন্তু অলভিয়া বন্দর কর্তৃক পাইলট সরবরাহ না করা, বন্দর পরিচালনা কার্যক্রম বন্ধ হওয়া ও বন্দর চ্যানেলে বিস্ফোরক মাইন থাকার ফলে অলভিয়া বন্দরে আটকে যায় জাহাজটি।
মিসাইলের আঘাতে জাহাজের মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (নেভিগেশন ব্রিজ) পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় ও প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
শিপিং কর্পোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) তারেক-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই বক্তব্যে বলা হয়, চার্টার প্রক্রিয়া সম্পাদনের সময় ইউক্রেনকে ট্রেডিং এরিয়ার বাইরে রাখা হয়নি।
লন্ডন জয়েন্ট ওয়ার কমিটির ১৫ ফেব্রুয়ারি আজভ সাগর এবং কৃষ্ণসাগর অঞ্চলকে যুদ্ধঝুঁকি এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে, যা ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু যুদ্ধাঞ্চল ঘোষণার আগেই জাহাজটি বন্দরে প্রবেশ করে।