দুই বছর ধরে বন্ধ ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজ, ভোগান্তিতে রাজশাহীবাসী
কয়েক দফা নকশার পরিবর্তন এবং মন্ত্রণালয় থেকে অনুুমোদন না পাওয়ায় দুই দফা কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির পরও নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ উত্তরাঞ্চলের প্রথম ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। প্রায় দুইবছর ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। কাজ বন্ধ থাকায় ফ্লাইওভারের সম্পন্ন কাজের অংশটুকুর গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, লোহাগুলোতে মরচে ধরে গেছে, নষ্ট হচ্ছে অনেক নির্মাণসামগ্রী।
পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের চার কিলোমিটার নির্মাণকাজ বাকি থাকায় এলাকাবাসী পড়েছে ব্যাপক ভোগান্তিতে। কাঁচা ও খোয়া বিছানো সড়কে ধুলায় এলাকা আচ্ছাদিত হয়ে যায়। ঘটে দুর্ঘটনা। গত পাঁচ বছর ধরে তাদের এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে দুইবছর ধরে কাজ বন্ধ থাকায় পাওনা ১১ কোটি টাকাসহ ৩০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মামলা করবে বলে জানা গেছে।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) সূত্রে জানা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কাজটি শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এর আগে ২০১৭ সালে রাজশাহীর কাটাখালীর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রকল্পের নাম 'নাটোর রোড রুয়েট হতে রাজশাহীর বাইপাস রোড পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প'। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ১৫৯ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে সংশোধিত ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ২০৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ দেওয়া ছিল ২০১৩ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। ঠিকাদারের দায়িত্বে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
নগরীর কাজলা এলাকা থেকে খড়খড়ি বাইপাস পর্যন্ত সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ৪. ৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ৮০৫ মিটার। ফ্লাইওভারটি নির্মিত হচ্ছে রেললাইনের ওপর দিয়ে। রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) উত্তর-পূর্ব দিক থেকে শুরু হয়ে রেললাইন পার হয়ে মেহেরচন্ডি পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি নির্মাণের শুরুতেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। শুরুতে নকশায় ছিল রেললাইনের ওপর ফ্লাইওভারের উচ্চতা হবে ৭ মিটার। কিন্তু কাজ শুরুর পর বাংলাদেশ রেলওয়ের দাবির কারণে ২ মিটার বাড়িয়ে উচ্চতা ৯ মিটার করা হয়। কয়েকটি খুঁটি পোঁতার পর উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আবার নকশার পরিবর্তন করা হয়। এইজন্য কাজে ধীরগতি আসে। উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ফ্লাইওভারের স্লোপিং উভয়পাশেই বেড়ে যায়। ফলে নতুনভাবে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়। কাজলা থেকে ফ্লাইওভারের সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য রুয়েট ক্যাম্পাস থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু রুয়েট প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ। এ নিয়ে কয়েক দফা মিটিংয়ের পর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মধ্যস্থতায় জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। রুয়েট কর্তৃপক্ষ কাজলা থেকে তাদের গেস্ট হাউস পর্যন্ত সীমানা প্রাচীর সরিয়ে ভেতরে নিতে সম্মত হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম শেখ জানান, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) চাহিদার কারণে জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কমিটি করা হয়। সেই কমিটির সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট সভায় পাশ হয়। সেখানে কাজলা থেকে গেস্ট হাউস পর্যন্ত সীমানা প্রাচীর সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে তা খুব বেশি না। মোট জমির পরিমাণ খাতাপত্র না দেখে বলা সম্ভব হবে। তবে জমি দিলেও রুয়েটের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ থেকে শুরু করে পানির সুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করে দিতে হবে আরডিএকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জমি অধিগ্রহণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। কাজলা এলাকায় রুয়েটের সীমানা প্রাচীরের পাশে ঝোপজঙ্গল রয়ে গেছে। রুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জমি বুঝে নেওয়া হয়নি। ফ্লাইওভারের অপর পাশে মেহেরচন্ডি এলাকাতেও যেদিক দিয়ে রাস্তা যাবে সেখানে বাড়িঘর রয়ে গেছে। এখনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া দায়রাটেক এলাকাতেও জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি।
আব্দুল মোনেম লিমিটেডের কর্মচারীরা জানান, গত দুইবছর থেকেই বলা যায় কাজ বন্ধ আছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে কাজ কিছু হলেও গত কোরবানির ঈদ থেকে সম্পূর্ণই বন্ধ রয়েছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ শরিফুল হক জানান, খাতাকলমে জমি অধিগ্রহণের কাজ হয়েছে। আগামী মাসে জমির মালিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। তবে রুয়েটের জমি অধিগ্রহণের চিঠি এখনো আরডিএ থেকে আসেনি। এটা কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার সেলিম রেজা জানান, করোনার কারণে পাঁচ থেকে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিলো। আর মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়ায় গতবছর কোরবানি ঈদের পর থেকে কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। তারপর থেকে দিনে-রাতে ২৫ জন সিকিউরিটি গার্ডের মাধ্যমে সম্পন্ন কাজটি পাহারা দিতে হচ্ছে। গত একবছর ধরে গার্ডদের বেতন দিতে হচ্ছে। এছাড়া অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হচ্ছে। আরডিএর কাছ থেকে তাদের ১১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে ৩০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলার বিষয়টি তার কর্মচারীদের কাছ থেকে জানা গেলেও তিনি তা অস্বীকার করেন।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল তারিক জানান, করোনাকালে কাজ বন্ধ থাকার কারণে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এমনিতে মেয়াদ বৃদ্ধি পায়। আর নকশার পরিবর্তনের কারণে আরেক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এই নকশার পরিবর্তনের কারণে কিছু ভেরিয়েশনের প্রয়োজন হয়। ভেরিয়েশনটা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে পারচেজ কমিটিতে উঠবে। আশা করছি অল্পসময়ের মধ্যেই কাজ শুরু করতে পারবো। এইবছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি। সম্পূর্ণ প্রকল্পের ৮২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। ইতিমধ্যে প্রথম দফায় প্রকল্পের ১৫২ কোটি টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ৩২ কোটি টাকা জিওবি ফান্ড থেকে পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় রেললাইনের ওপর দিয়ে ব্রিজ বা ফ্লাইওভার করলে ৭ মিটার ওপর দিয়ে করার নিয়ম। কিন্তু আমাদের কাজ শুরু হওয়ার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলে ৯ মিটার ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে হবে। এ কারণে পুরো নকশার পরিবর্তন ঘটে। আবার করোনার কারণে মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তারা এসে এলাকাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে গিয়ে রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেতেও দেরি হয়েছে।
এদিকে ৪.৮০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক সরেজমিনে ঘুরে এক কিলোমিটারের মতো পাকা রাস্তা পাওয়া গেছে। বাকি রাস্তার কোথাও খোয়া বিছানো, কোথাও কাঁচা। ব্যস্ততম সড়ক হওয়ায় এ সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
নগরীর দায়রাটেক এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী জানান, ২০১৮ সাল থেকে সড়কের এই বেহাল দশা। সিটি কর্পোরেশনের মধ্যকার রাস্তা অথচ দেখার কেউ নেই। সড়কে যানবাহন চলার কারণে এতো বেশি ধুলাবালি থাকে যে বাড়িঘরের দরজা জানালা খোলা যায় না। আর অসুখ-বিসুখ তো সবসময় লেগেই আছে।
খড়খড়ি বাইপাস এলাকার মোখলেসুর রহমান বলেন, আমরা এলাকাবাসী এই দুর্ভোগ আর মেনে নিতে পারছি না। এই সড়কে প্রায়ই ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটছে। কাউন্সিলর থেকে সিটি মেয়র পর্যন্ত গেছি কিন্তু চারবছর ধরে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।