হবিগঞ্জের লাখাইয়ে বাড়ছে পানি, ৬০ হেক্টর জমি নিমজ্জিত
খরা, উন্নত জাতের বীজের অভাব ও পোকার আক্রমণে বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার আশঙ্কা করছেন ভাটি এলাকার কৃষকরা। হবিগঞ্জ জেলার পাশ্ববর্তী সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে আগাম বন্যায় বোরো ফসল নষ্ট হওয়ায় খবর শুনে হবিগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যেও ভীতি দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে লাখাই উপজেলার ৬৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে হবিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল থেকে হাওড় এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। মৌসুম শুরু হলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় ধান পরিপক্ক না হওয়ায় পুরোদমে ফসল কাটা শুরু হয়নি। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত হাওড় এরাকায় ৮ হাজার ২৬০ হেক্টর এবং নন হাওড় এলাকার ৮শ ৫৬ হেক্টর জমির ফসল কাটা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলায় মোট ১লাখ ২২ হাজার ৩শ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে বানিয়াচং উপজেলায় ৩৩ হাজার ৭শ ৮৫ হেক্টর, আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ১৪ হাজার ৯শ ৯০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ১২ হাজার ৪শ হেক্টর, মাধবপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৫শ হেক্টর, চুনারুঘাট উপজেলায় ১১ হাজার হেক্টর, বাহুবল উপজেলায় ৮শ ৬শ ৩০ হেক্টর, নবীগঞ্জ উপজেলায় ১৮ হাজার ৮শ ৪৫ হেক্টর এবং লাখাই উপজেলায় ১১ হাজার ২শ ২০ হেক্টর ফসল আবাদ করা হয়েছে।
নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এটি ৭০ হেক্টর বেশি। উল্লেখিত চাষাবাদকৃত জমিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ৫ লক্ষ ২২ হাজার ১শ ৯ মেট্টিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করেছে।
লাখাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকিল খন্দকার বলেন, "ধলেশ্বরী ও সুতাং নদীতে পানি বাড়ছে গত দুদিন ধরে। সোমবার পর্যন্ত লাখাই সদর ও বামই ইউনিয়নে শিবপুর, স্বজনগ্রাম নোয়াগাও এলাকায় প্রায় ৬৫ হেক্টর বোরো জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।"
উজানে পানি বাড়তে থাকলে উপজেলার হাওড় এলাকায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। এই উপজেলায় ১১ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত প্রায় ১৬৫০ হেক্টর জমির ফসল কাটা হয়েছে।
শিবপুর গ্রামের কৃষক মোবারক মিয়া বলেন, "হঠাৎ জমিতে পানি প্রবেশ করায় কাঁচা ও আধা পাকা ধান কেটেছি। একদিকে ধানকাটা শ্রমিকের অভাব, অপরদিকে রোযা রেখে অনেকেই ধান কাটতে চান না। ছেলেমেয়ে নিয়ে এবার কী খাবো জানিনা।"
একই গ্রামের আবু তাহের বলেন, "এবার ১৬ কানি জমি চাষাবাদ করেছিলাম। ১৫ কানি জমিই পানিতে ডুবে গেছে। ১ হাজার টাকা মজুরী দিয়েও শ্রমিক পাচ্ছিনা।"
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলা বাদে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। লাখাইয়ে মূলত নদীর বাঁধের বাইরে চাষাবাদ করা জমির ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তিনি আরও জানান, চলতি বছরে হাওড় এলাকার বোরো ফসল রক্ষায় ৩১টি ডুবন্ত বাঁধ নির্মান করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ভাটি এলাকা বানিয়াচঙ্গ উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদ্মসেন সিনহা ও আজমিরিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুলতানা সালেহা সুমি দেশ জানিয়েছেন, সোমবার পর্যন্ত কোথাও হাওড়ে বন্যার পানি প্রবেশের খবর পাওয়া যায়নি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, "এখন পর্যন্ত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবং কিছুটা বৃষ্টিপাত হওয়ায় জেলায় বোরো ধানের আশাব্যঞ্জক ফলন হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের মধ্যে সরকারি প্রণোদনামূলক ভর্তুকি মুল্যে কৃষি সরঞ্জাম বিক্রি, বীজ, সার সহায়তা প্রদান করায় তা বোরো ধান চাষের সহায়ক হয়েছে।"
খোঁজ নিয়ে জানা যায় বোরো এলাকা খ্যাত বানিয়াচং আজমিরিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে ব্রাউনপ্লান হপার (বাদামী গাছ ফড়িং) নামক পোকার আক্রমণ ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে কৃষকরা নির্বিচারে কিটনাশক ছিটিয়ে দিচ্ছেন।
বানিয়াচং উপজেলার ঘোষ মহল্লার কৃষক রণরঞ্জন গোপ জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ৩০ কেদার (৮ দশমিক ৪ হেক্টর) জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। কিন্তু সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় চারা থেকে ধান বের হয়নি। সর্বশেষ, তার ধান ক্ষেতে পোকা আক্রমণ করেছে।
গত বছর ৩০ চৈত্রের মধ্যে একই পরিমাণ জমির ফসল কেটে মড়াই শেষ করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও তিনি ধান কাটা শুরু করতে পারেননি। তিনি আরো জানান, পোকার আক্রমণে এই এলাকার শতকরা দশ ভাগ ও ইঁদুরের আক্রমণে আরো ১৫ ভাগ বোরো ধান বিনষ্ট হবে।