ইভিএম চালু করতে ভারতের লেগেছিল ২৭ বছর, বাংলাদেশ কি আগামী নির্বাচনে পারবে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। বিশাল আয়তনের এই দেশটির জনসংখ্যাও অনেক, তাই ভারতের জাতীয় নির্বাচনগুলো শেষ হতে হতে কয়েক সপ্তাহ গড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ভারতের চেয়ে আয়তন ও জনসংখ্যায় বাংলাদেশ অনেক ছোট হলেও নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে দুটো দেশই প্রায় কাছাকাছি ধরনের জটিলতায় ভোগে।
ভোট গ্রহণের জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করতে ভারতের লেগেছিল ২৭ বছর। এ সহস্রাব্দের শুরু থেকেই দেশটির জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহার করা শুরু হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তারপর এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও দেশে বৃহৎ পরিসরে ইভিএম ব্যবহার এখনো তেমন আলোর মুখ দেখেনি।
১৯৫০ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইলেকশন কমিশন অভ ইন্ডিয়া; ইসিআই) গঠিত হয়। দেশটিতে সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে ইভিএম মেশিন ব্যবহার বিষয়ক ধারণার উদ্ভব ঘটে। ১৯৮২ সালে কেরালার বিধানসভার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহার করা হয়।
১৯৯৮ সালে দেশটির নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএম-এর ব্যবহার শুরু হয়। ২০০১ সালে ভারতে ইভিএম-এর ব্যবহার একটি মাইলফলকে পৌঁছায়। সেবছর তামিলনাড়ু, কেরালা, পণ্ডিচেরি, ও পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে কাগজের ব্যালট বাদ দিয়ে পুরোপুরিভাবে ইভিএম-এ নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। এরপর থেকে ভারতের সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে পুরোদস্তুরভাবে ইভিএম ব্যবহার শুরু হয়।
২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ইসিআই। ২০০৪, ২০০৯, ২০১৪, ও ২০১৯; এ চারটি লোকসভা নির্বাচনেই ইভিএম ব্যবহার করেছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সারা ভারতের প্রায় ১০ লাখ পোলিং স্টেশনে ১৪ লাখ ইভিএম ব্যবহার করা হয়। ২০১৯-এর নির্বাচনে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৮টি ভোটকেন্দ্রে সর্বমোট ৩৯ লাখ ৬০ হাজার ইভিএম ব্যবহার করেছিল ইসিআই।
ইভিএম নিয়ে ইসিআই-এর এই যাত্রা অবশ্য নিষ্কণ্টক ছিল না। ইভিএম-এর বৈধতাতে চ্যালেঞ্জ করে এক ডজেনের বেশি মামলা করা হয়। এই ভোটিং মেশিনগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়নে বেশ কয়েকটি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া এই যন্ত্রগুলো নিয়ে সন্দেহ ও ধোঁয়াশা দূর করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনেকগুলো মিটিং-এ বসতে হয়েছিল ইসিআইকে।
ইভিএম-এর গুণগত মানের ব্যাপারে বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিল ইসিআই। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছিল এ যন্ত্রকে কোনোভাবেই প্রাযুক্তিক দিক থেকে টেম্পারিং (সুবিধা গ্রহণের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতকরণ) করা সম্ভব নয়। এছাড়া কমিশন কড়া প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছিল।
এক প্রতিবেদনে ইসিআই জানিয়েছিল নির্বাচনের আগে, সময়ে, ও পরে এবং নির্মাতা কোম্পানি থেকে রাজ্য বা জেলাগুলোতে অথবা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিবহনের সময় ইভিএম মেশিনের টেম্পারিং করা সম্ভব নয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ২০১০ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তখনকার নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা'র নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন কেবল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে।
২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নির্বাচন কমিশন ইভিএমকে বেমালুম দৃশ্যপট থেকে দূর করে দেন। সেসময় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। এরপর নুরুল হুদা'র নির্বাচন কমিশন আবারও ইভিএম ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজায়। একটি আইনের সংশোধন আনার পরে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করে হুদা কমিশন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএম-এর মাধ্যমে হবে।
এদিকে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের সবগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন আয়োজন করার সক্ষমতা নেই বর্তমান কমিশনের।
মঙ্গলবার (১০ মে) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিইসি বলেন, 'ইভিএম ব্যবহার করে সব আসনে নির্বাচন করার মতো সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।'
এর আগে গতকাল সোমবার (৯ মে) নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী নির্বাচনে ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিরোধী দলগুলো এ মেশিনে জালিয়াতি করে ভোটে কারচুপির জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করায় দেশে ইভিএম পদ্ধতি কিছুটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কাছে দেড় লাখ ইভিএম আছে। এগুলোর মধ্যে ব্যবস্থাপনার অভাবে ২০ শতাংশ অকেজো হয়ে গেছে। ফলে, বর্তমানে ইসির কাছে থাকা ইভিএম দিয়ে অর্ধেক আসনেও ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
ইসি'র উপাত্ত অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ। নির্বাচন কমিশনের তথ্য থেকে জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনগুলোর সময় ৫০০ পুরুষ ভোটারের জন্য একটি বুথ, ৪০০ নারী ভোটারের জন্য একটি বুথ, ও কমপক্ষে ২৫০০০ ভোটারের জন্য একটি পোলিং স্টেশন স্থাপন করা হয়।
সে অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে আড়াই লাখের বেশি পোলিং বুথ ও প্রায় ৫০ হাজারের মতো পোলিং স্টেশন তৈরি করার প্রয়োজন হবে। সবমিলিয়ে ভোট সম্পন্ন করার জন্য তিন লাখের মতো ভোটিং মেশিনের দরকার হবে। এর বাইরে, পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মক ভোটের মাধ্যমে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য আরও দুই লাখ বাড়তি মেশিনের প্রয়োজন হবে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে ভোট সম্পন্ন করতে হলে মোটমাট সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ ইভিএম দরকার হবে।
এদিকে ইসির কাছে আছে কেবল এক লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম রয়েছে। ইভিএম ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের সংখ্যাও মাত্র ১৩ হাজার। কিন্তু সারাদেশে একযোগে ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণ করতে হলে এক লাখ দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে। আর এসবে জটিলতার সাথে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এ মেশিনগুলো সংরক্ষণ করার স্থান নির্ধারণের বিষয়টি।
তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে যে কেউই বাংলাদেশে পুরোপুরিভাবে ইভিএম বাস্তবায়ন করতে কতদিন সময় লাগবে তা নিয়ে ভেবে দেখতেই পারেন।