ফর্মাল পোশাক রপ্তানিতে চমক দেখাচ্ছে ফিনেস অ্যাপারেলস
কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার মাস চারেক আগে যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রামভিত্তিক পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ফিনেস অ্যাপারেলস। এ যাত্রায় তাদের প্রাথমিক সম্বল ছিল একটি মার্কিন ব্র্যান্ড থেকে পাওয়া কেবল একটি রপ্তানি-আদেশ।
করোনাভাইরাসের কারণে আরও অন্যান্য পোশাক কারখানার মতো কর্ণফুলি ইপিজেড-এর ফিনেস অ্যপারেলসকেও প্রায় দুই বছর উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তবে পরের বছর ফর্মাল পোশাক রপ্তানিতে চমক সৃষ্টি করে দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
'এটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত করোনা মহামারির বিশাল ধাক্কা সামাল দিয়ে এক বছরেরও কম সময়ে বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোর আস্থা অর্জন করা খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না। যা-ই হোক আমরা পেরেছি, এটাই আমাদের বড় সার্থকতা,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সাথে এক আলাপে এসব কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল মতিন।
পোশাক কারখানাটি বর্তমানে লুইস রাফায়েল, হ্যাগার ক্লোদিং, কেনেথ কোল, অ্যারো অ্যান্ড হ্যাব্যান্ড-এর মতো বিভিন্ন মার্কিন ব্র্যান্ডের কাছে ড্রেস প্যান্ট, নিটওয়্যার, এবং অন্যান্য ফর্মাল পোশাক রপ্তানি করে।
এছাড়া ফিনেস অ্যাপারেলস সুইডেন, হাঙ্গেরি, ও স্পেনের বিভিন্ন ক্রেতা এবং রেড ক্রস, দ্য হাঙ্গেরিয়ান স্টেইট রেইলওয়েজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে পোশাক সরবরাহ করে বলে জানিয়েছেন আবদুল মতিন।
পোশাক খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বে ফর্মাল পোশাকের মোট বার্ষিক বাজার প্রায় ১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ কেবল ৪৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।
বর্তমান সক্ষমতায় ফিনেস অ্যাপারেলস এ বছর ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ফর্মাল পোশাক রপ্তানি করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। 'বর্তমানে উচ্চচাহিদার বাজার পরিস্থিতিতে আমরা রপ্তানি কমপক্ষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারব বলে ধারণা করছি,' বলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল।
পোশাক কারখানাগুলোর জনপ্রিয় পোশাক হচ্ছে ড্রেস প্যান্ট যা ইউরোপ ও আমেরিকায় ফর্মাল বা আধা-ফর্মাল পোশাক হিসেবে ব্যবহার হয়। ফিনেস অ্যাপারেলস প্রতিমাসে দুই লাখ পিস ফর্মাল পোশাক তৈরি করে যার মধ্যে বেশিরভাগই ড্রেস প্যান্ট। এগুলোর রপ্তানিমূল্য মাসিক প্রায় ২০ লাখ মার্কিন ডলার। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আরও দুই লাখ পরিমাণ বিভিন্ন নিটওয়্যার যেমন ট্রাউজার, জ্যাকেট, ইউনিফর্ম ইত্যাদি তৈরি করে।
এ প্রতিষ্ঠানটি ছাড়াও দেশে আরও ১৫টির মতো পোশাক কারখানা দীর্ঘদিন ধরে ফর্মাল পোশাক তৈরি ও রপ্তানি করছে।
স্বল্পসময়ে এ সফলতার পেছনের গল্প জানাতে গিয়ে শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল বলেন, 'করোনা শুরুর পর আমরা উৎপাদন বন্ধ করলেও পরিকল্পনামাফিক সবার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যহত রাখি। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়ার কাজ চালু রাখি।
এ সময়ে কোনো শ্রমিককে আমরা ছাঁটাই করিনি। বরং জাপান, জার্মানি, ও চীন থেকে আমদানি করা সর্বাধুনিক মেশিনগুলোর সঙ্গে শ্রমিকদের পরিচিত করে তুলি। তাই পরিস্থিতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে রপ্তানি-আদেশ গ্রহণ করতে পেরেছি; মূলত এটিই স্বল্পসময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের জায়গা করে দিয়েছে।'
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মিরেজ ওয়্যার ও অ্যাকমি অ্যাপারেল নামে দু্ইটি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যবসায় শুরু করেছিলেন আবদুল মতিন। মূলত সেসব উদ্যোগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ১২৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কর্ণফুলি ইপিজেড-এ ফিনেস অ্যাপারেলস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
'দুটো প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে নতুন একটি গ্রিন ফ্যাক্টরি তৈরির সিদ্ধান্ত বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কর্মবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে টেকসই উৎপাদনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। তাই পুরো জীবনের সঞ্চয়কে বিনিয়োগ করেছি,' বলেন শেখ আবদুল মতিন।
গ্রিন ফ্যাক্টরিতে গুরুত্ব
ফিনেস অ্যাপারেলস স্বাভাবিক পানির উৎসের ওপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে। শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল বলেন, 'বর্ষামৌসুমে আমাদের ওয়াসার বিল থাকে শূন্য। বৃষ্টির পানিকে যত্নসহকারে পরিশোধন করার পর ব্যবহার করি আমরা। এমনকি কারখানার টয়লেটগুলো পানির অপচয় রোধ করতে সক্ষম করে বানানো হয়েছে।'
এ কারখানায় বয়লারে ফেলনা ঝুট পুড়িয়ে স্টিম উৎপাদন করে তা দিয়ে পোশাক ইস্ত্রি করা হয়। উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ উজাইর জানান, 'এক লাখ ৩০ হাজার বর্গফুটের এ কারখানার বেশিরভাগ অংশে বিশেষ গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে। তাপ-প্রতিরোধী এ গ্লাসের কারনে কারখানাটির ভেতরে সব সময় ঠাণ্ডা পরিবেশ বজায় থাকে।'
এছাড়া কারখানাটির ভেতরে হাঁটাচলার জন্য রয়েছে সুপ্রশস্ত করিডোর। এতে শ্রমিকেরা খোলামেলা পরিবেশে তাদের কাজ করতে পারেন।
ফিনেস অ্যাপারেলস-এর চেয়ারম্যান শেখ আবদুল মতিন জানিয়েছেন. তাদের কারখানাটি আগামী দুই বছরের মধ্যেই পুরোপুরি সৌর বিদুৎ দিয়ে পরিচালিত হবে, ইতোমধ্যে এর কাজ শুরু হয়েছে।