এবার কারিগরি শিক্ষা বিভাগ ১,৭১০ জনকে নিয়ে বিদেশ সফরে যেতে চায়
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে যখন ব্যয় সংকোচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, সেই মুহূর্তেই শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাসহ মোট ১,৭১০ জন কারিগরি শিক্ষাবিষয়ক জ্ঞান আহরণের জন্য বিদেশ সফরে যাচ্ছেন।
দেশের ৬৪টি কারিগরি স্কুলের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কারিগরি শিক্ষা ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের জন্য তারা ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইনসহ আরও কয়েকটি দেশে যেতে চান।
শুধু তা-ই নয়, এ তালিকায় আরও ৮৬ জনকে যোগ করে ২৬.৪১ কোটি টাকা বাড়তি ধরে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে আবেদন করেছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
মূল প্রকল্প অনুযায়ী, ৬৪টি কারিগরি স্কুলের ১,৬২৪ জন শিক্ষক এবং পরিকল্পনা কমিশন, আইএমইডি, প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ব্যাচে বিদেশ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৭ কোটি টাকার কিছু বেশি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা যৌক্তিভাবে কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত গ্রাহ্যই করা হয়নি সংশোধিত প্রস্তাবে।
প্রস্তাবটি আমলে নিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্প মূল্যায়ন সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশালসংখ্যক লোকের বিদেশ সফর নিয়ে ওই সভায় আপত্তি জানানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক জনশক্তিকে বিদেশ পাঠানোর যুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে পিইসি সভায় নেতৃত্ব দেওয়া পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এ বিষয়ে জানতে তিনি শিক্ষা বিভাগের উপপ্রধান সৈয়দা নুরমহল আশরাফীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
নুরমহল আশরাফী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের বিদেশ যাত্রায় শিথিলতা আরোপ করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কোনো কিছু করা সম্ভব হবে না।
এত বেশি কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের প্রস্তাবের কারণ জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক সুব্রত পাল বলেন, যৌক্তিকতা আর প্রয়োজনীয়তা বিচেনা করেই বিদেশ সফরের সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরিকল্পনা কমিশনের।
সুব্রত পাল আরও বলেন, 'প্রস্তাব পাঠানো হলেই কেউ বিদেশ চলে যেতে পারে না। পরিকল্পনা কমিশন, একনেকসহ আরও বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদনের বিষয়াদি রয়েছে।'
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, যারা বিদেশ সফরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তারা সবাই শিক্ষক হলে তা নৈতিকভাবে সঠিক।
তিনি বলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে সফরে পাঠানো অযৌক্তিক এবং জনগণের অর্থের অপচয় হবে।
তবে সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকজন শিক্ষককে বিদেশে পাঠাতে পারে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশে ফিরে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অভ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, এত বেশিসংখ্যক লোককে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো অর্থনৈতিক ও নীতিগত কোনো দিক থেকেই যৌক্তিক হতে পারে না।
তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এত শিক্ষককে বিদেশে না পাঠিয়ে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে সবাইকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
সূত্র জানায়, মূল প্রকল্পে প্রতি ব্যাচে পাঁচজন করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মোট চারটি ব্যাচ বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবে এমন ব্যাচের সংখ্যা ছয়ে উন্নীত করা হয়েছে।
ম্যানেজারিয়াল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চারটি ব্যাচ বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। প্রতি ব্যাচে ১০ জন হিসেবে মোট ৪০ জন কর্মকর্তা বিদেশ থাকবেন ১০ দিন করে। সংশোধিত প্রকল্পে এমন ব্যাচের সংখ্যা আটে উন্নীত করা হয়েছে।
তবে সংশোধিত প্রস্তাবে শিক্ষকদের ব্যাচের সংখ্যা ৭৫ থেকে কমিয়ে ৭২ করা হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য ২০ জন শিক্ষকের একেকটি ব্যাচ ১৫ দিন বিদেশে অবস্থান করবে।
২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৬৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান বাড়ানোর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনার জন্য ২০১৯ সালে সরকার ১,৪৯৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৩০ শতাংশ অগ্রগতি হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটির জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কিছুটা কমিয়ে ২৪৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা করা হয়। আগামী বছরও এ প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়লে এই অর্থছাড় করা যাবে না।