খ্যাতি ছাপিয়ে বন্ধুত্ব: চঞ্চল চৌধুরী ও তার দুই বন্ধুর অটুট বন্ধন
গত বছরের ৩১ অক্টোবর ফেসবুকে একটা সেলফি পোস্ট করেছিলেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। সেলফিতে ছিলেন তিন জন। চঞ্চল চৌধুরী ও তার দুই বন্ধু। চঞ্চল ছাড়া বাকি দুজন কোনো তারকা নন। তারা চঞ্চলের ছোটবেলার বন্ধু। গ্রামে যাদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন তিনি।
ছবির পাশে নাম লিখে দিয়েছেন এই দুই বন্ধুর। একজন তোফাজ্জল হোসেন, অন্যজন জিলহাজুর রহমান বাদশা। পেশায় দুজনই ব্যবসায়ী। পাবনার সুজানগর থানার নাজিরগঞ্জ বাজারে তাদের দোকান রয়েছে। চঞ্চল চৌধুরী গ্রামে গেলে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন। গল্পের মেতে ওঠেন। তাদের বন্ধুত্বের বয়স ৪০ বছর পার হয়েছে।
ছবিটির সূত্র ধরে এই তিন বন্ধুর সঙ্গে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিধির। তারা অকপটে শোনান শৈশবের নানা ঘটনা।
মোবাইল ফোনে কথার শুরুতেই তোফাজ্জল হোসেন জানালেন, তার মা মারা গেছেন কদিন আগে। একটা শোকগ্রস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু অভিনেতা চঞ্চলের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা তুলতেই অকপটে গল্পের ঝাপি মেলে ধরলেন। বললেন, 'সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। সহজ বাংলায় বলা যায়, ন্যাংটাকালের বন্ধু। আমরা ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় থেকে চঞ্চলের বাবার কাছে পড়তাম। তিনি স্কুল টিচার ছিলেন। ওই সময় থেকে চঞ্চল, বাদশা আর আমার বন্ধুত্ব হয়।'
'আমাদের প্রাথমিক স্কুল ছিল কামারঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমরা সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম। একসঙ্গে খেলতাম। এভাবে প্রাইমারি স্কুল পার করি। তারপর হাই স্কুলে ভর্তি হই। তখন আমাদের পাশাপাশি স্কুল। ক্লাস শেষ হলেই একসঙ্গে মাঠে ঘাটে দৌড়ে বেড়াতাম,' যোগ করেন তিনি।
নিজেদের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখতে একটা অভিনব প্রতিজ্ঞা করেন তিনজন। তারিখটা মনে আছে বাদশার। ১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তখন তারা ক্লাস এইটে পড়তেন। এক অমাবস্যার রাতে একটা বিশাল মাঠের ধারে প্রকাণ্ড এক শ্যাওড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তিন বন্ধু শপথ করেন, জীবনে যত ঝড়ঝাপ্টা আসুক, কখনো একে অপরকে ভুলে যাবেন না। তাদের বন্ধুত্ব ভাঙবেন না। সেই শপথ এখনো কার্যকর।
অবশ্য শপথ কতটা কার্যকর, সেটা পরীক্ষা করার জন্য তিন বন্ধু নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছেন ছোটবেলায়। তার দুয়েকটা উদাহরণ টেনে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, "চঞ্চল তখন থেকেই বেশ দুষ্টু। ও কাশতে কাশতে অদ্ভুত একটা প্র্যাকটিস করে ফেলে। কাশির সঙ্গে রক্ত বের করতে পারত! এটা কীভাবে করত, আমরা কেউ জানি না। তখন দেশে যক্ষ্মার খুব দাপট। একদিন আড্ডা মারতে মারতে আমাদের সামনে কাশি দিয়ে রক্ত বের করে সে। সেটা দেখিয়ে বলে, 'দোস্ত, আমার তো মনে হয় যক্ষ্মা হয়েছে, বেশিদিন বাঁচব না। তুই আমাকে বাঁচা। তোদের তো অনেক টাকা পয়সা।' আমি তখন কোনো কিছু না ভেবে ওকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেই। বলি, যত টাকা লাগে তোকে সুস্থ করে তুলব। তার কিছুক্ষণ পরেই বাদশা আর ও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। বলে, ওর যক্ষ্মা হয় নাই। এটা একটা পরীক্ষা ছিল যে, আমি জানার পর কী করি।"
এমন অসংখ্য দুষ্টমির গল্প আছে তাদের।
চঞ্চলের ছোটবেলা থেকেই গানের দারুণ গলা। সেটা এখন চঞ্চল ভক্তরা জানেন। তবে চঞ্চলের গানের প্রথম শ্রোতা ছিলেন তার এই দুই বন্ধু। তারা তাকে নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন আর গান শুনতে চাইতেন। চঞ্চলও তখন গান গেয়ে মুগ্ধ করতেন দুই বন্ধুকে।
বাদশা বললেন, 'তোফা আর চঞ্চলের বাড়ির থেকে আমার বাড়িটা একটু দূরে। কিন্তু সেটা আসলে দূর মনে হয় না। এখনো যদি চঞ্চল বাড়ি আসে, আমাদের সঙ্গে রাত ১-৩টা পর্যন্ত আড্ডা মারে। এই সময়টা আমাদের বন্ধুত্বের জন্য বরাদ্দ।'
সবশেষ কথা হয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'যখন আমাদের বন্ধুত্ব হয়, তখন পৃথিবীতে এত স্বার্থপরতা ছিল না। তাই আমাদের মধ্যে কখনো এসব ভর করেনি। আজ অবধি আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। এখনো আমি গ্রামে গেলে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিই। ওদের বাড়িতে যাই। ওরা ঢাকায় এলে আমার সঙ্গে দেখা করে। ওরা কখনো ফোন করলে সাথে সাথে ধরার চেষ্টা করি। অনেক সময় শুটিংয়ের কারণে সাথে সাথে ধরতে না পারলেও দ্রুততম সময়ে ব্যাক করি। এটাই আমাদের বন্ধুত্বের ধরন।'
'আমরা একে অপরকে সম্মান করা ও ভালোবাসার মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছি আমাদের বন্ধুত্ব। যতদিন বাঁচব, সেটা টিকিয়ে রাখব,' যোগ করেন অভিনেতা।