‘এলেই যখন, দুটো টাকা দিয়ে যাও’..ফুটপাতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য সাহায্য চাইতেন ঋত্বিক ঘটক
উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের পথিকৃৎদের মধ্যে প্রথম দিকেই মাথায় আসে ঋত্বিক ঘটকের নাম। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে তার জুড়ি মেলা ভার। সমাজের নানা অসঙ্গতি, অবস্থাপন্ন মানুষের কথা তুলে ধরেছেন তার চলচ্চিত্রে। এজন্য তাকে সিনেমার বিপ্লবীও বলা হয়।
নিজের চোখে ঘুণে ধরা সমাজের যা দেখেছেন, মানুষকে দেখাতে চেয়েছেন তার কাজের মাধ্যমে, চেয়েছেন মানুষের মধ্যে চিন্তার উদ্রেক হবে। ব্যক্তিগত জীবনে নানা প্রতিকূলতার পরও নিজের কাজের সঙ্গে, আদর্শের সঙ্গে আপোস করেননি কখনো।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমৃত্যু আমার জীবনে কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে তা অনেক আগেই করতাম এবং ভালো ছেলের মতো বেশ গুছিয়ে বসতাম। কিন্তু তা হয়ে উঠলো না, সম্ভবত হবেও না। তাতে বাঁচতে হয় বাঁচব, না হলে বাঁচব না। তবে এইভাবে শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে চাই না।'
ছাত্রজীবন থেকেই তার প্রতিবাদী সত্ত্বাকে তুলে ধরা শুরু করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ করার সময় পত্রিকায় লেখালেখির কাজ শুরু করেন, সেইসঙ্গে যুক্ত হন মঞ্চ নাটকে। মঞ্চ নাটকই হয়ে উঠেছিল তার প্রতিবাদের ভাষা।
১৯৫০ সালে 'ছিন্নমূল' চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাব তার। এ চলচ্চিত্রের গল্পটা ছিল দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় চলে আসা একদল শরণার্থী কৃষকদের নিয়ে।
তার জন্ম বাংলাদেশেই, ১৯২৫ সালের চার নভেম্বর, অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহী শহরের মিয়াঁপাড়ায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সপরিবারে কলকাতায় পাড়ি জমান তিনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নিজে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
এলেই যখন, দুটো টাকা দিয়ে যাও', বলে ঋত্বিক হাত বাড়ালেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে সুচিত্রা বললেন 'ছিঃ দাদা। এমন করে বলছেন কেন ? আমি কি দূরের কেউ ?'। বলেই কড়কড়া কয়েকটা ১০০ টাকার নোট দিলেন ঋত্বিকের হাতে ...
সাদা রংয়ের একটা এ্যাম্বাসেডরের পিছের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সুচিত্রা। তীব্র দাবদাহ, পুরা কলকাতা পুড়ছে। এ্যাম্বাসেডর পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে একটু আগাতেই ফুটপাতে একজনকে দেখে সোজা হয়ে সিটে বসলেন সুচিত্রা।
ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বলে নিজেই নেমে এগিয়ে গেলেন সেই মানুষটার দিকে। এই কাঠফাটা গরমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক।
হাত জোর করে প্রণাম করতে করতে সুচিত্রা বললেন
– আমাকে চিনতে পারছেন ঋত্বিক দা ? আমি সুচিত্রা, গত বছর শান্তিনিকেতনে দেখা হলো।
চশমার উপর দিকে তাকিয়ে ভালো করে মুখটা দেখলেন ঋত্বিক, তারপরে বললেনঃ
– ও হ্যা। তুমি সুচিত্রা রায় তো ? টালিগঞ্জ বাড়ি। অন্নদাশঙ্কর রায় তোমার কী রকম জ্যাঠা হন না ? ঠিক বলেছি তো ?
সুচিত্রা আপ্লুত হলেন। কি সৌভাগ্য! এত বড় মানুষটা সব মনে রেখেছে। সুচিত্রা কলকাতার শিল্পপ্রেমী বনেদি পরিবারের মেয়ে, জন্মের পর থেকেই কলকাতার সব মহীরুহদের সামনে দেখে বড় হয়েছেন; ইদানিং প্রায়ই বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রবন্ধনিবন্ধ লেখেন। ঋত্বিক ঘটকের মূল্য সে বোঝে।
ঋত্বিক ঘটক কে মনে মনে গুরু মানে সুচিত্রা।
ঋত্বিকদার পরনে ধুলিমলিন পাজামা-পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক মাথা এলোমেলো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা। সে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।এই জবুথবু অবস্থাতেও ঋত্বিকের চোখের আগুন একফোঁটা কমে নি, ঋত্বিক ঘটক মানেই এক আগুনের নাম। মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা-এসব ছবিগুলোয় যে আগুনের ছাপ স্পষ্ট।
সুচিত্রা খেয়াল করলেন ঋত্বিকের পিছনে একটা ব্যানারে বড় করে লেখা:
"বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দান করুন"
ব্যানারের পাশেই একটা বড় বাক্স, সেখানে রাস্তার মানুষ টাকা ফেলে যাচ্ছে।
বাক্সের পাশেই লম্বা একটি টুল। তার ওপর গিটার হাতে এক বিদেশি তরুণ বসে আছে। গায়ের রং তামাটে, হিপিদের মতো লম্বাচুল, চোখে সানগ্লাস আর মুখ ভর্তি লালচে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে ঢোলা বেলবটম প্যান্ট আর রঙ্গিন হাওয়াই শার্ট। মাথায় একটি সাদা রঙের সোলার হ্যাট।
গিটার আর মাউথ অর্গান বাজিয়ে নাকি গলায় তরুণটি গাইছে:
"Come senators, congressmen
Please heed the call
Don't stand in the doorway
Don't block up the hall"
গানটা সুচিত্রার পরিচিত, কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলানের গান। ঋত্বিক তরুণকে দেখিয়ে বললেন, ও হল স্টিভ টার্নার। গায়ক ও সাংবাদিক। সপ্তাহ খানেক হল আমেরিকা থেকে এসেছে। স্টিভ-এর সঙ্গে কবি অ্যালান গিনসবার্গও কলকাতা এসেছেন।
স্টিভকে হ্যালো বলে কৌতুহলী সুচিত্রা জানতে চাইলেন গিনসবার্গ কোথায়। ঋত্বিক বললেন,অ্যালান আজ সকালে শক্তির সঙ্গে বারাসাত শরনার্থী শিবিরে গিয়েছে।
– শক্তি ? মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ?
– হ্যা। গতকাল অবধি টাকাপয়সা যা জমেছিল তা দিয়ে ওরা ওষুধ আর খাবার কিনে নিয়ে গেল ।
ঋত্বিক সুচিত্রাকে বললেন 'এলেই যখন, দুটো টাকা দিয়ে যাও', বলে ঋত্বিক হাত বাড়ালেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে সুচিত্রা বললেন 'ছিঃ দাদা। এমন করে বলছেন কেন ? আমি কি দূরের কেউ ?'। বলেই কড়কড়া কয়েকটা ১০০ টাকার নোট দিলেন ঋত্বিকের হাতে। হঠাৎ করে ঋত্বিক সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেন:
– সুচিত্রা তুমি একসঙ্গে কত লাশ দেখেছ ? ১০০? ২০০? ৩০০? ৪০০? ৫০০? ৬০০? ৭০০? ৮০০? ৯০০?
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অদ্ভুত এক ঘোরলাগা নিয়ে সুচিত্রা আবার এ্যাম্বাসেডরে চড়ে বসলেন।
যে ভূখন্ডের অসহায় মানুষের জন্য এই পাগলাটে মানুষটা তীব্র তাপদাহে পুড়েছেন, কেঁদেছেন, চিৎকার করেছেন সেই ভূখন্ডে তো ঋত্বিকদা আর কখনোই ফিরে যাবেন না জেনেও। ঋত্বিকদারা পরিবারসহ '৪৭ সালেই এ পাড়ে চলে এসেছেন ।
তবুও … এত বড় ফিল্ম ডিরেক্টর, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, যে ঋত্বিক ঘটককে জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে তুলনা করা হয় সে মানুষটি কেমন নাওয়াখাওয়া ভুলে জ্বলন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ভিক্ষে করছেন।