জয়ল্যান্ড’র অস্কার মনোনয়নে আলোচনার কেন্দ্রে পাকিস্তানের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়
সম্প্রতি পাকিস্তানের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা জয়ল্যান্ড-এ ট্রান্সজেন্ডার চরিত্র থাকায় তা দেশটিতে সামলোচনার শিকার হয়েছে। পাকিস্তানের ১১টি রাজ্যে সাময়িক নিষেধাজ্ঞার মুখেও পড়েছিল এ সিনেমাটি। তবে অস্কারে যাওয়ার কারণে এ সিনেমার কল্যাণে দেশটির ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অস্তিত্বের দেখা মেলে সেই মোগল আমল থেকেই। তবে এত বছর পেরোলেও সমাজে এখনো নিয়মিত বৈষ্যম, ও শারীরিক-মানসিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তারা। পাকিস্তানও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশটিতে ট্রান্সজেন্ডারদের 'খোজা সিরা' বলে ডাকা হয়।
এক অসুখী বিবাহিত পুরুষ ও একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে জয়ল্যান্ড'র গল্প এগিয়ে গেছে। তরুণ পরিচালক সাইম সাদিকের এ সিনেমাটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কার জেতার পর পাকিস্তানের প্রথম সিনেমা হিসেবে অস্কারেও মনোনয়ন পায়।
মুক্তি পাওয়ার আগেই জয়ল্যান্ড সিনেমার বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হয় পাকিস্তানের প্রভাবশালী ধর্মীয় দলগুলো। দেশটির সেন্সর বোর্ড প্রথমে সিনেমাটির মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে দেশের অনেক স্থানে এটি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে এখন বেশিরভাগ স্থানে এটি দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ মাসের শুরুতে ছবিটির বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ প্রেস ক্লাবের বাইরে জামাত-ই-ইসলামি'র ছাত্র আন্দোলনের প্রায় ১০০ সদস্য 'বিদেশি ষড়যন্ত্রের' বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। সেখানে প্রতিবাদ করা অনেকেই জানিয়েছেন, এ সিনেমার মাধ্যমে পাকিস্তানকে নৈতিকভাবে দুর্বল করতে বিদেশিদের ষড়যন্ত্র চলছে।
এসব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন পাকিস্তানের সুসংহত ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির নেতারা। তারা করাচিসহ অনেকগুলো শহরে সমাবেশ করেন। তারা উল্লেখ করেন, জয়ল্যান্ড'র ওপর নিষেধাজ্ঞা এমন সময়ে দেওয়া হয়েছে যখন বিশ্ব 'ট্রান্সজেন্ডার রিমেমব্রেন্স ডে' পালন করছে।
কয়েক প্রজন্ম ধরেই পাকিস্তানের শহুরে জীবনের অংশ ট্রান্সজেন্ডাররা। জিপসিদের মতো পোশাক পরা এ ট্রান্সজেন্ডারেরা রাস্তায় ফুল বিক্রি করেন। কখনোবা ভিক্ষেও করেন। এদেরকে প্রায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ক্লাব, পুরুষদের পার্টিতে নাচার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির নেতারা বলেন, তারা অন্যদের মতোই মানুষ। তাদেরকে অন্য সব মানুষদের মতো সমান অধিকার দিতে হবে। জেন্ডার ইন্টারঅ্যাক্টিভ অ্যালায়েন্স নামক একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপের প্রধান বিনদায়া রানা বলেন, 'অনেকে বলছে আমার খারাপ বিদেশি প্রভাবকে সমাজে নিয়ে আসছি, কিন্তু আমরা এখানে আছি অনেক বছর ধরে। আমরা আমাদের নিজেদের অধিকার দাবি করছি বলে তারা ভয় পাচ্ছে।'
জয়ল্যান্ড সিনেমায় যৌনতা বা চুম্বনের কোনো দৃশ্য নেই। কিছু সেনসুয়াল নাচের দৃশ্য রাখা হয়েছে, তবে সংক্ষিপ্ত আলিঙ্গনও পাকিস্তানের নৈতিক মূল্যবোধ বিবেচনায় ও সরকারি নিয়মকানুনের জন্য ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের জনপ্রিয় ধারার সিনেমাগুলোর মতো বন্দুকবাজি, দুশ্চরিত্র, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি নেই জয়ল্যান্ড-এ।
তবে সিনেমাটি আরেকটু নিগূঢ়ভাবে ধাক্কা দিতে পারে দর্শককে। এর একঘেয়ে, দমবন্ধকরা গৃহপরিবেশ; বাচ্চাকাচ্চাদের হট্টগোল; নাকগলানো আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি উপাদানগুলো পাকিস্তানি দর্শকরা এক লহমায় নিজেদের যাপিত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবেন।
পাকিস্তানের দর্শকেরা এ ধরনের গল্প দেখতে অভ্যস্ত নন। তারা বিনোদন চান, বাস্তবতা থেকে ক্ষণিকের জন্য পালাতে চান। 'এটি একটি ভালো সিনেমা, কিন্তু এটা খুবই… ভিন্ন,' বলেন মইজেস নামক এক কলেজ শিক্ষার্থী। তার মতো অতি অল্পসংখ্যক দর্শক জয়ল্যান্ড দেখতে হলমুখো হয়েছিলেন।
তবে সিনেমাটির ওপরে কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা কিছুটা তোলার পরে ইসলামাবাদের সেন্টরাস শপিং মলে এটির প্রদর্শনে হল ভর্তি হয়ে যায়। সিনেমাটি দেখে বেশিরভাগ দর্শক প্রশংসা করেছেন।
১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী হামিদ ইলিয়াস জয়ল্যান্ড দেখার পর মন্তব্য করেন, 'এটা দারুণ একটা সিনেমা, খুব বাস্তবধর্মী। দুনিয়া বদলাচ্ছে, আর স্রেফ একটি সিনেমা আমাদের সমাজের ক্ষতি করতে বা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে না।'
পাকিস্তানের ট্রান্সজেন্ডার ও মানবাধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন, ট্রান্সজেন্ডারদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সেবাগুলো নিশ্চিত করতে অনেক বছরের প্রচেষ্টা আর আইনি লড়াইয়ের প্রয়োজন হয়েছে।
তবে দেশটিতে এখনো ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের বিবাহ করা ও নিজেদের লিঙ্গ ঘোষণার অধিকার নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি।
পাকিস্তানের একটি সংবাদপত্রে গত কয়েক সপ্তাহ আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাদিক জানিয়েছেন, তার সিনেমাটি 'কোনোভাবেই সেনসেশনাল নয়'। পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা নিয়মতি হাসিতামাশার শিকার হন উল্লেখ করে তরুণ এ নির্মাতা বলেন, 'এখনই সময় মানুষদের বিচক্ষণের মতো আচরণ করা এবং জয়ল্যান্ড'র মতো সিনেমাকে গ্রহণ করা।'