গেম অব থ্রোনসের নির্মাতারা কেন ড্রাগনের পরিবর্তে এখন এলিয়েনে ঝুঁকছেন?
বিখ্যাত লেখক লিউ সিশিনের জনপ্রিয় উপন্যাস 'থ্রি বডি প্রবলেম' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গেম অব থ্রোনস-এর পরিচালক ডেভিড বেনিওফ ও ডি. বি. ওয়েস নির্মাণ করেছেন নতুন টিভি শো 'থ্রি বডি প্রবলেম'। আগামী ২১ মার্চ জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেতে যাচ্ছে এই নতুন টিভি শো।
নতুন এই শোতে থাকছে না কোন ড্রাগন। লিউ সিশিনের ২০০৮ সালে প্রকাশিত হওয়া উপন্যাসটিতে একটি উন্নত এলিয়েন সভ্যতার কথা বলা হয়েছে যারা পৃথিবী দখল করতে চায়। এলিয়েনদের বসবাস ছিল একটি অস্থিতিশীল সৌরজগতে যেখানে তিনটি সূর্য একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করে। এখান থেকেই উপন্যাসের নাম 'থ্রি বডি প্রব্লেম'।
৫৯ টি এমি পুরস্কার জেতা ৮ সিজনের গেম অব থ্রোনস ২০১৯ সালে শেষ হয়ে যায়। তারপর বেনিওফ এবং ওয়েস ৯০ লাখ কপির বেশী বিক্রি হওয়া লিউ সিশিনের জনপ্রিয় উপন্যাসটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার কাজ শুরু করেন।
বইটিতে দুটো মূল চরিত্র আছে, একজন বিজ্ঞানী এবং একজন গোয়েন্দা যারা বুদ্ধিমত্তায় এলিয়েনদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু টিভি শো-এর নির্মাতাদের কাছে এটি যথেষ্ট মনে হয়নি।
লিউয়ের অনুমতিক্রমে চিত্রনাট্যে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। টিভি শোতে দেখা যাবে, অক্সফোর্ডের পাঁচজন বিজ্ঞানী এলিয়নদের হারানোর চেষ্টা করছেন। গেম অব থ্রোনস তারকা জন ব্রেডলিকে (স্যামওয়েল টার্লি) এই শোতে একজন ধন্যাধ্য ব্যক্তির ভূমিকায় দেখা যাবে যিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহার করে কোটি টাকার খাবারের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন।
শো-এর চরিত্রগুলো একটি বিপজ্জনক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যেখানে তিনটি বিপজ্জনক সূর্য রয়েছে। একই সময়ে পৃথিবী এলিয়েন আক্রমণের মুখোমুখি হয়। তাদের উপর নজর রাখা একজন গোয়েন্দার চরিত্রে অভিনয় করেছেন 'ডক্টর স্ট্রেঞ্জ' সিনেমায় অভিনয় করা বেনেডিক্ট ওয়াং। আর একজন সিনিয়র কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন গেম অব থ্রোনস তারকা লিয়াম কানিংহাম (দাভোস সিওয়ার্থ)।
নির্মাতা ডি. বি. ওয়েসকে বইটির জটিলতা বিস্মিত করেছে। তিনি এটিকে অভিহিত করেছেন, এমন কিছু 'যা আমরা আগে পড়িনি এবং এমন গল্প যা আগে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়নি' বলে।
লিউয়ের উপন্যাসের ভক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাকে শোতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি রাজি হননি।
ইউএসএ টুডেকে ডেভিড বেনিওফ জানিয়েছেন, "তাকে অভিনয় করতে বলা হলে তিনি একটি ছোট এবং মজার নোট পাঠিয়েছেন।"
নোটে ওবামা বলেছেন, "যদি বাস্তবেই এলিয়েনরা আক্রমণ করে তাহলে আমি সম্ভবত নিজেকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবো।"
ফ্যান্টাসি সিরিজে অনেক সাফল্যের পরেও কেন ডেভিড বেনিওফ ও ডি. বি. ওয়েস সেটি নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিলেন তা জানতে চাইলে তারা বিবিসিকে বলেছেন, সময় এসেছে নতুন কিছু করার।
গেম অব থ্রোনসের অনেক ভক্ত থাকার পরেও অনেকেই সিরিজটির চূড়ান্ত সিজন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। প্রায় ১৮ লাখ ভক্ত ২০১৯ সালে একটি পিটিশন সাইন করেছিলেন যেখানে বলা হয়েছিল, ভিন্ন চিত্রনাট্যে নতুন করে শেষ সিজন বানানো হোক।
কিন্তু দীর্ঘ ১০ বছরে সিরিজটির ৭৩টি পর্ব বানানোর পর বেনিওফ ও ওয়েস আবারো ওয়েস্টেরসের রাজ্যে ফিরে যেতে চাননি।
ওয়েস বলেছেন, "এটা আমাদের জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা ছিল।" কিন্তু তারা নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চেয়েছেন।
তার ভাষ্যমতে, থ্রি বডি প্রবলেম হলো গেম অব থ্রোনস থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেই উপলক্ষ্য।
কিন্তু তাদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল কারণ গেম অব থ্রোনস দর্শকদের প্রত্যাশা অনেকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
লিউয়ের উপন্যাস নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন আলেকজান্ডার উ। তিনি ভ্যাম্পায়ার নিয়ে বানানো টিভি সিরিজ 'ট্রু ব্লাড' এর নির্মাতা।
উ জানিয়েছেন, "এটিকে চিত্রনাট্যে রূপান্তর করা কঠিন কাজ ছিল। উপন্যাসটিতে বিভিন্ন ধারণা, চিত্র এবং গল্প ছিল। আমি ভাবতেই পারছিলাম না কীভাবে একজন লেখকের মাথায় এগুলো এসেছে।"
তারা তিনজন মিলে বিগত সাড়ে চার বছর থ্রি বডি প্রব্লেম নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের সাথে ১ হাজারের মতো ক্রু যুক্ত ছিলেন।
বইটিতে অনেক জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যা দেখানো হয়েছে যা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা কঠিন কাজ ছিল। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে সংক্ষিপ্ত জানাশোনার পাশাপাশি তাদেরকে বিজ্ঞানে পারদর্শী দুজন ব্যক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।
তারা ম্যাথিউ কিনসের সাথে কথা বলেছিলেন যিনি হিগস বসন পার্টিকেল আবিষ্কার করা দলের সদস্য ছিলেন। তারা বোবাক ফেরদৌসির সাথেও কথা বলেছেন যিনি নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।
শো-এর শুরুতেই ১৯৬৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব দেখানো হয়েছে। তারপর ঘটনা এগিয়ে স্পেনের বাদাদোজ হয়ে বর্তমানের যুক্তরাজ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে পৌঁছায়। পাশাপাশি মহাকাশেরও বেশ কিছু ঘটনা এতে দেখানো হয়েছে।
ওয়েস এবং বেনিওফ গেম অব থ্রোনসের সুবাদে যুক্তরাজ্য সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। ব্র্যাডলি, কানিংহ্যাম এবং স্যার জোনাথন প্রাইসের সাথে কাজ করার সুবাদে সিরিজটির বেশ কিছু সাবেক অভিনেতার সাথেও কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের।
ওয়েড নামের চরিত্রটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন লিয়াম কানিংহ্যাম। ধনকুবের তেল ব্যবসায়ী মাইক ইভান্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গেম অব থ্রোনসের হাই স্প্যারো চরিত্রে অভিনয় করা স্যার জোনাথন। বেনিওফ তাকে একজন 'মহান জীবন্ত অভিনেতা' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শোতে কয়েকজন শক্তিশালী এবং উজ্জ্বল নারী চরিত্র রয়েছেন যারা প্লটটিকে ধরে রাখার কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: রোজালিন্ড চাও, জেস হং, জেন সেং, ইজা গনজালেজ এবং মার্লো কেলি।
শো-এর প্রযোজকদের মধ্যে রয়েছেন ব্র্যাড পিট, সল্টবার্ন অভিনেত্রী রোসামুন্ড পাইক এবং 'নাইভস আউট' ও 'গ্লাস অনিয়ন' সিনেমার পরিচালক রায়ান জনসন।
রেবেকা বেইলি গত বছর এএফপির জন্য লিখেছিলেন, "চীনা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি মূলধারায় বিস্তারিত হয়েছে।" থ্রি বডি প্রবলেম নিতে ইতোমধ্যেই চীনে একটি ৩০ পর্বের টিভি সিরিজ বানানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, "থ্রি বডি সিরিজের বৈশ্বিক সাফল্য সবকিছুকে বদলে দিয়েছে।"
শো-এর নির্মাতারা এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করার আশা করছেন। উপন্যাসটি একটি ট্রিলজির প্রথম অংশ যার নাম 'রিমেমব্রেন্স অফ আর্থ'স পাস্ট' এবং তারা গল্পটি শেষ করতে চান৷
বেনিওফ বলেছেন, "আমি আশা করি এটি থ্রোনসের মতো বড় হবে। আমাদের লক্ষ্য তৃতীয় সিজনে যাওয়া।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়