শোলে-র 'ঠাকুর' সঞ্জীব: নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বয়স্ক চরিত্র করার ‘নেশা’ ছিল
একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে— 'যে অগ্নিশিখা যত উজ্জ্বল হয়ে পোড়ে, সেটি তত দ্রুত নিভে যায়!' বলিউড অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের জীবন যেন এ প্রবাদের আদর্শ উদাহরণ।
প্রিয়জনরা ভালোবেসে তাকে ডাকতেন হরিভাই বলে। জন্ম ১৯৩৮ সালের ৯ জুলাই। প্রয়াত হন ১৯৮৫ সালের ৬ নভেম্বর, ৪৭ বছর বয়সে। এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবনে সঞ্জীব কুমার অভিনয় করেছেন প্রায় ১৬৫টি চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে ১৫৫টি ছবি ছিল হিন্দি ভাষায়, ১০টি অন্যান্য ভাষায়।
'সঞ্জীব কুমার: দ্য অ্যাক্টর উই অল লাভড' বইয়ে একটি ঘটনা তুলে ধরেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। একবার তিনি সঞ্জীব কুমারের ম্যানেজার জামনাদাসের সঙ্গে কথা বলছিলেন। জামনাদাস বলেছিলেন, 'পরেশ, পর্দায় যদি কাউকে অমিতাভ বচ্চনের বাবা হতে হয়, তবে শুধু সঞ্জীব কুমারই হতে পারে! ও ছাড়া আর কে হবে?'
তরুণ বয়সেও প্রবীণ চরিত্রে অভিনয়ের 'নেশা' ছিল সঞ্জীব কুমারের। ব্যাপারটা রীতিমতো 'অবসেশনের' পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বহু চলচ্চিত্রে তাকে বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কাল্ট ক্লাসিক 'শোলে' (১৯৭৫), 'ত্রিশূল' (১৯৭৮), 'মওসম' (১৯৭৫), 'সওয়াল' (১৯৮২) ও 'দেবতা' (১৯৭৮)।
'শোলে'তে ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয়ের সময় সঞ্জীব কুমারের বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর। আর 'ত্রিশূল'-এ অমিতাভ বচ্চন ও শশী কাপুরের বাবার চরিত্রে অভিনয়ের সময় তার বয়স ছিল ৪০।
এই অভিনেতা কেন অল্পবয়সেই এরকম ভূরি ভূরি বয়স্ক চরিত্রে কাজ করলেন—এ প্রশ্ন জাগতেই পারে অনেকের মনে। প্রথম সারির অভিনেতারা তো এই বয়সে প্রবীণ চরিত্রে কাজ করতেই রাজি হন না।
প্রয়াত সহ-অভিনেত্রী তাবাসসুম এক পুরনো ইউটিউব ভিডিওতে বলেছিলেন, সঞ্জীব কুমারের ছিল বয়স্ক চরিত্রে অভিনয়ের নেশা।
তাবাসসুম টকিজ-এ তিনি বলেন, 'ওকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, বয়স্ক চরিত্রের প্রতি তুমি এত আসক্ত কেন? জবাবে ও বলেছিল, "তাবাসসুম, একজন গণক একবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল আমি বেশিদিন বাঁচব না। বুড়ো বয়সের অভিজ্ঞতা নেওয়ার ভাগ্য আমার হবে না। এ কারণেই আমি চলচ্চিত্রে বয়স্ক চরিত্রগুলো অভিনয় করি, যেন সেই জীবন যাপন পারি যা আমার ভাগ্যে নেই।'
সঞ্জীব কুমারের বয়স্ক চরিত্রে অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল থিয়েটারে কাজ করার সময় থেকেই।
অভিনেতা এ কে হাঙ্গল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি যখন থিয়েটারে কাজ করতাম, একদিন সঞ্জীব কুমার আমার কাছে এল কাজের জন্য। তখন আমি ওকে একটি নাটকে এক বয়স্ক লোকের চরিত্র দিয়েছিলাম। ও খুব পরিপক্ব মানুষ ছিলেন।'
সঞ্জীব কুমারের আরেক সহ-অভিনেতা সচিন পিলগাঁওকর বলেছিলেন, 'হরিভাই গুজরাটি ছিলেন। সোহরাব মোদিজির সঙ্গে গুজরাটি মঞ্চে অনেক কাজ করেছেন। তারপর আইপিটিএ-তে যোগ দেন। হিন্দি থিয়েটারে তার প্রথম চরিত্র ছিল একজন বয়স্ক মানুষের। তিনি থিয়েটার আইকন শওকত আজমির (শাবানা আজমির মা) স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সম্ভবত তখন থেকেই মানুষ ভাবতে শুরু করে, এই লোকটার বয়স বিশের কোঠায় থাকলেও বয়স্ক চরিত্রে ভালো অভিনয় করতে পারবেন।'
'ত্রিশূল' তারকা প্রবীণ চরিত্রে আসক্ত হলেও—এবং বড় বড় তারকার বিপরীতে এমন চরিত্রে সফলভাবে অভিনয় করলেও—সঞ্জীব কুমার সেই জাতের অভিনেতা হিসেবে বিবেচিত যিনি যা করতেন, তাতেই সেরা ছিলেন। 'আঙ্গুর', 'কোশিশ', 'খিলোনা', 'পতি পত্নী অউর ওহ' সিনেমা তার বহুমুখী প্রতিবার প্রমাণ।
পরেশ রাওয়ালের মতে, সঞ্জীব কুমারকে পর্দায় দেখলেই দর্শকরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। এমনই ভরসা ছিল তার অভিনয়ের ওপর।
সঞ্জীব কুমারকে তুলনা করা হতো হলিউড অভিনেতা ফিলিপ সেমোর হফম্যানের সঙ্গে। বহু পরিচালক চ্যালেঞ্জিং প্রধান চরিত্র ও চরিত্রাভিনয়ে চোখ বুজে সঞ্জীবের ওপর ভরসা করতেন।
অভিনেতা হিসেবে সঞ্জীব কুমার খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো আনকোরা কৃতিত্ব অর্জন করেন। প্রথম অভিনেতা হিসেবে তিনি ১৯৮১ সালের 'চেহরে পে চেহরা'তে হিন্দি সিনেমায় প্রোস্থেটিক মেকআপ করেছিলেন। এছাড়া প্রথম অভিনেতা হিসেবে 'নয়া দিন নয়া রাত'-এ (১৯৭৪) ৯টি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। তার সিনেমা 'আন্ধি' (১৯৭৫) ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম নিষিদ্ধ হওয়া ছবিগুলোর একটি।
সঞ্জীব কুমার জীবন যাপন করেছেন নিজের নিয়মে। চিরকুমার এই অভিনেতা ১৯৮৫ সালের ৬ নভেম্বর ৪৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।