‘চৌকিদারি’, ধনিয়া ফেরি করতেন; প্রথম ছবিতে পেয়েছেন ৫০০ রুপি; পরে তিনিই সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের অভিনেতা…
একসময় তিনি টাকার জন্য 'চৌকিদারি', অর্থাৎ নৈশপ্রহরীর কাজ করেছেন। চেহারা ও ব্যক্তিত্বের কারণে একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তবে সব বাধা পেরিয়ে আজ তিনি বলিউডের সবচেয়ে সফল ও সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের মধ্যে একজন। অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর জীবনের গল্প প্রমাণ করে, কঠোর পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
মুজাফফরনগরে জন্মগ্রহণ করা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর যৌবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন উত্তরাখণ্ডে। কেমিস্ট্রিতে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন তিনি কেমিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
তবে অভিনয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ নওয়াজউদ্দিনকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যায়। দিল্লিতে গিয়ে তিনি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় যোগ দেন। সেখানে তার অভিনয় প্রতিভা আরও বিকশিত হয়।
তবে দিল্লিতে টিকে থাকতে নওয়াজউদ্দিনকে হরেক পদের কাজ করতে হয়েছে। হিউম্যানস অব বোম্বেকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি কখনও নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন, কখনও ধনিয়া বিক্রি করেছেন টাকার জন্য।
তিনি বলেন, "অর্থনৈতিকভাবে আমি খুব ভালো অবস্থানে ছিলাম না। দুই দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিতাম। পরে অন্য কারো থেকে ধার নিয়ে প্রথমজনের টাকা ফেরত দিতাম। চারজনের সঙ্গে একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকতাম। কখনও নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে, কখনও ধনিয়া বিক্রি করে। এমনকি আমি অভিনয়ের কর্মশালাও পরিচালনা করেছি।"
অবশ্য পারিবারিকভাবে অসচ্ছল ছিলেন না নওয়াজউদ্দিন। পরিবার থেকে যাতে টাকা না নিতে হয়, সেজন্যই তিনি প্রহরীর কাজ করতেন। আরেকটি সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে নওয়াজউদ্দিন বলেন, "কারণ আমি বাড়ি থেকে টাকা নিতাম না। বাড়িতে সবসময়ই টাকা ছিল, কমবেশি পয়সা তো ছিল (মানিয়ে চলা যেত)… কিন্তু আমি আমার পরিবার থেকে টাকা নিতে চাইনি, কারণ আমি নিজের পছন্দের কাজ (অভিনয়) করছিলাম, তা-ও তাদের না জানিয়ে। বাবা-মা সবসময় আমাকে টাকা দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা বলতেন, 'কোনো সমস্যা হলে নিয়ে নে। তু তো আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকা চাইছিস না, আমরা জানিও না তুই কী করছিস।'"
'সেক্রেড গেমস' অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন। নিজের চেহারা নিয়ে নেতিবাচক কথাও শুনেছেন অনেক। গালাটা ইন্ডিয়াকে তিনি বলেন, "আমার সাথেও এমন হয়েছে। বলত, 'তোমাকে অভিনয়ে মানাচ্ছে না।' কিন্তু যখন মানুষ আমার কাজ পছন্দ হতে শুরু করল, তখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। আমি মনে করি, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ডিগ্রির চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধিই সত্যিকারের শিক্ষা।"
নওয়াজউদ্দিন আরও জানান, জীবনে তিনি বহুবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি বলেন, "হ্যাঁ, আগে এরকম অনেক হত। লোকে চেহারা নিয়ে বলত: 'কালো, রোগা, উচ্চতাও নেই'। এসব কথায় আমার খারাপ লাগেনি। বলেছি, 'হ্যাঁ, আমি সাধারণ দেখতে। তবে এই চেহারা দিয়েই আমি আপনাদের মুগ্ধ করব।' এই প্রত্যাখ্যানের কারণে আমার ভেতরে জেদ তৈরি হয়েছিল, আর আমি কাজ শুরু করি।"
নিউজ এইটিন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও নওয়াজউদ্দিন বলেছিলেন, অনেকেই তাকে আকর্ষণহীন মনে করেন; তিনি নিজেও এখন তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।
ওই সাক্ষাৎকারে এই অভিনেতা বলেন, "জানি না কিছু মানুষ আমার চেহারা এত ঘৃণা কেন করে। হয়তো আমি এতটা "বদসুরত" (কুৎসিত) বলেই। আয়নায় নিজেকে আমারও তা-ই মনে হয়। নিজেকেই প্রশ্ন করি, এত কুৎসিত চেহারা নিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এলাম কেন।'
নওয়াজউদ্দিন বলেন, 'আমি হলাম শারীরিকভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে কুৎসিত অভিনেতা। এই কথাটি আমি বিশ্বাস করি। কারণ, শুরু থেকেই এইসব কথা শুনে আসছি; এখন তা মেনে নিতেও শুরু করেছি। তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।'
নওয়াজউদ্দিনের অভিনয়জীবনের মোড় ঘুরে যায় পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের হাত ধরে। অনুরাগ এই অভিনেতাকে প্রথম দেখেন এক রেলস্টেশনে।
'আরকেজেড থিয়েটার অ্যান্ড ফিল্মস গ্রুপ'-এ পোস্ট করা এক সাক্ষাৎকারে অনুরাগের কাছে নওয়াজউদ্দিনের সঙ্গে প্রথম দেখা কীভাবে, তা জানতে চাওয়া হয়।
অনুরাগ জানান, তখন তিনি রাম গোপাল ভার্মার ১৯৯৮ সালের চলচ্চিত্র 'সত্যা'র জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই করছিলেন। এই চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, "মুম্বাইয়ে এক দারুণ অভিনেতা ছিলেন, নাম রাজপাল যাদব। মুম্বাইয়ের তো এসেছিলেন, কিন্তু হতাশায় হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি শহর ছাড়তে চেয়েছিলেন। আরেক অভিনেতা, প্রয়াত আশরাফ উলহক ছিলেন 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' ছবিতে। তিনিই আমাকে বলেন, এই ছেলেটার (রাজপাল) সাথে কথা বলে দেখ ওকে কোনো কাজ-টাজ দিতে কি না? তাই আমরা রেলস্টেশনে ওর সাথে দেখা করি। আর সেখানে তার সুটকেস বইছিল নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। সেখানেই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।'"
রাজপাল যাদবকে 'শূল' ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে কাজ দেন অনুরাগ কাশ্যপ। সেখান থেকেই রাজপালের ক্যারিয়ারের শুরু।
"নওয়াজও ছিলেন সেখানে। তিনি এসে বললেন, 'আমাকেও কি কোনো চরিত্র দেওয়া যায়?' তাকে বললাম, আর কোনো চরিত্র নেই, তবে আমি তাকে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তিনি বললেন, 'আমার কাছে খাওয়ার টাকাও নেই, আমি যেকোনো কাজ করতে রাজি। 'শূল' ছবিতে নওয়াজ একটি দৃশ্যে মনোজ ও রাভিনার সামনে একজন ওয়েটারের চরিত্রে কাজ করেন।'
'শূল'-এর পর নওয়াজউদ্দিন আমির খানের 'সারফারোশ' ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে কাজ করেন। নওয়াজ অনুরাগ কাশ্যপের পরিচালনায় প্রথমবার কাজ করেন 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' ছবিতে। এরপর সুজয় ঘোষের 'কাহানি' ছবিতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। আর অনুরাগ কাশ্যপের দুই পর্বের 'গ্যাংস অব ওয়াসিপুর' তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
বলিউডে নানা সংগ্রামের মধ্যেও নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন তারকা হিসেবে। মাঞ্ঝি: দ্য মাইন্টেইন ম্যান, গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর ২, বজরঙ্গি ভাইজান, সারফারোশ, রইস, মম-এর মতো একাধিক সফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসাধারণ অভিনয় দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদান রেখে চলেছেন।
আজ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের একজন। ছবিপ্রতি তিনি ১০ কোটি রুপি পারিশ্রমিক নেন এখন।