আফগানিস্তানে একটা মিথ্যার জন্য জীবন বলি দিয়েছি আমরা
চোখের পলকে একের পর এক পতন হলো আফগানিস্তানের শহরগুলোর। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাবুলের দখল নিয়ে নিল তালেবান।
এ খবর দেখে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি আমি। শত্রু আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। কে প্রথমে গুলি চালাবে? আমি ট্রিগার চাপি, কিন্তু ট্রিগার নড়ে না। তালেবান যোদ্ধার অস্ত্র গুলি ওগরায়। পরমুহূর্তেই ধড়মড় করে জেগে উঠি ঘুম থেকে। আফগানিস্তান থেকে ফেরার পর থেকেই এই দুঃস্বপ্ন নিয়মিত দেখি আমি। কিন্তু এবার মনে হলো স্বপ্ন নয়, ঘটনাটা সত্যি।
দুই দশকের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল মাত্র কয়েক সপ্তাহে। একটা প্রতিবেদনে দেখলাম তালেবানের প্রোপাগান্ডামূলক বিজয় প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমেরিকান দূতাবাস মার্কিন পতাকা ধ্বংস করে ফেলবে। অথচ ওই তারকাখচিত পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার সময় প্রাণ দিয়েছে আমার সাবেক পাঁচ সহকর্মী। কেন?
আমাদের সাবেক জেনারেল, সচিব ও রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, এখনও খুব একটা দেরি হয়ে যায়নি। বাড়তি সেনা পাঠালে এখনও বিজয় অর্জন সম্ভব।
কিন্তু তালেবান যে গতিতে আফগানিস্তান দখল করে নিল, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের এই বিজয় অনিবার্য। শত্রুদের দর-কষাকষির কোনো কারণ ছিল না, ছিল না সুনাম হারানোর কোনো ভয়ও।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সামনে কেবল একটাই প্রশ্ন ছিল—তালেবানরা জয়ী হওয়ার আগে কয়জন আমেরিকান সৈন্য প্রাণ হারাবে? কিন্তু এই মুহূর্তে আফগানিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত যদি আমেরিকার জন্য সঠিক হয়েও থাকে, আফগানিস্তানের মানুষের জন্য তা প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত। আফগানদের সঙ্গে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।
আফগানদের আবার তালেবানের কঠোর শাসনের মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। গত দুই দশকে যেটুকু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল, তা-ও হারাল দেশটির মানুষ। মেয়েদের জন্য স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে যাবে তারা।
কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমার পুরনো ইউনিট ফার্স্ট ব্যাটালিয়ন, এইটথ ইউনিটকে পাঠানো হয়েছে। ওদের ওপর আমার হিংসা হচ্ছে। সম্ভব হলে এখনই ওদের সঙ্গে যোগ দিতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। খবর পেয়েছি, আমাদের অবস্থান সেখানে দুর্বল হয়ে গেছে। এখন মাত্র অল্প কয়েকজন আমেরিকান অবশিষ্ট আছে দেশটিতে।
আফগানিস্তানে যা ঘটেছে, তার জন্য বারাক ওবামা থেকে শুরু করে আমাদের সেনাপ্রধানরা—সবাই দায়ী। আফগানিস্তানে একটা মিথ্যার জন্য প্রাণ দিয়েছে আমার সঙ্গীরা।
পতনটা হয়েছে একেবারে আকস্মিক। আমাদের সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও ছিল অত্যন্ত দুর্বল। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের দৃশ্য দেখে সায়গনের আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে মার্কিনীদের উদ্ধারের কথা মনে পড়ে যায়।
বড়কর্তারা বলছেন, আফগানিস্তান যুদ্ধের সমাপ্তি ১৯৭৫-এর ভিয়েতনামের মতো হবে না। আমাদের বাবা, পিতামহরা ভিয়েতনাম যুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ হারিয়েছেন। আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছে আমাদের প্রজন্মের সৈন্যরা। আমাদের সন্তানদেরও কি একই পরিণতি বরণ করতে হবে?
এ ব্যর্থতার দায় অনেকের ওপরই চাপানো যায়। এমনকি আমাদের, সৈন্যদের ওপরও দায় আসে। আমরা যদি রাজি না হতাম, তাহলে এসব যুদ্ধে লড়ার মতো কাউকে পাওয়া যেত না। আমি সেই 'তরুণ আমি'র মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। তার মুখে চড় বসিয়ে বলতে চাই, যুদ্ধে যেয়ো না। তাকে বলতে চাই, 'ওখানে গিয়ে তুমি মরবে। শারীরিক মৃত্যু হবে না, তোমার আত্মা মরে যাবে।' সারাজীবন আমি এই অনুশোচনা নিয়ে বেঁচে থাকব।
এছাড়াও এ ব্যর্থতার দায় আমার দেশের নাগরিক, রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতাদের। ২০ বছর ধরে আমেরিকানরা যেসব প্রেসিডেন্টকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করেছে, তারা ভুল নেতৃত্ব ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদেরকে পরাজয়ের দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। এই 'জাতীয় লজ্জা' আমাদের সবার জন্যই মাইলফলক।
সহসাই বাস্তবতা এসে রাঙাচ্ছে আমাদের। গোটা আফগানিস্তান আজ বিধ্বস্ত, বিপন্ন। আফগানিদের হাহাকার শুনতে পাচ্ছি আমি।
ম্যানহাটনে বসে আমেরিকান ট্র্যাজেডির অন্তিম দৃশ্য দেখছি। এখন সবাই অপেক্ষা করছি, কখন এই নাটকের পর্দা নামবে।
টিমোথি কিউডো: ইরান ও আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করা সাবেক মেরিন ক্যাপ্টেন।
[সংক্ষেপিত ভাষান্তর]
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস