ইসেগোরিয়া: কথা বলার সমান অধিকার
যদিও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন যে ক্ষুধাতুর শিশু স্বরাজ নয়, এক মুঠো ভাত আর একটু নুন চায়, তারপরও মানুষ সেই অসীম মুক্তিপিয়াসী প্রাণী যে নিতান্ত আধা-পেটা অবস্থাতেও মনের কথাটি খুলে বলতে চায়। চেক আইনবিদ কারল ভাসাক তাই আধুনিক বিশ্বের মানবাধিকারকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম প্রজন্মের মানবাধিকার বলতে তিনি বোঝান মানুষের বাক-স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ যে কোন ধর্ম গ্রহণ বা বদলানো, যে কোন রাজনৈতিক মতবাদ গ্রহণ বা বদলানোসহ ব্যক্তির মত প্রকাশের সব ধরণের মুক্তিকে এবং এর সূচনা হয়েছিল ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের মানবাধিকার বা মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকারমালা যেমন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-আশ্রয়-স্বাস্থ্যসেবা লাভের অধিকার সূচীত হয় ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের হাত ধরে। তৃতীয় প্রজন্মের মানবাধিকারের আওতায় আসছে বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রাম, জাতিসমূহের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধী যখন বৃটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ভারত এবং আফ্রিকা, ইন্দো-চীন সহ পৃথিবীর নানা দেশ যখন ১৯৪৫-এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভুবনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ শুরু করে, তখনি তৃতীয় প্রজন্মের মানবাধিকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। ১৯৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে হালের সুইডিশ কিশোরী গ্রেটার পরিবেশ রক্ষার স্বপ্নও তৃতীয় প্রজন্মের মানবাধিকারের আওতাভুক্ত।
সত্যি বলতে, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ গোটা পূর্ব ইউরোপ ব্লক নাগরিকদের জন্য ন্যূনতম অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করলেও ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর দমন-পীড়ন এই বিপুল ব্যবস্থাকে তাসের দেশের মত হুড়মুর করে ভেঙ্গে ফেলার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। তাহলে বাক-স্বাধীনতা কি? কিভাবেই বা আমরা তাকে সংজ্ঞায়িত করব?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক তেরেসা এম, বেজান আধুনিক গণতন্ত্রে বাক-স্বাধীনতা বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রাচীন গ্রিক ইতিহাস থেকে কয়েকটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করছেন। তেরেসার মতে প্রাচীন গ্রিসে বাক-স্বাধীনতা বোঝাতে দুটো শব্দ ছিল: ইসেগোরিয়া ও পারহেসিয়া। এই দুটো শব্দের ভেতর ইসেগোরিয়া ছিল প্রাচীনতর। খ্রিষ্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিক এই শব্দটির অর্থ ছিল "জনতার মাঝে কথা বলার সমান অধিকার।" গ্রিক ক্রিয়াপদ এ্যাগোরেউয়িন থেকে এ্যাগোরা বা বাজার শব্দটি এসেছে। এই এ্যাগোরা বা বাজার বা যেখানে অনেক মানুষ সমবেত হতেন, সেখানেই সক্রেটিসের মত দার্শনিকেরা বক্তৃতা দিতেন। এমন জনবহুল স্থানে সবার কথা বলার সমান অধিকারকেই বলা হতো ইসেগোরিয়া।
অন্যদিকে, গ্রিক গণতন্ত্রে এক্কেলেসিয়া বা রাজনৈতিক পরিষদের কাঠামোগত পরিসরে কথা বলার সময় কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হতো। যেমন, একজন বার্তাবাহক বলতেন, "আজ পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে কে কথা বলবে?" তখন যিনি কথা বলতে চান, তিনি বেমা বা বক্তার ডায়াসে উঠতেন কথা বলার জন্য। তুলনায় ইসেগোরিয়ায় সমাজে যে কোন স্বীকৃত, ভাল অবস্থানের এথেনীয় নাগরিক যে কোন বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিতে পারতেন এবং সতীর্থ নাগরিকদের যে কোন বিষয়ে অবস্থান নেবার আহ্বান জানাতে পারতেন। তবে, সত্যি বলতে অলঙ্কার-শাস্ত্রে দক্ষ ও বর্ষীয়ান বক্তা যারা বেমা বা ডায়াসের পাশে বসতেন, তারাই কথা বলার সুযোগ পেতেন বেশি। কারো বিরুদ্ধে পতিতা গমন এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ থাকলেই কেবল তার কথা বলার অধিকার থাকত না। যদিও প্রাচীন পৃথিবীতে এথেন্সই গণতন্ত্রের একমাত্র উদাহরণ ছিল না, তবু ইসেগোরিয়া বা সবার কথা বলার সমান অধিকার নীতির ছিল অশেষ গুরুত্ব।
ঐতিহাসিক হেরোডোটাস নিজে এথেন্সের সরকারকে "ডেমোক্রেশিয়া'' নয়, বরং "ইসেগোরিয়া''-র সরকার বলে অভিহিত করেছেন। চতুর্থ শতকের বাগ্মী এবং দেশপ্রেমিক নেতা ডেমোস্থেনেসের মতে, এথেনীয় সংবিধান ছিল "পোলিশেইয়া অঁ লোগোইস'' বা কথা বলার যুক্তির উপর ভিত্তি করে নির্মিত এবং নাগরিকেরা "ইসেগোরিয়া''কে জীবনের একটি পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তবে পুরনো অভিজাতদের ভেতর "ইসেগোরিয়া''র অনেক সমালোচনা ছিল। এক অভিজাত একবার বলেছিলেন যে এমনকি ক্রীতদাস ও বিদেশীরাও ইসেগোরিয়া নীতির কারণে কথা বলতে পারে এবং কেউ তাদের চাইলেই যে কোন জায়গায় পেটাতে পারে না। ইসেগোরিয়া নীতির আর একটি বড় দিক ছিল যে গরীবেরও এই নীতির আওতায় কথা বলার অধিকার ছিল। এথেন্স সরকার দরিদ্র মানুষেরাও যেন গণ পরিষদে কথা বলতে পারে, সেজন্য তাদের পারিশ্রমিক প্রদানেরও ব্যবস্থা করেছিল এবং এই গরীব মানুষেরা আদালতে বিচারক হিসেবেও অনেক সময় নিযুক্ত হতেন। তবে, ইসেগোরিয়া-য় সবাইকে কথা বলতে হতো ভদ্রতা ও সংযম, পরিশীলন মেনে। তুলনামলকভাবে গ্রিক পারহেসিয়া শব্দটির অর্থ হচ্ছে কাউকে আঘাত করে হলেও সত্য কথা বলার স্বাধীনতা। সততা, সত্যবাদীতার পাশপাশি একজন পারহেসিয়াস্তেস (যিনি পারহেসিয়া বা খোলাখুলি কথা বলার অনুশীলন করেন) যদি কাউকে তার বাক্যে আঘাতও করেন, সেটাও সই। সোজা বাংলায়, আজকের দিনে পত্রিকায় লেখার সময় আমরা যেমন শব্দ-চয়নে সংযত থাকি অথচ ফেসবুকে নানা অশ্লীল শব্দও অনেকে উচ্চারণ করেন তেমনটা।
পারহেসিয়ার ছিল একটি রাজনৈতিক দিকও। ডেমোস্থেনেস এবং অন্যান্য বাগ্মীরা যদিও রাজনৈতিক পরিষদেই বক্তাদের খোলাখুলি কথা বলার ডাক দিতেন, কিন্তু বক্তারা এক্কেলেসিয়া বা পরিষদের বাইরেই প্রাণ খুলে কথা বলতে স্বস্তি পেত। সেদিক থেকে থিয়েটার বা নাটক ছিল উপযুক্ত জায়গা।
এ্যারিস্টোফেনেসের মত পারহেসিয়াস্টিক বা মুক্তকণ্ঠ নাট্যকার খোদ সক্রেটিসেরও নাম ধরে ডেকে তীক্ষ্ন বক্তব্য প্রদান করেছেন। সক্রেটিস নিজেও এ্যাগোরা বা বাজারে সহ-নাগরিকদের সাথে মত বিনিময় করতেন এবং তাদের কঠিনতম সত্য উচ্চারণে প্রেরণা দিতেন। ছিলেন ছিদ্রান্বেষী দার্শনিক ডায়োজেনেসও যিনি কিনা বাজারে একটি পিপার ভেতর বাস করতেন এবং স্বয়ং আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেটকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন সূর্যালোক পাবার প্রত্যাশায়। পারহেসিয়ার এই নির্জলা, তিক্ত কথা বলার দিকটি মুগ্ধ করেছিল স্বয়ং মিশেল ফুকোকে। তবে, পারহেসিয়ার বিপজ্জনক দিক ছিল যে শ্রোতার ছিল অবাধ স্বাধীনতা। অপছন্দের বক্তাকে চেঁচিয়ে থামিয়ে দেয়া বা ডায়াস থেকে নামিয়ে দেবার ক্ষমতাও তাদের ছিল। স্বয়ং প্লেটোর ভাই গ্লাউকোনকে এমন একবার ডায়াস থেকে নামিয়ে দেয়া হয় এবং সক্রেটিসও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ভাবাবেগে আঘাত হানায় তাঁকে তো বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডই মেনে নিতে হয়। সম্ভবত: আপন ভাই ও গুরুর এই দূর্দশা দেখেই প্লেটো এবং পরে প্লেটোর শিষ্য এ্যারিস্টটল কেউই পারহেসিয়াকে পছন্দ করেননি। তবু অবাক করা বিষয় হলো এই পারহেসিয়া-ই ইসেগোরিয়া নীতির আওতায় ভদ্রভাবে কথা বলার চেয়ে বেশিদিন টেঁকে। অনেকটা হালের সংবাদপত্রের থেকে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা যেমন বেশি তেমনটাই!
পরে অবশ্য মেসিডোনিয়ান সাম্রাজ্য গ্রিক গণতন্ত্র পুরোটাই ধ্বংস করে। ধ্বংস হয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। রোমের পতনের হাজার বছর পর রেনেসাঁর মানবতাবাদীরা পারহেসিয়াকে আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত তকরতে চাইবেন যাতে করে এক ক্ষমতাশালী রাজপুত্রের সামনেও একজন কাউন্সেলর সত্য কথাটিই বলার সাহস রাখতে পারেন। ম্যাকিয়াভেলি এবং হবসের রচনায় তিতা হলেও বাস্তব কথা-বার্তা বলার যে নমুনা দেখা যায়, সেটাও এই পারহেসিয়ারই দৃষ্টান্ত। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রচারের পর যে খ্রিষ্টানরা প্রটেস্ট্যান্ট হলেন, তারা ক্যাথলিক ধর্মের অত শুচি-শুদ্ধ নিয়ম-কানুন মেনে কথা বলতে হবে না জেনে বেশ আরাম পেলেন। এভাবেই কালক্রমে বৃটেনে ১৬৮৯ সালে ইংলিশ বিল অফ রাইটস প্রণীত হয় যা সাংসদদের "আইন পরিষদে কথা বলা ও বিতর্কের স্বাধীনতা'' প্রদান করে।
স্পিনোজা এবং ইমানুয়েল কান্ট-এর মত দার্শানিকেরা "ফ্রি স্পিচ'' বলতে প্রকাশ্য বিতর্ক করার স্বাধীনতা বুঝিয়েছেন। এমনকি ফরাসী বিপ্লবের পাঁচ বছর আগেই কান্ট "বাক-স্বাধীনতা'' বলতে "ব্যক্তির যুক্তি ক্ষমতার জনপরিসরে ব্যবহার করার ক্ষমতা''-কে বুঝিয়েছেন। এর এক শতাব্দী পরে জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর "অন লিবার্টি'' প্রবন্ধে ব্যক্তির "চিন্তা ও আলাপের স্বাধীনতা''কেই বাক-স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে, মিল রাষ্ট্রের পাশাপাশি সহ নাগরিকদের "সামাজিক অত্যাচার'' থেকে ব্যক্তির কথা বলার অধিকারকেও বাক-স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত করেন।
আজকের পৃথিবীতে বাক-স্বাধীনতা বলতে যে নীতি কোন ব্যক্তির বা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির ভাবনা-চিন্তা-মতামত কোন প্রতিশোধ, সেন্সরশীপ বা আইনী ব্যবস্থার ভয় ব্যতিরেকে প্রকাশের ক্ষমতা বোঝায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১৯-এ মানুষের মতামতের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, "প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।'' তবে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার এই অনুচ্ছেদ ১৯-ই ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পটিলিক্যাল রাইটস-এ গ্রহণের সময় জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা, জন আদেশ, জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার প্রশ্নে মতামত প্রদানকারীকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে বলে কিছু সংরক্ষণ জুড়ে দেয়া হয়। মুস্কিল হচ্ছে, কঠোর সেন্সরশীপের দেশগুলো যেমন চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের "স্বর্ণ বর্ম প্রকল্প''র আওতায় ব্যক্তির যে কোন স্বাধীন মতামতকে উপরোক্ত কোন না কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করে রুদ্ধ করা হয়। একই অবস্থা উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমারের মত কঠোর, কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলোতেও জারি আছে।
এখানে উল্লেখ্য যে পৃথিবীর প্রথম "সংবাদপত্রের স্বাধীনতা' আইন ১৭৬৬ সালে সুইডেনে প্রণীত হয়- এ্যান্ডার্স শিডেনিয়াস নামে এক অস্ট্রো-বথনিয় পুরোহিতের উদ্যোগে। রাজা ও চার্চ ছাড়া আর যে কোন বিষয়ে এই আইনের আওতায় নাগরিকেরা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। ফরাসী বিপ্লবের দু'বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বাক-স্বাধীনতা আওতাভুক্ত হয়। ফরাসী বিপ্লবের সময় "দ্য ডিক্লারেশন অফ দ্য রাইটস অফ ম্যান এ্যান্ড অফ দ্য সিটিজেন"-এর ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "প্রত্যেক নাগরিকই কথা বলা, লেখা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা রাখেন। তবে এই স্বাধীনতার অপ-প্রয়োগ করলেও সেই নাগরিক আইনের আওতায় আসবেন। "বর্তমান পৃথিবীতে "জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা'' তথা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ নং ১৯, মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় সনদের অনুচ্ছেদ ১০, মানবাধিকার বিষয়ক মার্কিনী সনদের অনুচ্ছেদ ১৩ এবং মানবাধিকার ও গণ অধিকারের আফ্রিকীয় সনদের অনুচ্ছেদ ৯-এ "বাক-স্বাধীনতা''র কথা বলা হয়েছে।
এই বাক-স্বাধীনতার আওতায় মুদ্রিত বা অন্তর্জালের লেখ্য উপকরণ এবং যে কোন ধরণের শিল্প মাধ্যম পরিগণিত হয়ে থাকে।
বাক-স্বাধীনতার সাথে অন্যান্য অধিকারের সম্পর্ক
মতামতের স্বাধীনতা অনেক সময় "নিরপেক্ষ বিচারের অধিকারে''র সাথেও জড়িত বা সম্পৃক্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে অবশ্য অন্যের সম্মান ও সুনামকে ক্ষতিগ্রস্থ করা যাবে না এবং অন্যের "গোপনীয়তার অধিকার''কেও রক্ষা করতে হবে।
গণ মাধ্যমের জন্য বাক-স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিও-লিবারেল অর্থনীতিতে কর্পোরেট পুঁজির মালিকের হাতেই অনেক সময় গণ মাধ্যমের ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়। তাত্ত্বিক জুডিথ লিখটেনবুর্গ যেমন মনে করেন যে হালে দুনিয়ায় "টাকা নেই তো কথাও নেই।''
গণতন্ত্র ও সামাজিক যোগাযোগ
বাক-স্বাধীনতা যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এমনকি জরুরি অবস্থাতেও একটি মুক্ত বিতর্ক দমন করা গণতান্ত্রিক সমাজে উচিত নয়। আলেক্সান্দার মেইকলেজন গণতন্ত্র ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার আন্ত:সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন যে গণতন্ত্র হচ্ছে ব্যক্তির আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার। এমন এক ব্যবস্থাকে ভাল ভাবে কাজ করতে হলে নির্বাচক বা ভোটারদের শিক্ষিত এবং তথ্য জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। আর নাগরিকেরা যেন সব তথ্য পায়, সেজন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহে কোন বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। টমাস জে এমার্সনকে উদ্ধৃত করে এরিখ বারেন্ডেট মনে করেন যে বাক-স্বাধীনতাই হালের দুনিয়ায় সমাজে পরিবর্তন এবং স্থিতির ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখে। ব্যক্তির বাক-স্বাধীনতাই গণতান্ত্রিক সমাজের "সেফটি ভালভ।'' নয়তো কথা বলতে না পেরে মানুষ বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এমার্সন আরো মনে করেন যে "গণতান্ত্রিক সমাজে বিরোধীদলই প্রতিদিনের আমলাতান্ত্রিক অবক্ষয় থেকে আমাদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটায়।''
বিশ্ব ব্যাঙ্কের "ওয়র্ল্ড ওয়াইড গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর্স'' প্রকল্প নির্দেশ করে যে বাক-স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতাই একটি রাষ্ট্রের সরকারের গুণগত পরিমাপকের সূচক। বাক-স্বাধীনতা, স্বাধীন সংবাদপত্র সহ মোট ছয়টি সূচকের কথা এ প্রসঙ্গে বলে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। অপর এক তাত্ত্বিক রিচার্ড মুন মনে করেন যে সমাজে পরিবার, বন্ধুমহল, সহকর্মী, চার্চ বা যে কোন উপাসনাস্থলের প্রার্থনা এবং দেশবাসী সহ সবার সাথে ব্যক্তির আদান-প্রদানই বাক-স্বাধীনতার ভিত্তি।
তবে বাক-স্বাধীনতার দিগন্ত নিয়ে নানা দেশে নানা মত। কোন কোন দেশে ব্লাসফেমি একটি অপরাধ। যেমন, অস্ট্রিয়ায় ইসলামের নবীর কোন সমালোচনা "মুক্ত মত'' হিসেবে আইন দ্বারা সমর্থিত নয়, তবে ফ্রান্সে স্বীকৃত। ভারতে চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের তুলিতে দেবী সরস্বতীর ছবি নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হয় এবং প্রয়াত এ শিল্পীকে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয়েছে। সালমান রুশদি বা তসলিমা নাসরীন কি মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করেছেন কোনো, এমন জল্পনা-কল্পনা প্রায়শই আমাদের চারপাশে চলে। রাশিয়াতে আবার রাশিয়ান এলজিবিটি প্রপাগান্ডা ল সেদেশে এলজিবিটি ইস্যুতে খুব বেশি খোলা-মেলা কথা বলার বিষয়টি শর্তাধীন ও সীমিত করেছে। আবার ইউরোপের অসংখ্য দেশে মুক্ত মতের নীতি সাদরে গৃহীত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিপীড়নের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না এমন আইনও আছে। এই আইনকে বলা হয় "হলোকাস্ট ডিনায়াল।'' অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জার্মানী, হাঙ্গেরী, ইসরায়েল, লিথুয়ানিয়া, ল্যুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, স্লোভাাকিয়া, সুইজারল্যান্ড ও রোমানিয়া সহ বেশ কিছু রাষ্ট্রে হলোকাস্ট ডিনায়াল ল রয়েছে। ইউরোপের কোন কোন দেশে "আর্মেনিয়ান জেনোসাইড ডিনায়াল ল''-ও আছে।
অন্তর্জাল ও তথ্য সমাজ
ইনডেক্স অন সেন্সরশীপের সম্পাদক জো গ্লেনভিল মনে করেন যে অন্তর্জাল রাষ্ট্রীয় সেন্সরশীপ ও বাক-স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে এক বিপ্লব এনেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস অবশ্য ১৯৯৬ সালে "দ্য কম্যুনিকেশনস্ ডিসেন্সি এ্যাক্ট (সিডিএ)''-এর মাদ্যমে অন্তর্জালে বিপুল পর্ণোগ্রাফিক উপাদান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে রেনো বনাম এসিএলএই মামলায় মার্কিনী সুপ্রীম কোর্ট খানিকটা হলেও সিডিএ এ্যাক্টের বিরুদ্ধেই মতামত দেন। ভারতেও বিজেপি সরকার ২০১৫ সালে অন্তর্জালে পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণের একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। সেসময় আমি স্বাস্থ্যগত কারণে ভারতে ছিলাম। দিল্লিতে টিভিতে বিজেপি সমর্থক এক নারী সাংসদ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরিহিতা ছিলেন তবে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে পর্ণোগ্রাফির বিরুদ্ধে একটি টক-শোতে বক্তব্য দিচ্ছিলেন আর উল্টোদিকে লিবারেল কিছু ভারতীয় নর-নারী যারা পর্ণোগ্রাফির সমর্থক, তারা পশ্চিমা পোশাকে টিভি সেটে উপস্থিত ছিলেন এবং পর্ণোগ্রাফির পক্ষে বক্তব্য রাখাছিলেন। তবে, দেশে দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি ভেদে পর্ণোগ্রাফি ও নানা বিষয়েই পশ্চিমা মূল্যবোধের হুবহু বাস্তবায়ন সবাই না-ও চাইতে পারে। এটাও মাথায় রাখা দরকার।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আজকের যুগে বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্তর্জালের স্বাধীনতাও একটি বড় ইস্যু। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামে একটি সংস্থার হিসাব মতে পৃথিবীর যে দেশগুলো অন্তর্জালে সেন্সরশীপের জন্য কুখ্যাত, সেই দেশগুলোর ভেতর আছে চীন, কিউবা, ইরান, মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুর্কমেনিস্থান, উজবেকিস্থান এবং ভিয়েতনাম।
ভিন্ন মত ও সত্যের ইতিহাস
চোদ্দ শতক নাগাদ ইউরোপে ছাপাখানা বা মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর যখন অনেক ধর্মবিরোধী লেখা-পত্র মুদ্রিত হতে থাকে, তখন ক্যাথলিক চার্চ প্রথম সেন্সরশীপের দ্বারস্থ হয়। আজকের ইউরোপের অনেক দেশেই কপিরাইট আইন নামে যে আইনটি প্রচলিত, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই রোমক ক্যাথলিক চার্চ এবং সরকারগুলো কর্তৃক খ্রিষ্ট ধর্মবিরোধী প্রচারণাকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্য থেকে সূচীত হয়েছিল। যেমন, হেনরিখ ব্যান কিউয়ুক নামে এক ডাচ বিশপ ১৫৯৬ সালে ইয়োহানেস গুটেনবার্গের ছাপাখানার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ গলায় বলছেন যে সারা পৃথিবী ভয়ানক সব মিথ্যেয় ভরে যাচ্ছে আর তাই সেন্সরশীপ একান্ত দরকারী। তিনি তালমুদ, কোরান এবং মার্টিন লুথার, জাঁ ক্যালভিন ও ইরাসমুস অফ রটরড্যামের লেখার প্রকাশের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন।
আবার ১৫০১ সালে পোপ ষষ্ঠ আলেক্সান্দার "লিস্ট অফ প্রহিবিটেড বুকস''-এ ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে লেখা সব বইয়ের নাম জড়ো করেন। রোমান ইনক্যুইজিশনের সময় "ইনডেক্স এক্কসপারগেটরিয়াস''-এর আওতায় চার্চ কর্তৃপক্ষ রেনে দেকার্ত, ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি, ডেভিড হিউম, জন লক, ড্যানিয়েল ডিফো, জাঁ জ্যাঁক রুশো ও ভলতেয়ারের বই বাজেয়াপ্ত করেন। জন মিল্টন অবশ্য ১৬৪৪ সালে তাঁর বই এ্যারিওপেজিটিকা-র প্রথম পাতায় মুক্তবুদ্ধির পক্ষে প্রবল কণ্ঠস্বর তোলেন। এটা ছিল বৃটিশ সংসদের যে আইনে প্রকাশনার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ পুনরায় প্রবর্তন করা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর অবস্থান গ্রহণ। এর আগে চার্চ কর্তৃপক্ষ মিল্টনের "বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে প্রবন্ধমালা'' প্রকাশ করার অনুমতি দিতে চাচ্ছিল না। জন মিল্টনের (১৬০৮-৭৪) ধারাবাহিকতায় জন লক (১৬৩২-১৭০৪) জীবন-মুক্তি-সম্পত্তির স্বাধীনতা দাবি করেন। লক অবশ্য নাস্তিকদের অপছন্দ করতেন। ১৭ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ বারুদ স্পিনোজা এবং পীয়ের বেইলের মত বুদ্ধিজীবীরা আঠারো শতক নাগাদ ডেনিস ডিডেরোর মত চিন্তকেরা বাক-স্বাধীনতার পক্ষে বলতে শুরু করেন এবং ৪ ডিসেম্বর, ১৭৭০ সালে ডেনমার্ক-নরওয়ে বাক-স্বাধীনতার পক্ষে আইন প্রণয়ন করে। জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) বিশ্বাস করতেন যে মানুষ স্বাধীনতা না পেলে বিজ্ঞান, আইন বা রাজনীতিতে কিছুতেই উন্নতি করতে পারবে না। ভলতেয়ারের জীবনী রচনা করতে গিয়ে এভেলিন বিয়াত্রিচে হল জানান যে ভলতেয়ার বিশ্বাস করতেন: "তোমার মতামত আমি না-ও মানতে পারি, তবে সেটা রক্ষা করতে আমি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।'' কুড়ি শতকে এসে নোয়াম চমস্কি বললেন যে, "তুমি যদি বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তবে তোমার বিরুদ্ধ মতের বাক-স্বাধীনতায়ও তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। স্টালিন বা হিটলারের মত একনায়কেরা শুধু স্ব-পক্ষের বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। "লি বলিঙ্গার মনে করেন যে সহনশীলতা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত।
সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা-নাস্তিক্য-দেশদ্রোহের অভিযোগ ও সেন্সরশীপ
১৯২৮ সালে ডি.এইচ,লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লীজ লাভার প্রকাশিত হওয়ার পর লেখককে অশ্লীলতার দায়ে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই দেশগুলোর ভেতরে ছিল বৃটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে অবশ্য বইটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হতে শুরু করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসেও "ক্যাম্পে'' কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে জীবনানন্দ দাশের চাকরিচ্যূতি, 'প্রজাপতি'' ও "বিবর'' উপন্যাসের জন্য সমরেশ বসুর ও "প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'' কবিতার জন্য হাংরি প্রজন্মের কবি মলয় রায় চৌধুরীর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বা "রাত ভর বৃষ্টি'' উপন্যাসে অশ্লীলতার জন্য বুদ্ধদেব বসুর নিন্দিত হবার ঘটনা আমরা জানি। জর্জ অরওয়েল তাঁর একাধিক উপন্যাসে সমাজতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। সোভিয়েত আমালে "গুলাগ দ্বীপপুঞ্জ'' উপন্যাসের জন্য আলেক্সান্দার সোলঝেনেতসিন, "ড: জিভাগো'' উপন্যাসের জন্য বরিস পাস্তেরনাক, মরমী কবিতা লেখার দায়ে আন্না আখমাতোভা ও ওসিপ মেন্দেলস্ট্রাম বা মরমী সিনেমা বানানোর জন্য আন্দ্রেই তারকোভস্কির নিগ্রহ আমরা কম-বেশি সবাই জানি।
বাংলাদেশ: মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট কিশোর
বাংলাদেশের প্রথম কুমীর খামারের মালিক মুশতাক আহমেদ সম্প্রতি কারাগারে মারা গেছেন। এর আগে তাঁর জামিনের আবেদন ছয় বার অস্বীকৃত হয়েছিল এবং সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কার্টুনিস্ট কিশোরের বক্তব্য থেকে মোশতাক আহমেদ গুরুতর দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
কার্টুনিস্ট কিশোরের মুক্তি মোশতাকের মৃত্যুর মূল্যে হতে হল? তাই হলে গভীর বেদনার বিষয় এটা। উপরের দীর্ঘ আলোচনার আলোকে বলি আমাদের সরকারের যেমন মনে রাখা প্রয়োজন যে যাবতীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের ভেতরেও নাগরিকেরা সব ধরণের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার চাইবে, তেমনি আমাদেরও মনে রাখা প্রয়োজন যে বৈশ্বিক এই অতিমারীর সময়ে আমাদের সদ্য অর্থনৈতিক উত্থানগামী রাষ্ট্রের সব ভাল উদ্যোগের পাশে আমরাও যেন থাকি। ইসেগোরিয়া ও লগোস তথা যুক্তির সাথে, সমান অধিকার ও দায়িত্ববোধের সাথে আমরা যেন আমাদের কথাকে মুক্তি দেই।
- লেখক: কবি, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক