এ শহর তাদের আপন করে না নিলে কী হয়
অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় উপরের দিকে আছে আমাদের রাজধানী ঢাকা। মহামারি এসে এখন এই শহরটাই পুরো দেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের মূল হটস্পট রাজধানী ঢাকা। গত এক মাস ধরে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণ ছিলো, রাজধানী থেকে সারাদেশে মারাত্নক প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটি যাতে না ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে যাওয়া থেকে এই শহরের বাসিন্দাদের বিরত রাখতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার যা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মহামারির আরেকটি ঢেউ সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
চলাচলে এই বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতার এই অন্তর্নিহিত বার্তাগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য লক্ষণীয়।
এই ব্যর্থতার সাধারণ যে দিকটি সবাই দেখে তা বেশ সহজ। তা হল- লকডাউনের পরিকল্পনা এবং চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও তা প্রয়োগের বিষয়ে পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতার অভাব। এটা প্রয়োজনের সময় প্রশাসনের লোকজনের অদক্ষতার পরিচয় দেয়।
তবে যে দিকটি নিয়ে সবাই কম কথা বলে সেটি হল- সরকারের আরোপিত এই বিধিনিষেধগুলি কার্যকর করা কি আসলেই সম্ভব? এই উত্তরের পেছনে লুকিয়ে আছে আরও অনেক বৈষম্য আর ব্যর্থতার গল্প।
মানুষ যে যেভাবে পারছে এই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।
এটা কি শুধুমাত্র গ্রামে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর জন্য?
সবার ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টি তা নয়।
"শহরে এমন অনেক লোক ছিলেন যাদের এই শহরে টিকে থাকার মতো আর কোনো উপায় ছিল না কারণ এই লকডাউনে তারা তাদের চাকরি হারিয়ে ফেলেছে," বলছিলেন অর্থনীতিবিদ সায়েম হক বিদিশা।
তার বিশ্বাস, প্রচণ্ড ভীড় উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে বাস, ট্রাক কিংবা ফেরিতে করে ঘরে ফেরা এই মানুষদের ভীড় অন্তত ২৫ শতাংশ কম হতো যদি ঢাকার বস্তিগুলোতে বসবাস করা নিম্ন আয়ের মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বা খাদ্য সহায়তার আওতায় আনা যেতো।
তিনি মনে করেন, আরও ৫ শতাংশ ভীড় কমানো যেতো যদি পোশাক কারখানাগুলোতে এখনই ঈদের ছুটি না দেওয়া হতো অথবা তাদের বলা হতো ঈদে বাড়ি না গেলে আগামী মাসে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের অতিরিক্ত ছুটি দেওয়া হবে।
জীবিকার তাগিতে একসময় ঢাকা শহরে এসেছিল এই মানুষগুলো। কিন্তু মহামারি এসে জীবিকা কেড়ে নেওয়ায় এই মানুষগুলোই এখন শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এই শহর তাদের ধারণ করে না; এই শহরে কেউ নেই যারা তাদের যত্ন নেবে, তাদের ভালোবাসবে।
এই মহামারিকালেও যারা বেপরোয়া হয়ে গ্রামে-গঞ্জে নিজেদের ঠিকানায় ছুটে গেছে তারা এই দলেরই লোক- ঢাকার ভাসমান মানুষ তারা।
গতবছর লকডাউনের সময় নিজেদের কাজ হারিয়ে ফেলায় না খেয়ে থাকার শঙ্কায় এভাবেই ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল বহু মানুষ। তবে লকডাউনের শেষে তারা আবার জীবিকার তাগিতে ফিরে আসে এই শহরে। এবারও তারা একই কারণে ফিরে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা বলেন, বাসা ভাড়া, খাবারের ব্যয় এবং অন্যান্য পরিষেবাদি ঢাকার জীবনকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে এবং এ ব্যয় নির্বাহ করা স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।
তারপরেও, এই মানুষগুলো কোনো না কোনাভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য ঢাকায় ছুটে আসে। কেউ রিকশা চালায়, কেউ বাসাবাড়িতে দারোয়ানের কাজ করে আবার কেউ রান্নাবান্না, ধোয়ামোছার কাজ করে।
অপরিকল্পনা আর উন্নয়নের বৈষম্যমূলক নীতি বছরের পর বছর ধরে ঢাকাকে সবকিছুর কেন্দ্রে পরিণত করেছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে ক্ষমতা, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবই গড়ে উঠেছে এই শহরকে কেন্দ্র করে।
ফলে অন্যান্য শহরগুলো মনোযোগের বাইরেই রয়েছে গেছে এবং সেখানে জীবিকার সুযোগ সেভাবে তৈরি হয়নি।
অধ্যাপক সায়মা বলেন, "চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ঢাকাকে ঘিরে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে। যদি রাজশাহীতে নিজের জন্মশহরেই কেউ চাকরির সুযোগ পেতো তাহলে তার তো আর ঢাকায় আসার প্রয়োজন হতো না।"
কিন্তু ঢাকা শহরে বছরে বছরে সেভাবে সারা দেশ থেকে জনস্রোত ঢুকছে সেভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে শহরে অব্যাহতভাবে তৈরি হচ্ছে একের পর এক ভবন আর অবকাঠামো। এর বাইরে নগরীর ভয়াবহ যানযট ও বিপজ্জনক দূষণ তো রয়েছেই।
ঢাকার এমন অপরিকল্পিত উত্থান বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে হুমকিরূপে হাজির হয়েছে।
উন্নয়ন কৌশলবিদরা সুপরিকল্পিত, উত্পাদনশীল এবং বসবাসের যোগ্য শহরগুলিকে দারিদ্র্যের অবসানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ২০১৮ সালের এক নিবন্ধে বিশ্বব্যাংকের তিন নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যদি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে নিজেদের উন্নীত করতে চায় তবে ঢাকার আরও বেশি উত্পাদনশীল নগরী হওয়া দরকার।
একটি ব্লগ সিরিজে তারা বলেছেন, নগরের বিকাশ পরিচালনা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে ঢাকা একটি প্রাণবন্ত এবং স্থিতিস্থাপক মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। তারা বিশ্বাস করে যে ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে এবং বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সরকারের নীতিগত সহায়তা দরকার।
কেনো ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ইঞ্জিন হিসাবে কাজ করে রাজধানী ঢাকা। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে শহরটির ভূমিকার ফলে এখানে দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। যার ফলে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের নগর জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ রাজধানী ঢাকায় বাস করে। হেক্টর প্রতি ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ৪৪০ জন যা মুম্বাই, হংকং এবং করাচির মতো শহরগুলোর চেয়েও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ব্লগ সিরিজের ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৪০ টি বসবাসযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭ তম। এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো শহরের নিচেই ঢাকার অবস্থান।
ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ঢাকার মানুষের এমন নিম্নতম জীবনযাত্রা এই শহরের অসচ্ছল জনগণ, যেমন দরিদ্র, নারী এবং প্রবীণদের উপর প্রভাব ফেলছে।
সিরিজের আর একটি নিবন্ধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি দেয়। তা হল- বাসযোগ্য ঢাকার মাধ্যমেই শুরু হবে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ।
ওই নিবন্ধের লেখক হলেন জন রুমি, অ্যানি গাপিহান এবং হিউঞ্জি লি। এই লেখকরা তাদের বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে বিশ্বের কোনও দেশই এর শহরগুলির উন্নয়ন না করে মধ্যম আয়ের অবস্থায় যায়নি।
ওই নিবন্ধে তারা বলেন, "বেশিরভাগ দেশ যারা মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করেছে তখন, যখন তাদের বেশিরভাগ নাগরিক শহরে বাস করছিল এবং শহরে বাস করা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের আয়ের পরিমাণ উচ্চ পর্যায়ে ছিল।"
বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৮ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। এর অর্থ হল, দেশের শহরগুলোতে আরও বেশি লোকের প্রয়োজন যারা এই শহরগুলোকে বাসযোগ্য এবং উৎপাদনশীল করে তুলবেন।
বিশ্ব ব্যাংকের ওই ব্লগে বলা হয়, "বাংলাদেশে নগর উন্নয়নের বিষয়টি অসামঞ্জস্যপূর্ণ; এখানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের তুলনায় ঢাকার জনসংখ্যা চারগুণ। ঢাকায় রয়েছে পুরো দেশের নগরকেন্দ্রিক জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ, মোট জিডিপির পাঁচ ভাগের এক ভাগ আসে ঢাকা থেকে, মোট কর্মসংস্থানের এক তৃতীয়াংশই ঢাকায়।"
বিশ্ব ব্যাংকের দারিদ্র্য মূল্যায়নে দেখা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, ঢাকা ও চাটগ্রামের মতো শহরগুলিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধীরগতির কারণে জাতীয় দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি ধীর হয়ে গেছে। গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি এবং বিআইজিডি তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, মহামারিকালীন সময়ে আয় কমে যাওয়ায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
সানেম নামে আরেকটি গবেষণা সংস্থা কর্মসংস্থান ও আয়ের উপর মহামারির প্রভাবের সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে,
করোনার প্রথম ঢেউয়ে চাকরি হারিয়ে ৪৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল।
এদের প্রায় প্রত্যেকেই শহরে ফিরে এসে মার্চের শেষের দিকে আসা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগ পর্যন্ত নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ এসে ফের কাজ হারানোয় এখন স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং চলাচলে নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই গ্রামে ফিরে যাচ্ছে তারা।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক এ এম এম আমানত উল্লাহ খান বলেন, দক্ষ ও কার্যকরী নগর কেন্দ্রগুলি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সরাসরি যুক্ত।
"একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি শহরগুলির পরিকল্পিত এবং কার্যকরী উন্নয়নের পথ ধরেই আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রধান শহরগুলি দেখুন, আপনি দেখবেন যে কীভাবে সে সব শহরগুলি সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়েছে।"
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) এই শিক্ষক বলেন, "একটি শহরে অবশ্যই প্রাণবন্ততা থাকতে হবে, যা প্রচুর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি করে। ঢাকার পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে এ কারণেই সারা দেশের মানুষ এই শহরে ভিড় করে।"
মহাসড়ক উন্নতকরণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মতো বেশ কয়েকটি অবকাঠামোগত প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যা ঢাকা ও অন্যান্য জেলার মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করবে এবং অন্য জেলাগুলোতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এরফলে রাজধানীর উপর চাপ কমবে।
তিনি বলেন, "এই কার্যক্রমগুলি ইঙ্গিত দেয় যে আমরা সঠিক পথেই আছি। তবে চলমান প্রকল্পগুলি দ্রুত গতিতে বাস্তবায়ন করা উচিত, যাতে আগেভাগেই এই সুবিধাগুলো আমরা পাই।"
সড়ক যোগাযোগে অনেক উন্নতি হয়েছে যার ফলে এখন কুমিল্লার লোকেরা এক ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় যেতে পারে এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে পারে। কলকাতার রেল ব্যবস্থার উদ্বৃতি দিয়ে ভাড়া কমানোর পরামর্শ দিয়ে এই নগরবিদ বলেন, রেলপথগুলি একইভাবে উন্নত করা দরকার, যাতে দক্ষিণ এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে মানুষ কাজের জন্য ঢাকায় যাতায়াত করতে পারে এবং প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
"তারপরে ঢাকার জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনায় আমাদের দুটি পদ্ধতি রয়েছে- একটি দিনের সময় এবং অন্যটি রাতের সময়।"
ঢাকা ছাড়াও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী বা সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জয়পুরহাট, ফরিদপুর এমনকি ভৈরব বাজারের মতো জায়গাগুলোকেও ওইসব এলালার বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত করে তুলতে হবে।
- মূল লেখা: What happens when the city does not own you
- অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর