করোনাকালে কৃষিই বাঁচাতে পারে দেশকে
পরিসংখ্যানের হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশেই কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রার্দুভাব কমতে শুরু করলেও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। ভাইরাসটির কোনো প্রতিষেধক না থাকায় সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্বই পারে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তারকে প্রতিহত করতে। তবে করোনা মহামারী পরবর্তী বিশ্ব এক নতুন রূপ নেবে বলে অনুমান বিশ্লেষকদের। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে দেখা দেবে এক অভিনব পরিবর্তন।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান প্রদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ দেখা দেয়। ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে '২০১৯ এনসিওভি' নামকরণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তখন থেকেই রোগটির নাম হয় করোনাভাইরাস ২০১৯ (কোভিড-১৯)। করোনা হতে 'কো', ভাইরাস হতে 'ভি' এবং ডিজিজ হতে 'ডি' নিয়ে এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ 'কোভিড'। আগে এই রোগকে '২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস' বা '২০১৯- এনসিওভি' বলা হতো।
২০২০ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৮৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। এদের মাঝে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫১৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। ৪৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৪৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে এখন (২০ জুন) পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৮ হাজার ৭৭৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু ১৪০০ জন ছাড়িয়ে গেছে। আর ৪৩ হাজার ৯৯৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
করোনাভাইরাস এখন শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। লকডাউন এখন হয়ে পড়েছে প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অবস্থা। ফলে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি এক অশনী সংকেতের মুখোমুখী হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া যেখানে দু-এক সপ্তাহেই অচল হয়ে পড়ে বিশ্বের পরাশক্তিসমূহ, সেখানে মাসের পর মাস বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা নিশ্চয়ই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
মাঠের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব আন্তর্জাতিক আয়োজন, স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে কমে এসেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী চূড়ান্ত গতিশীল অর্থনীতি বোধকরি এমন ধাক্কা আর কখনো মোকাবিলা করেনি।
যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হাতছানি দিচ্ছে সেখানে বিশ্ব অর্থনীতি এমন এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে যা ভবিষ্যত অগ্রগতির পথে একটি বন্ধুর পথ তৈরি করবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি বাংলাদেশও সম্মুখীন হবে অর্থনৈতিক ক্ষতির। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোই এই মহামারীতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব বৃহৎ না হওয়ায় বিদ্যমান সংকটাবস্থায় এদের টিকে থাকার ক্ষমতা অনেক কম। বিভিন্ন অর্থনৈতিক দূর্বলতার মধ্যে চাকরি হারানোর সম্ভাবনা এবং ব্যবসায়ের ক্ষতি উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ অর্থাৎ যারা দিন আনে দিন খায় তারা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের অবস্থাও খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের জিডিপিতেও পড়বে এর প্রভাব। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপি হঠাৎ কমে গেলে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে হবে এদেরকে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানও অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা- যা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনিম্ন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের অন্যতম বাজার-দেবতা বলা যায় চীনকে। উৎপাদিত পণ্যের সিংহভাগই সরবরাহ করে থাকে চীন। অক্সফোর্ড ইকোনোমিক্সের বক্তব্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে করোনার শীতল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তির ওপর। চীনের কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর পড়তে শুরু করেছে। ফলে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে বিভিন্ন পণ্যের উপকরণ চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না এবং উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
বিনিয়োগ তহবিলের ব্যবস্থাপক ম্যাথিউ ও এশিয়ার অর্তনীতিবিদ অ্যান্ডি রটম্যান বলেছেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক তৃতীয়াংশ আসে চীন থেকে। কিন্তু করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা হবে ভয়াবহ এবং সাথে সাথে চীনের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অ্যান্ডি রটম্যানের মতামতের আলোকে বলা যায়, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবেই মন্দা দেখা দেবে। চীনের সাথে অন্যান্য যেসকল দেশের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম নিয়োজিত সেই সমস্ত দেশগুলোর অবস্থার ভয়াবহতা এখন থেকেই উপলব্ধি করা যাচ্ছে। করোনা পরবর্তী অবস্থার সাথে চীনসহ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও অন্যান্য দেশগুলোর জন্য তা খুবই কষ্টসাধ্য হবে।
করোনা বিস্তারের সাথে সাথে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিমাণও কমে যাচ্ছে কারণ বেশিরভাগ মানুষই বেকার হয়ে যাচ্ছে, বাজারব্যবস্থা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, অনেক প্রবাসীরা চাকরি হারিয়ে যার যার দেশে ফিরে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি একটি অশুভ সময়ের মধ্য দিয়ে অনিশ্চয়তার এক অতল গহ্বরে যাত্রা করতে চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিদ্রুত পরিস্থিতির মোড় না ঘুরলে হয়ত বিশ্ব ১৯৩০ সালের 'গ্রেট ডিপ্রেশন' বা মহা মন্দার জায়গায় পৌঁছে যাবে। ফলে করোনা পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই মহামন্দার চাপে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ শতাংশ শিল্প সংস্থা দেউলিয়া হতে পারে, তার সঙ্গে থাকবে অসংগতি বা ক্ষুদ্র শিল্পে কাজ হারানোর ভয়াবহ ভবিতব্য।
বাংলাদেশেও কয়েকবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং বাংলার মত এরকম দুর্ভিক্ষ তাড়িত দুর্ভাগ্য বোধহয় আর কারুরই ছিল না। এই ঘাতক দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে প্রথমটি হয় ১৭৭০ সালে (সময়টি বাংলা ১১৭৬ সাল হওয়ায় এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত হয়)। এই সময় অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সমগ্র দেশজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। তারপর ক্রমান্বয়ে ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯২, ১৮৯৭ এবং সর্বশেষ ১৯৪৩-'৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়। ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষ ছিল প্রাণঘাতী মহামারী। এই দুর্ভিক্ষকে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে অভিহিত করা হয়েছিল, কারণ এটি ১৩৫০ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হয়।
১৯৩৮ সাল থেকে কৃষি উৎপাদন কমতে থাকে। যার পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনাও দায়ী ছিলো। এই দুর্ভিক্ষে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৮১ সালে বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষের সময় ও বাংলা অঞ্চলে পর্যপ্ত খাদ্যের যোগান ছিল। যুদ্ধকালীন মুদ্রাস্ফীতি আর ফাটকা ক্রেতা ও মজুদদারদের দৌরাত্যের কারণে খাদ্যের দাম গরিব মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। ফলে অনাহার ক্লিষ্ট মানুষকে প্রাণের তাগিদে ঘাস, লতা-পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এটি ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক কৃষক তখন কয়েক মৌসুমের ফসল অগ্রীম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। খাবার ও কাজের খোঁজে মানুষ ঢাকা শহরে ছুটে আসে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি হল রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। কমে যাবে ক্রয়-বিক্রয়। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
ইতিমধ্যে করোনা সংক্রমণের হার বাংলাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে চলেছে। অর্থনৈতিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস-শিল্প ও অফিস-আদালত বন্ধ হওয়ায় মানুষের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। সে বিবেচনায় সরকার সীমিত পরিসরে অফিস আদালত, গার্মেন্টস, কল-কারখানা ও কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সচেতনতা। সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ। যা আরও ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়। সঠিক নিরাপত্তা, পরিকল্পনার অভাব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাবের ফলে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ একটি মারাত্মক দিকে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা সহজভাবে নিচ্ছে না এবং এতে আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে অর্থনীতিতে স্থবিরতার সাথে সাথে চাকরির বাজারে শুরু হয়েছে টানা পোড়েন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের কারণে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসেবে, করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারে অন্তত দেড় কোটি মানুষ। আর প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন সদস্য হলেও অন্তত ৫ কোটি মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাংক একটি পূর্বাভাসে বলেছে বাংলাদেশে এই বছর প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হতে পারে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে। তাদের হিসাব মতে, মোট তিনশো কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন চাকরি হারাবে। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সরকারি প্রাক্কলনের অর্ধেকেরও বেশি কমে ২-৩ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ অর্থ বছর ৮.২ শতাংশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলিত হিসাব মতে, করোনা মহামারীর আঘাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে। জিডিপির আকার ছিল ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে ৩ শতাংশ জিডিপি কমলে অর্থবছর শেষে জিডিপি ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম হবে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের কারণে থমকে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থায় গরিব মানুষদের পাশে দাড়ানোর আহবান জানিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউ এফপি) প্রধান ডেভিড বেসলে। বুধবার (১৫ এপ্রিল) কানাডাভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্যা গ্লোব অ্যান্ড মেইলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
জাতিসংঘ তহবিল গঠন না করলে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে এ আশঙ্কা করে তিনি দরিদ্রের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা না গেলে অন্তত তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিন মাসে দিনে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হবে বলে তিনি মনে করেন। সেজন্য করোনা মোকাবিলায় গৃহীত পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থনীতির বিষয়টা বিবেচনা করার কথাও বলেন তিনি। অনাহারে মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল জাতীয় অপুষ্টি মোকাবিলা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত গত একমাসে মারাত্বক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে- কৃষি, সেবা এবং শিল্প খাতে ভাগ করা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্প খাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান ১৪ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় সেবা খাত ও শিল্প খাত মারাত্বক ক্ষতির সম্মুখীন। তাছাড়া করোনা পরবর্তীকালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশ কর্মহারা হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। দেশে বেকারত্ব ও চাকরিচ্যুতদের চাপ তো রয়েছেই।
এমন সংকটাবস্থায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ৯২,০০০ কোটি টাকা প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এসব প্রনোদনা তখনই কাজে লাগবে যখন বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে চলবে। সরকারের নানা রকম প্রচেষ্টার পাশাপাশি যেসব কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ড আমাদেরকে এই মহামারী মোকাবিলায় সহায়তা করতে পাওে সেগুলো হচ্ছে: প্রথমত জাতীয় অপুষ্টি মোকাবিলায় সাধ্যমতো স্বল্প পরিসরে কৃষি কার্যক্রম পরিচালিত করা। যেমন- বাড়ির আঙিনায় শাক সবজি চাষ, যার মাধ্যমে লকডাউন চলাকালীন পরিবার ও প্রতিবেশীর খাদ্যাভাব পূরণ হবে।
দ্বিতীয়ত নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের আঞ্চলিক সরবরাহ নিশ্চিত করা। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কোনোভাবেই পণ্যের মজুদ না করতে পারে সেজন্য যথেষ্ট আইনী তৎপরতা অব্যাহত রাখা। এতে করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
তৃতীয়ত আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারিবারিকভাবে হাস-মুরগি পালন করা। নিম্ন আয়ের মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণের একটি উল্লেখযোগ্য খাত এটি। লকডাউনের কারণে কাজ-কর্ম বন্ধ থাকলেও শাক-সবজি ও আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য এমন কিছু খাত থাকলে অন্তত বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায়।
চতুর্থত গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল পালনের মাধ্যমে দুধের চাহিদা পূরণ হতে পারে। পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দুধ বিক্রি করে অর্থনৈতিক অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত করা যেতে পারে।
পঞ্চমত বাড়ির পাশে পুকুর, খাল-বিল বা ডোবায় স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ করেও আমিষের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবেশে নদী বা খাল-বিল, ডোবায় যেসব ছোট মাছ প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে তা আমিষের ঘাটতি পূরণে বড় অবদান রাখতে পারে।
এভাবে স্বল্পপরিসরে কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে জাতীয় অপুষ্টি মোকাবিলা করা যেতে পারে। জাতীয় অপুষ্টি মোকাবিলা করতে পারলেই করোনা প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় আমরা সক্ষম হব। যেহেতু বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং বাংলাদেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর সেহেতু কৃষিই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমরা অপুষ্টি মোকাবিলায় একবারেই অক্ষম নই। করোনা মহামারী মোকাবিলায় তাই কৃষিই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারে।
- লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল