করোনাভাইরাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক বছরের কিছু বেশি সময় অতিবাহিত করেছে। এখন করোনা আর নতুন কিছু নয়। তার 'নোভেল' চরিত্র নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ না হলেও এখন আর তা নিয়ে মানুষ কমই ভাবছে। এর নতুন রূপ বা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কথা উঠছে বটে, কিন্তু ঘুরে ফিরে করোনা একটি মহামারি ঘটানোর মতো সংক্রামক রোগ, তাতে আর কারও দ্বিমত নেই।
আমরা জানি, করোনা মানুষের শরীরে ঢুকে স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, অনেক দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু করোনার কাহিনি এখানেই শেষ নয়। আমরা মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজেকে শারীরিকভাবে করোনামুক্ত রাখতে পারি, কিন্তু করোনা মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় যে প্রভাব ফেলে, সেটা থেকে মুক্ত থাকার কোনো মাস্ক এখনো তৈরি হয়নি।
করোনার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সাথে যে লকডাউন বা সাধারণ ছুটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার সাথে সম্পৃক্ত। এতে কী ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে দেখে লকডাউন দেওয়া হবে কি না, জল্পনা-কল্পনা চলছে। এক মন্ত্রণালয়ের সাথে অন্য মন্ত্রণালয়ের ভুলবোঝাবুঝি হচ্ছে। তা হোক। সর্বশেষ যে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে চলে আসছে, তা হচ্ছে, করোনার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা শুরু না হলেও জাতিসংঘে আলোচনা শুরু হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ন্যাশনস হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ইউএনএইচসিএইচআর) সম্প্রতি বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন (A/HRC/46/19) তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ৪৬তম অধিবেশনে (২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ) উপস্থাপনের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, মহামারিতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা সমাজের সেই অংশ, যারা বিদ্যমান অসম সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধনী-গরিবের বৈষম্য, বঞ্চনার শিকার; যারা সামান্য বেঁচে থাকার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত, তাদের অবস্থাই খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। এই খারাপ হওয়া অর্থনৈতিকভাবে নয়, খারাপ হয়েছে বৈষম্য বঞ্চনার দিক থেকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমনের কারণে এমন হওয়ার কথা ছিল না। হওয়ার কারণ, এই অবস্থা আগে থেকেই ছিল এবং সেটা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগই কোনো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি, বা তারা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার একটি ধরন ছিল মানুষের এবং পণ্যের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে জীবন-জীবিকার ওপর চরম আঘাত এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান কাটতে হবে। কৃষি শ্রমিক যারা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় কাজ করেন, তারা গণপরিবহন বন্ধ থাকায় আসতে পারেননি। তারা নিজ এলাকায় না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন, অন্যদিকে কৃষক শ্রমিকের অভাবে কৃষক দ্বিগুণ দামে স্থানীয় শ্রমিক ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। এই সময়ে সরকারের দিক থেকে সাহায্য এলো কীভাবে? হার্ভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করে, যা একটি বড় কোম্পানির মেশিন বিক্রিতে সাহায্য করেছে; কিন্তু ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছেন লক্ষ লক্ষ কৃষি শ্রমিক। কৃষকের খরচও বেড়েছে। গরিব কৃষক তার ছোট জমিতে এই বিশাল মেশিন ব্যবহার করতে পারেননি। গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকদের কারখানা থেকে বার্তা পাঠিয়ে একবার ঢাকা আসতে বলা হয়েছে, শ্রমিকরা বেতন পাওয়ার জন্যে পায়ে শত শত মেইল হেঁটে চলে এসেছেন, আবার চাকুরি হারিয়ে তাদের অনেককে ফিরেও যেতে হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা চাকুরি হারিয়ে বিদেশে মাসের পর মাস না খেয়ে থেকেছেন, এবং দেশে ফিরেছেন শূন্য হাতে। আইএলও জানাচ্ছে, সারা বিশ্বে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৩ মাসে ৪৯ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, এবং বিশ্বের প্রায় অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ কাজ হারাবার ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নারী শ্রমিকরা বেশির ভাগ কাজ করছেন গার্মেন্ট সেক্টরে; তাদের কাজের অনিশ্চয়তা অনেক বেড়েছে, মজুরি বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশে করোনা মহামারিতে গার্মেন্ট শ্রমিকের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা করোনার আগেও নিয়মিত দেওয়া হতো না। বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয় তাদের। করোনার ফলে আন্তর্জাতিক অর্ডার কমে গেছে- এই দোহাই দিয়ে মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দেননি। সরকার শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করার জন্য মালিকদের যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, সেটাও শ্রমিকরা পাননি। এপ্রিল মাস থেকেই পত্র পত্রিকায় গার্মেন্টকর্মী ছাটাইয়ের খবর আসতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট মাসের মধ্যে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬৮৪ জন গার্মেন্ট শ্রমিক কাজ হারান এবং ১৯০০ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কর্মহীন শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে গিয়েও কোনো কাজ পাননি। নিজের সঞ্চিত টাকা খরচ করে এখন বেকার বসে আছেন।
নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও করুন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, প্রথম ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা, সেবা খাত এবং কৃষি শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের একটি হিসেবে দেখানো হয়েছে, সারা বিশ্বে ৮ দশমিক ৮ কোটি থেকে ১১ দশমিক ৫ কোটি মানুষ এখন অতি দারিদ্রতার শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, এই মহামারির সময়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি বিক্রি করে ও স্বাস্থ্য খাতের মাধ্যমে বিশ্বের ধনীদের ও করপোরেশনগুলোর আয় বেড়েছে। বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সাফল্য কোভিডের আগে দেখা গেলেও কোভিডের এক ধাক্কায় তা ছারখার হয়ে গেছে। প্রায় ৫ কোটি ৯৫ লক্ষ মানুষ নিজ নিজ অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে নেমে গেছেন, এদের মধ্যে ২ কোটি ৫৫ লক্ষ মানুষ অতি দরিদ্র অবস্থায় পতিত হয়েছেন। দারিদ্রতার হার বেড়েছে ২০.৫ শতাংশ থেকে ২৯.৪ শতাংশ।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যারা বেশি নিম্ন অবস্থানে আছেন, তাদের আয়ও সেভাবে আরও নিচে নেমে গেছে। যেমন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের আয় ৫ হাজার টাকার কম ছিল, তাদের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ; আর যাদের আয় ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত, তাদের আয় কমেছে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ, সমাজে ও অর্থনীতিতে বিদ্যমান বৈষম্য কোভিডের প্রভাবের সময় আরও ফুটে উঠেছে। এখানে ভাইরাসের ভূমিকা নেই; ভাইরাস যে আগেই অর্থনীতিতে ঢুকেছিল, সে মাস্কটাই খসে পড়েছে মাত্র।
ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার অবস্থাও যে খারাপ হচ্ছে, তা সহজেই বোঝা যায়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, ২০১৯ সালে ৬৯ কোটি মানুষ পুষ্টিহীন বলে গণ্য হতো; কোভিডের পর তারসঙ্গে ৮ থেকে ১৩ কোটি সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য প্রাপ্তির ব্যবস্থায় সমস্যা হয়েছে, ফলে মানুষের খাদ্য পাওয়ার সুযোগ ব্যাহত হয়েছে। যাদের আয় কমে গেছে, তারা খাদ্যের বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন। কোনোমতে পেট ভরানোর মতো করে খেয়েছেন, যা ক্ষুধা মেটালেও পুষ্টির যোগান দিতে পারেনি।
স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টটি বলছে, বিশ্বের অনেক দেশেই জনস্বাস্থ্য খাতে, বিশেষ করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার (Universal access to health care) সুযোগ সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট বিনিয়োগ হয়নি। এখনো সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পেতে হলে ৬৪ শতাংশ খরচ নিজে বহন করতে হয়। এর ফলে গরিব মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। সরকারি স্বাস্থ্য সেবার পরিমাণও দিনে দিনে কমে গিয়ে প্রাইভেট মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা বাড়ানো হয়েছে। সরকার মাত্র ৩০ শতাংশ সেবা দিচ্ছে, বাকি ৭০ শতাংশ দিচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতাল।
করোনার সময় গরিব, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তরাও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ নারী প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন; কারণ হাসপাতালগুলো করোনা ছাড়া অন্য সেবা দেয়নি। প্রাইভেট হাসপাতালেও যেকোনো রোগের চিকিৎসা করতে হলে, বিশেষ করে অপারেশন বা কাঁটা-ছেড়া করতে হলে তাকে করোনা টেস্ট করতে হয়েছে সরকারি টেস্টের দামে নয়, প্রাইভেট হাসপাতালের নিজস্ব রেটে, যা চিকিৎসা খরচ আরও তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বাড়িয়ে দেয়।
সবশেষে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিকভাবে ও দেশের ভেতর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট বলছে, ৬৭টি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে, ধনী দেশগুলো শতভাগ ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্যে বিনিয়োগ করে রেখেছে।
করোনাভাইরাসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই; কারণ এর চরিত্রে ধনী-গরিব বিভেদ ছিল না। যার শরীরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে, তাকেই আক্রান্ত করেছে। বরং করোনা ধনী দেশ ও ধনী মানুষদের মোটেও ছাড় দেয়নি; ট্রাম্প, বরিস জনসন, এঙ্গেলা মার্কেল নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছেন। ধনী দেশে মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হলেও সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ, বর্ণবাদ ইত্যাদি অমানবিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। করোনাভাইরাসের কারণে অসুস্থ হয়ে নয়; গরিব ও বঞ্চিত গোষ্ঠী ভুগছে করোনা ঠেকানোর অসম ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার কারণে। বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। এই সংকট আইসিইউ'র ব্যবস্থা করলেই সমাধান করা যাবে না, ভ্যাকসিনেও সমাধান নেই। নিতে হবে মানবিক বিচারে মানুষের কর্মসংস্থানের ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে সব তথ্য নেই হয়তো, কিন্তু যতটুকুই আছে, তা নিয়েই সরকার তৎপর হতে পারে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের কাজে এই বিষয় যুক্ত করতে পারে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী