খেলোয়াড় পরিচয় ছাপিয়ে ত্বকের রঙ যখন বড় হয়ে ওঠে
২০১৭ সালে, আমার যখন ২৪ বছর বয়স, দুটি ঘটনা ঘটল। আমি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে পাড়ি জমালাম এবং আমার বাবা মারা গেলেন।
আমার কাছে নিজের ঘর বলে এতকাল চেনা ছিল যা কিছু, সব মিলিয়ে গেল। অথৈ সাগরে নোঙ্গরহীন তরীর মতো অনুভব করলাম নিজেকে। আমার ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটতে পারে, এমন এক তীব্র ভয় মনে বাসা বাঁধতে শুরু করল।
সেই ভয় এখনো আছে। কোনো অপ্রত্যাশিত সময়ে মায়ের ফোন-কল পেলেই ধরে নিই, পরিবারের কারও ব্যাপারে খারাপ কোনো খবর পাব। প্রেমিকের ফ্লাইট দেরি হলেই মনে হয়, ওর কণ্ঠস্বর আর কখনো শুনতে পাব না। খুব খারাপ কিছু আন্দাজ করে নিই।
মৃত্যুভয়ে ভয়ানক ভীত আমি। যাদের ভালোবাসি, তারা চিরতরে চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো 'বিদায়' বলারও সুযোগ পাব না, মাঝে মধ্যে এই আশঙ্কা আমাকে কুঁকড়ে ফেলে।
নিরন্তর এই উৎকণ্ঠার সঙ্গেই বসবাস আমার। ভাবুন তো, দৌড়াতে যাওয়া আপনার ভাইটি কিংবা কেনাকাটা করতে যাওয়া আপনার বাবা আর কোনোদিনই ঘরে ফিরলেন না!
বেইম [যুক্তরাজ্যে 'ব্ল্যাক, এশিয়ান অ্যান্ড মাইনরিটি এথনিক' বা অ-শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়কে বোঝাতে ব্যবহৃত] কমিউনিটির কাছে এই উৎকণ্ঠা চিরচেনা। ব্রেওনা টেইলর, আহমাদ আরবারি, এলিজা ম্যাকক্লেইন: এই নামের মানুষগুলোর বেলায় দেখেছি, কী রকম অন্যায়ভাবে তাদের জীবন হারাতে হয়েছে এবং তাদের সবার পরিবারের মানুষগুলোর জীবন বদলে যেতে, বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। এইসব ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের কেনোসা শহরে নৃশংসভাবে গুলি করে জ্যাকব ব্লেককে মেরে ফেলার খবর পড়ে সেটি আমি আরও একবার অনুভব করেছি।
যখন আমার নয় বছর বয়স, প্রথমবার আমাকে কেউ 'এন' অক্ষরের (নিগ্রো) শব্দ ধরে ডেকেছিল। আমার ক্লাসেই পড়া সেই ছেলে ঠিকই জানত, এ রকম সম্বোধন আমাকে কষ্ট দেবে, তা সেই কষ্ট পাওয়ার কারণ ওই বয়সে আমার জানা না থাকলেও।
লিভারপুলে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে জানতাম, আমি শ্বেতাঙ্গ নই; তবু গায়ের রঙের গোলমাল আমার মাথায় ঢুকত না ঠিকমতো। মাকে আক্ষরিক অর্থেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আমি কোন বর্ণের? (ফর্মে লেখা থাকা) কোন বক্সটিতে টিকচিহ্ন দেব?' মেল বি'র (ব্রিটিশ গায়িকা) চেয়ে বরং নিশ্চিতভাবেই মেল সি'র (ব্রিটিশ গায়িকা) মতোই গায়ের রঙ আমার। তবু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় যখন সহপাঠীদের সঙ্গে 'ওয়ানাবি' গাইতাম, নিজেকে 'স্পোর্টি' (মেল সি'র ছদ্মনাম) নয়, বরং 'স্কেরি স্পাইস' (মেল বি'র ছদ্মনাম) হিসেবেই ভেবে নিতাম।
শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ স্কুলে অল্প কয়েকজন 'বেইম' শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন হওয়ার প্রভাব নানাভাবেই আপনার ওপর পড়বে। আপনাকে পুরো সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হয়ে ওঠতে হবে; গ্রহণযোগ্য সীমারেখার দায়ভার নিতে হবে কাঁধে। যেমন ধরুন, ক্লাস বিরতির সময় যখন বন্ধুরা 'অলওয়েজ অন টাইম' গানের কথাগুলো মুখস্থ করবে, আপনি কি তখন জা রুলের বিটগুলো গাইতে বাধ্য? তাদের জন্য গেয়ে দিচ্ছেন, এমন একটা ভাব ধরতে বাধ্য? ভূগোলের প্রশ্নে, কোনো সহপাঠী যখন নাইজারের দিকে ইঙ্গিত করে ইচ্ছে করেই দেশটির নাম ভুল উচ্চারণ (নিগার) করবে, আর তখন ক্লাস জুড়ে হাসির রোল পড়ে যাওয়া কি আপনাকে জ্বালাতন করবে না?
দেশের প্রতিটি 'বেইম' শিশুই এইসব এবং এমনকি এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তাদের জানা থাকে না, কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে, কী রকম অনুভব করবে। ওইসব রসিকতাকে নষ্ট করে দেওয়ার মতো কোনো আচরণ যেন ফুটে না ওঠে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে বাধ্য তারা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্ণ প্রসঙ্গে জুড়ে রাখা গল্প-কবিতা এবং কী করা যাবে ও কী যাবে না- সেইসব বিতর্কও এই সমস্যার একটি অংশ। ব্যাপারটি এমন, কৃষাঙ্গ মানুষদের এইসবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শিখতেই হবে। এ যেন অবধারিতভাবেই বেড়ে ওঠার একটা অংশ।
নিজের গায়ের রঙ সম্পর্কে জীবনে প্রথমবার আমার সচেতন হয়ে ওঠার একটি ঘটনা ঘটে এক ফুটবল খেলায়। মনে পড়ে, মনে মনে আমি কৃষাঙ্গ খেলোয়াড়দের সমর্থন করেছিলাম, তারা ঠিক কোন দলের হয়ে খেলছিল, সেটি পাত্তা না দিয়েই; কেননা, আমি চাইনি তারা হেরে গিয়ে বর্ণবাদী অপমানের শিকার হোক। এই ঘটনা, এই যে ১৪ বছরের এক কিশোরীর উৎকণ্ঠা, এমন পরিস্থিতিতে কারও উঠে দাঁড়িয়ে বলা উচিত ছিল, 'এমনটা ঠিক নয়।' নিজের চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসে থেকে, চারপাশে তাকিয়ে তেমন কারও দেখা আমি পাইনি।
'একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের স্কার্ট গায়ে চড়িয়ে জাতির হৃদয়ের মণি ও নিচু জাতের মেয়ে- এই দুটি সত্তার মধ্যে একটা চমৎকার সীমারেখা এঁকে দেওয়া যায়,' সম্প্রতি ডেনিসি লুইসকে ঘিরে 'টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় এক কলামে এমনটাই লিখেছেন জেনেট কোয়াকি। 'প্রতিভাবান, দেশপ্রেমিক ও প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে একটি দেশের সেরা রূপে তাকে জাহির করা হয়; অথচ এক পা ঘুরে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণভাবে মনে পড়ে যায়- কী অসাধারণ সুযোগ আপনার সামনে।' এই কথাগুলো আমি মনে ধরে রেখেছি।
আপনার পক্ষে মার্কাস রাশফোর্ড হওয়া সম্ভব, বিশ্বব্যাপি যার নামের মহিমা, কোভিড-১৯ সংকটের কারণে গৃহস্থ শিশুর ক্ষুধা নিবারণে সফল আওয়াজ তোলার মাধ্যমে যিনি দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন; ব্রিটিশ স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা সচিব তাকে শুধুমাত্র 'ড্যানিয়েল' নামে সম্বোধন করেছেন, আর অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও একজন কৃষ্ণাঙ্গের নাম মুখে নিতে হয়েছে বলে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছিল তার অবয়বে।
বিদ্বেষবাদী মানুষ আমি নই। তাই বুঝি, অবিচারের বিরুদ্ধে নির্বিশেষে কথা বলার সাহস একজন মানুষের মনে কী অনুভূতি এনে দেয়। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু-পরবর্তী কয়েকটি সপ্তাহে, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বর্ণ ও পরিচয় বিষয়ক কয়েকটি বইয়ের তালিকা আমি প্রকাশ করেছিলাম, যেন আমার ফলোয়ারেরা সেগুলো পড়তে পারেন; যদিও আমাকে বলা হয়েছিল, যেন 'শুধু খেলা নিয়েই কথা বলি।' নিজ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি কি কোনো মন্তব্য করতে পারব না? আমি একজন খেলোয়াড়; তবে তার চেয়েও বেশিদিন ধরে আমি এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী।
সম্প্রতি আমার এক 'ফেসবুক ফ্রেন্ড'কে একটা পোস্ট দিতে দেখছি: 'যুক্তরাজ্য হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উদার ও গ্রহণযোগ্য দেশগুলোর একটি। এখানে শ্বেত-আধিপত্যের কোনো জায়গা নেই। বর্ণবাদের অস্তিত্বও বলতে গেলে একদম নেই।'
এই বিস্মৃতিপ্রবণতাও সমস্যাটির একটা অংশ এবং অগ্রগতি এত ধীর হওয়ার অন্যতম কারণ। আমার শৈশবের বাড়ি, যেখানে মা থাকেন এখন, সেখান থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বেই সেই জায়গা, যেখানে ২০০৫ সালে এক বিনা প্ররোচিত বর্ণবাদী হামলায় খুন হয়েছিলেন অ্যান্থনি ওয়াকার। তবে যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের ধরন নানা রকম, এবং সরাসরি খুন কিংবা নিন্দাচর্চায় সেটি সব সময় প্রকাশ পায় না।
আমাদের সবার উচিত নিজেদের বিশেষ অধিকার শনাক্ত করা এবং এই আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ রেখে হাঁটা- যতক্ষণ না সত্যিকারের পরিবর্তনটি আসছে।
গত কয়েকটি মাস আমাদের বেশ কিছু কঠিন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। এটি আমাকে বাধ্য করেছে নিজের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে এবং নিজ বর্ণ ও পরিচয়ের ওপর প্রতিফলন ফেলতে। ভাগ্য ভালো, এইসব বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে বলার মতো নিজস্ব কণ্ঠস্বর ও প্ল্যাটফর্ম আমার রয়েছে। এলএফসি ফাউন্ডেশন এক্স কেজেটি একাডেমিতে নিজের কাজ করার মতো একটি অবস্থান আমার রয়েছে বলে আমি গর্বিত।
এখানে আমি প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়দের সাহায্য করার ব্যাপারে আশাবাদী। সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অর্থলগ্নির অভাবে যে খেলোয়াড়েরা সুযোগ পান না, নিজ নিজ খেলায় তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সুযোগ করে দিতে কাজ করছি আমরা।
'সহজ জীবনের জন্য যেকোনো কিছু করো'- অতীতে এমন নীতিবাক্য সামনে রেখে, একজন খেলোয়াড় হিসেবে জীবনকে দেখতাম; তাই কোমল ও নিরপেক্ষ মতামত দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। কিন্তু এমনটা আর করব না আমি। কেননা, 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার'।
- লেখক: ব্রিটিশ খেলোয়াড়; বিশ্ব হেপ্টাথলন চ্যাম্পিয়ন
ভোগ ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ