দেশে এত ধনী ব্যবসায়ী থাকতে কাউছ মিয়া যেভাবে সেরা করদাতা
বছরের এ সময়ে এসে হাকিমপুরী জর্দা ও গুলের মালিক জনাব কাউছ মিয়ে দেশের হিরো হয়ে যান। তিনি ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে দেশ সেরা ট্যাক্সপেয়ার। অথচ, তার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী বা ধনী লোক আছে দেশে আরো শত শত। এটা নিয়ে মানুষের আফসোসের শেষ নেই, আবার তিনি তামাকজাত পণ্যের ব্যবসা করেন বলে অনেকেই নৈতিকভাবে ব্যাপারটা হজম করতে পারেন না। তবে রাষ্ট্রের জন্য তিনি যা করেন সেটাকে নৈতিকভাবে আপনি অপছন্দ করলেও উন্নয়ন অর্থনীতিতে তার অবদান প্রশংসনীয়।
ট্যাক্স জিনিসটা ইতিহাসের কোনোকালেই সাধারণ মানুষের হজমযোগ্য ছিল না, জোর করে গেলানো হয়েছে। মুখ দিয়ে গিলানো হয়েছে ব্যাপারটা এমন না, অন্যদিক দিয়েও গিলানো হয়েছে! অর্থনীতির অন্যান্য টুলস-তত্বগুলোর মত এটিও মারাত্বক আলোচিত ও বিতর্কিত। পুরো ট্যাক্স ইতিহাস ও সিস্টেমকে আনফেয়ার মনে হবে, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে ভাল কোন বিকল্প হাতে নেই। এ এক শাখের করাত।
আদিকালে লোকজন কৃষিকাজ করত, রাজা-সামন্তরা রাজ্য চালনা, নিরাপত্তা প্রদান ইত্যাদির দোহাই দিয়ে একটা বড় অংশ নিয়ে যেত। আধুনিক ট্যাক্সের ধারণা এসেছে অনেকটা রবিন হুড সাহেব থেকে। ধনীদের থেকে নিয়ে গরীবদের জন্য খরচ করার জন্য ট্যাক্স সিস্টেম- অন্তত সারাদুনিয়ার সরকারগুলো তাই বলে থাকে।
ইংল্যান্ড আমেরিকায় আগে ডাইরেক্ট কোন ট্যাক্স ছিল না, যুদ্ধের খরচ যোগাবার জন্য হঠাৎ হঠাৎ ট্যাক্সের বোঝা চাপানো হতো। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্রিটেন ১৭৯৯-১৮১৬ সালে, সিভিল ওয়ারের খরচের জন্য আমেরিকায় ১৮৬১-১৮৬৫ সালে ট্যাক্স নেয়া হয়। ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় স্থায়ীভাবে ট্যাক্স আইন শুরু হয় যথাক্রমে ১৮৭৪ ও ১৯১৩ সালে। তবে পাবলিককে ইনকাম ট্যাক্সের আইডিয়া খাওয়াতে তাদের সময় লাগে কমবেশি অর্ধশতাব্দী।
সাল ক্ষণ দেখে প্রকৃত কাহিনী আন্দাজ করা কঠিন। সরকার আমজনতাকে বুঝায় ধনীদের শাস্তি দেয়ার জন্য এ আইন, তোমরা আইনের পক্ষে ভোট দাও। ধনীরা বরাবরই সরকার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে , তারা এর ফাকফোকর দিয়ে ফায়দা বের করে নেয়। গণতন্ত্রের শুরুর দিকে উচ্চ আয়ের ও নির্দিষ্ট পরিমানে ট্যাক্স পেয়াররাই ভোট দেয়ার সুযোগ পেতেন।
বর্তমানে সারাদুনিয়ায় বেশিরভাগ পলিটিশিয়ানরা নিজেরাই ব্যবসা করেন অথবা ব্যবসায়ীরা নির্বাচনী স্পন্সর করেন, সংসদগুলোতে তাদের লবিস্ট গ্রুপ সবচেয়ে শক্তিশালী। ফলত, নিমিষেই তারা সিংহভাগ সরকারি খরচের ঠিকাদারি বাগিয়ে নেয়। কর্পোরেশন নামে এক কাগুজে দুর্গ গড়ে তুলে সম্পদকে নিরাপত্তা দেয়, সম্পদকে ট্যাক্সমেনদের হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের যা আয় হয় তা আগে ট্যাক্সড হয়ে যায়, এরপর যা থাকে তা থেকে তারা খরচ করেন। ধনী-গরিব দেশ নির্বিশেষে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বারো মাসের আয়ের জানুয়ারি হতে এপ্রিল/মে অংশের টাকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করের মাধ্যমে সরকারের ঘরে যায়।
অন্যদিকে ধনীদের কর্পোরেট ট্যাক্স হয় আয়কৃত টাকা হতে পুরো প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ব্যয় মিটানোর পর তাদের উচ্চমেধাবী একাউন্টেন্ট ও আইনজীবীরা যেটুকু করযোগ্য মুনাফা হিসেবে দেখায়, সেটুকুর উপর। আপনি মধ্যবিত্ত হলে আপনার গাড়ি কেনা, ফ্যামিলি নিয়ে দেশে বিদেশে ট্যুর করতে হবে, যে টাকা আয় করেছেন তার ট্যাক্স আগে শোধ করে এরপর বেঁচে যাওয়া অংশ হতে। কর্পোরেশন বা কোম্পানি মালিকরা তাদের ব্যবহৃত গাড়িকে কোম্পানির গাড়ি দেখিয়ে, ফরেন প্লেজার ট্যুরকে ফরেন ট্রেইনিং দেখিয়ে সব কোম্পানির খরচের খাতে ফেলে দিয়ে এরপর যতটুকু প্রফিট দেখান, তার একটা অংশ কর দেন।
এটুকু ফাঁকি সাধারণ চোখে দেখা যায়। তবে এগুলো বড় কিছু না। ইউএসএ সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বড় ব্যাবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্যাক্স দিতে চান না বলে সিনেটে ও নিম্নকক্ষে হইচই হয়েছে। এসময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়েকটি কোম্পানি কর্পোরেট ট্যাক্স দেয় না বললেই চলে। আমেরিকার অন্যতম বড় ৫৫ টি কর্পোরেশন ২০১৮-২০২০ এ তিন অর্থবছরে প্রচুর প্রফিট করলেও কোন ট্যাক্সই দেয় নি। তাদের হাতের প্রধান অস্ত্রগুলো হচ্ছে- এক্সালেরেটেড ডেপ্রেসিয়েশন, প্রফিট অফশোরিং, স্টক অপশন, ট্যাক্স ক্রেডিট।
নামগুলো বেশ খটোমটো হলেও উদ্দেশ্য খুব সরল, ট্যাক্স না দেয়া। যেমন, এক্সেলারেটেড ডেপ্রেসিয়েশন বুঝায় আপনি আপনার ব্যবসার জন্য এক লাখ টাকা খরচ করে একটি মোটরসাইকেল কিনলেন এবং ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখালেন। দশ বছর ধরে এর মেয়াদ রাখলেন। নরমাল ডেপ্রেসিয়েশনে আপনার প্রতি বছর খরচ দেখাতে পারবেন দশ হাজার টাকা। কিন্তু এক্সেঃ ডেপ্রেঃ সিস্টেমে আপনি প্রথম বছর খরচ দেখাতে পারেন ৪০/৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় বছর ২০/৩০ হাজার টাকা এর পর বাকি টাকা পরের বছরগুলোয় বেশি থেকে কমের দিকে কিছু একটা দেখিয়ে একলাখ টাকা মিলাতে পারলেই হল।
যেহেতু কোম্পানিগুলো প্রচুর রিইনভেস্ট করে, বাইরের দেশে প্রোগ্রাম চালু করে। তাই, ট্যাক্স না দিয়ে প্রফিট অফশোরিং বা বাইরে টাকা ইনভেস্ট করা অনেক লাভজনক। অনুন্নত দেশগুলোতে ব্যবসায় মালামাল আমদানি- রপ্তানিমূল্য কমবেশি দেখিয়ে আপার অথবা আন্ডার ইনভয়েসিং করা মামুলি ব্যাপার। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সুতরাং সারাদুনিয়াজুড়েই কর্পোরেট কর কমবেশি ১৭-৩২% হলেও আসলে প্রদত্ত কর অনেক কম, কেউ কেউ দেয় শুন্যের কাছাকাছি। বাংলাদেশের মত উচ্চ জনঘনত্বের দেশগুলোতে বিরাট কর্মযোগ্য জনসংখ্যা থাকায়, প্রচুর কর্ম-জীবিকা নিশ্চিত করার স্বার্থে, হেভি ম্যানপাওয়ার ইনভলভ ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ব্যাপক হারে ট্যাক্স রিবেট দেয়া হয়।
তবে ব্যাক্তি পর্যায়ে কর সারাদুনিয়াতেই পই পই করে আদায় করা হয়, দেয় মূলত মধ্যবিত্তরা। বাংলাদেশে ৪০ লাখ করযোগ্য খানা থাকলেও কর দেয় প্রায় ৮ লাখ খানা, এর মধ্যে বড় একটি অংশ আবার সরকারি চাকুরিজীবী। এখানেও, কর্পোরেটগুলো সারাদুনিয়ার মতই সুযোগ নেয়।
জনাব কাউছ মিয়ার ব্যবসার প্রকৃতির সাথে উপরের ব্যাখ্যাগুলো মিলালেই অনেক উত্তর পেয়ে যাবেন। তার কোম্পানি এই ইন্ডাস্ট্রিতে সারাদেশে একক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ ব্যবসায় টেকনোলজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ব্যাপক পুনঃবিনিয়োগের প্রয়োজন নেই, তিনি বড় আকারে পোর্টফলিও সম্প্রসারণ করেন না। সেজন্য তার বিরাট কোন এক্সালেরেড ডেপ্রেসিয়েশন দেখানোর সুযোগ নেই বা দেখান না, প্রফিট অফশোরিং করেন না এবং অন্যান্য উপায়গুলো অন্যদের মত ব্যবহার করেন না।
পাশাপাশি, দেশের সেরা করদাতা হওয়া তার জন্য অত্যন্ত সম্মানের, কোম্পানির জন্য ফ্রি পজিটিভ মার্কেটিং। এগুলো সবগুলো ফ্যাক্টর তার পক্ষে কাজ করে বলেই তিনি সেরা করদাতা। এটা নিয়ে আবেগাক্রান্ত হওয়ার কিছু নেই, আবার অন্যরা কম ট্যাক্স দিচ্ছে বলে ঘৃণা করার কিছুও নেই।
আমি আপনি ট্যাক্স দেয়া-নেয়া ফেয়ার-আনফেয়ার যাই মনে করি না কেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজন শক্তিশালী রাজস্ব প্রবাহ। বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও যা-তা। এশিয়ার অন্য দেশ দূরের কথা, সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়েও অনেক কম। অতিদরিদ্র সাব-সাহারার দেশগুলোর সরকারের রাজস্ব আয় যেখানে জিডিপির ১৮%, ভারতে ২০%, বাংলাদেশে মাত্র ১০%। অর্থাৎ আয়ের খাত থাকলেও দেশে সঠিক পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, যার কারণে উন্নয়নে অধিকতর গতি ব্যহত হচ্ছে।
অর্থনীতির সক্ষমতা থাকলেও রাজস্ব আদায় অত্যন্ত কম। অর্থাৎ, এ মুহুর্তে আয়ের পোটেনশিয়ালিটি অনেক বেশি। তাই আগামী পাচ-সাত বছর ভালো পরিকল্পনা করে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ১০% হতে ২০% করা জরুরি। এজন্য এনবিআরকে আরো শক্তিশালী করা দরকার, রুট লেভেলে ট্যাক্সভ্যাট অফিস করা দরকার। জনবল সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য উপজেলা লেভেলে ট্যাক্স-ভ্যাট এর আলাদা অফিস না করে একক অফিস করা যেতে পারে। দেশের চল্লিশ লক্ষ খানার কাছে ট্যাক্সম্যানরা পৌঁছাতে পারলে, জায়গায় জায়গায় ভ্যাট মেশিন বসাতে পারলে দেশের উন্নয়ন খাতে অধিকতর বরাদ্দের জন্য টাকার অভাব পড়বে না।