নিম্নবর্গের গানের মেধাস্বত্ব
জানি চলতি আলাপখানির শিরোনামে একটা ভয়াবহ হাস্যরসের উপাদান আছে! কারণ নিম্নবর্গের আবার স্বত্ব আর মালিকানার তর্ক কেন? নিম্নবর্গের গীতবাদ্যকে 'দেশের সম্পদ' আর 'জনগোষ্ঠীর মালিকানা' হিসেবে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে রাখবার একটা বাহাদুরি বহাল আছে। গানের যাবতীয় কথা, সুর, স্বরলিপি, গায়কী ঢঙ সবকিছুই যেন উচ্চবর্গের। তথাকথিত শহরের ধনী গায়ক-শিল্পীর। তাই তো নিম্নবর্গের গানকে একতরফাভাবে 'লোকগান' আর 'লোকশিল্পী' আখ্যা দেওয়া হয়।
মানতে হবে শ্রেণিবিভাজিত এ সমাজে সৃজনশীলতারও অন্যায় শ্রেণিকরণ বহাল আছে। আর তাই নগরশিল্পী আর গ্রাম-বাংলার নিম্নবর্গের শিল্পীর ভেতর বৈষম্যের গণিত টিকে আছে। যেন নিম্নবর্গের গানে 'ননন্দনতত্ত্ব', 'চিন্তাশীলতা', 'রূপকল্প', 'রাজনৈতিকতা', 'আধুনিকতা' কি 'দেশাত্মবোধের' কোনো স্পর্শ নেই।
নিম্নবর্গের গানদুনিয়া যেন রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন কোনো বিস্ময়কর উপাদান। জানি শহরকেন্দ্রিক নামজাদা ধনী শিল্পীদের বাংলা গানের মেধাস্বত্ব তর্কটিই যেখানে বেসামাল, সেখানে নিম্নবর্গের গানের স্বত্ব ও মালিকানার বাহাসটি অতি হাস্যস্পদও বটে। তবে মেধা, চিন্তা, মনন ও সৃষ্টিকর্ম ঘিরে বুদ্ধিজাত সম্পদের অধিকার প্রশ্নে নিম্নবর্গের গানের ময়দান থেকে দেখা চলতি আলাপখানি তর্কের আরও নানা তরঙ্গকেও উসকে দেয়, যা বাংলা গানের অধিপতি ময়দানের মেধাস্বত্ব আলাপে হাজির থাকে না।
মেধা, চিন্তা, বুদ্ধি ও সৃজনশীলতা সবকিছু মিলিয়েই বাংলার জ্ঞানপ্রবাহ। এ জ্ঞানপ্রবাহের দর্শন বহুমাত্রিকতার স্বরূপে বিরাজিত। চিন্তার ইতিহাসে এখানে বাণিজ্যিক মালিকানার সংঘর্ষ নেই। গ্রামবাংলায় কেউ এই সুর আমার, এই গানের মালিক এমনটা দাবি তুলেনি। সমতল থেকে পাহাড় গ্রামবাংলার নিম্নবর্গ কখনোই গীতবাদ্যের মহায়ানের স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করেনি। গান কি গীতিআখ্যান কাল থেকে কালে সমাজে নানা রূপে নানা মেজাজে ভূমিষ্ঠ হয়, বয়নের নানা সন্ধিস্থল পাড়ি দেয়। সুর ও কথার জটিল সম্পর্ক এক এক সময়ে এক এক রূপে 'সামাজিক' হয়ে ওঠে। এটি এই জনপদের মেধার বিজ্ঞান, চিন্তাশীলতার ব্যাকরণ। চিন্তা ও মেধাকে ঘিরে স্বত্ব ও মালিকানার তর্কটি খোদ পশ্চিমের। এর সাথে করপোরেট বাণিজ্য মারদাঙ্গা আর পণ্য-বাহাদুরি জড়িত।
এরশাদের সময় 'নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা' গানটি বেশ জনপ্রিয় করে তোলার রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা চলে। জানা যায়, গানটির রচয়িতা ও সুরকার সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা; এরশাদ নন। রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও এজেন্সির জবরদস্তি এভাবেই নিম্নবর্গের কত সুর ও গীতব্যঞ্জনাকে দখল করে আছে, তার কি কোনো সুস্পষ্ট হদিশ আছে?
দেশের সংগীত-ভূগোল মানচিত্রটি বেশ বিস্ময়কর ও বৈচিত্র্যময়। নানা রঙের নদীর প্রবাহে জন্ম নিয়ে নানা রঙের গান। হাওরের সাথে বরেন্দ্র, বিলের সাথে পাহাড় সর্বত্রই কথা ও সুরের বৈচিত্র্য। সুনামগঞ্জের ধামাইল আর চাপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা তাই এক নয়। কোল, কন্দ, কড়া, কডা কি কোচ আদিবাসীদের সংগীত দুনিয়ার ব্যাকরণ ভিন্ন ভিন্ন। গান স্পষ্টতই চারপাশের যাপিতজীবনের রস ও আহাজারি ধারণ করে। নির্দেশ করে তার জন্মস্থল, মাটি ও জলের জটিল সম্পর্ক। পাশাপাশি যে সমাজে গানের জন্ম ও বিস্তার, সেই সমাজের চর্চিত ঐতিহাসিকতা। মান্দি সমাজে বহুল ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র দামা, খ্রাম, রাং, আদুরি, গঙগেন্দা কোনোভাবেই ম্রো আদিবাসী সমাজে দেখা যায় না। ম্রো সমাজে যে প্লুং বাঁশি ব্যবহৃত হয়, সাঁওতাল সমাজে তা নেই। সাঁওতাল সমাজে মাদল থেকেই গানের জন্ম ও বিস্তার।
সকল সমাজেই গান, বাদ্যযন্ত্র ও আখ্যান নিয়ে নানা রূপকল্প, জন্মকাহিনি ও চর্চার ধারাবাহিকতা আছে। দুম করে একে বদলে ফেলা বা অস্বীকার করে বাতিল করে দেওয়া যায় না। কিন্তু নিদারুণভাবে তাই ঘটে চলছে। দেশের আদিবাসী কি বাঙালি নিম্নবর্গের গান-দুনিয়াকে অন্যায়ভাবে অস্বীকার করে চলেছে এই বহুজাতিক করপোরেট সময়। রাষ্ট্র ও এজেন্সিসমূহ অস্বীকৃতির এই সংস্কৃতিকে নিরন্তর মেদবহুল করে তুলছে। তাই দেখা যায়, নিম্নবর্গের গানকে যে যেভাবে পারছে যাচ্ছেতাই কায়দায় গানের যাবতীয় টিকে থাকবার শর্তকে অস্বীকার করে একতরফা ব্যবহার করে চলেছে।
গানকে নিম্নবর্গের জীবনে কার্যকারণ হিসেবে দেখা হয়। বীজদানা, বিছানা বালিশ কি গাছন্ত ওষুধের মতোই এও জীবনেরই এক ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী। গানের ভেতর দিয়েই যাপিতজীবনের বোধ ও দর্শন, প্রতিরোধ ও দ্রোহ নানা রূপে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। এমনি এমনি তো গান 'গান' হয়ে ওঠে না। ফৗগুন (ফাল্গুন) মাসে যখন শাল, মহুয়া গাছে নতুন পাতা গজায় আর ফুল ফোটে। সেই ফুল বাহা পরবের ভেতর দিয়ে সামাজিকভাবে গ্রহণের নিমিত্তেই সাঁওতাল সমাজে আয়োজিত হয় বাহা পরব। বাহা পরবে প্রকৃতিকে জাগানো ও সান্নিধ্যের তরেই বাহা গীতের জন্ম ও বিকাশ সাঁওতাল সমাজে।
হাওরাঞ্চলের ধামাইল গীত সাধারণত: বিয়ে ও অন্নপ্রাশন ঘিরে। জীবনের ক্রান্তিকালকে স্মরণে রেখে। জলধামালি, আসর, বাঁশি, অধিবাস, বিচ্ছেদ এসব ধামাইল গীতের সুর ও পরিবেশনা দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। মান্দি সমাজে মৃতের স্মরণে আজিয়া গানের চল আছে। এসব আজিয়ায় মৃতকে আবারও তার বংশ ও গ্রামে জন্ম নেওয়ার জন্য আবদার করা হয়। মৃতের অবদান, সাফল্য ও উৎসাহব্যাঞ্জক ঘটনা এবং কাহিনি গানে গানে তুলে ধরা হয়। গোপালগঞ্জের চান্দারবিল অঞ্চলে রয়্যানি গানের আসর বসে মনসা পূজাকে ঘিরে, ঠিক যেমন আছে ছাদ পেটানোর গান কি ধান জমিনের ঘাস নিড়ানির গান। স্মরণে রাখা জরুরি কোন গান কিভাবে এবং কেন ভূমিষ্ঠ হয়েছে, কোন কোন শর্তকে ঘিরে একটি গান সমাজে গান হিসেবে তার বিস্তারের বিবরণ হাজির রাখছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের গানের এই বিজ্ঞান ও দর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, অস্বীকার করা হয়। পাশাপাশি নিম্নবর্গের গানের কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলয় নেই। যে যেভাবে পারে সেভাবেই নিম্নবর্গের গানের একতরফা ব্যবহার করে। কখনো গানের কথা কি সুর একতরফা ছিনতাই হয়, অধিপতি-শিল্পীর বিস্ময়কর বাজিমাত ঘটে নিম্নবর্গের কোনো গান কি গায়কীর উপর নির্ভর করে।
এ তো চলছেই। কিন্তু যখন কথা কি সুর আমূল পাল্টে ফেলা হয় বা গানটির আগাপাছতলা আবেদনকে গলা টিপে হত্যা করা হয়, তখন এ নিয়ে শুধু মেধাস্বত্বের তর্ক নয়, বাহাসটি সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক তলেই হওয়া জরুরি। রাধারমণের 'অন্তরে তুষের অনল জ্বলে গইয়া গইয়া' গানটি দেশের অনেক নামজাদা শিল্পীই সাহস নিয়ে গেয়েছেন, 'অন্তরে তুষের আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া'। রাধারমণের গানটি সুনামগঞ্জের যে অঞ্চলে জন্ম নিয়েছে সেখানে 'গইয়া গইয়া' একটি প্রচলিত রূপকল্প। মাটির পাতিলে রাখা তুষের আগুন গইয়া গইয়া মানে ধীরে ধীরে জ্বলে। আমরা কি বারবার মেনে নেব এসব না জানার ফলেই ঘটে? নিম্নবর্গের গান-দুনিয়ার শর্ত ও বহমান আখ্যানকে অস্বীকারের অন্যায় বাহাদুরিগুলোকে কি তর্কের ময়দানে টানব না? তাহলে আজ গানের মেধাস্বত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠেছে, এটি কার গানের মেধাস্বত্ব, কোন গানের মেধাস্বত্ব?
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নিয়ন্ত্রিত করপোরেট বিশ্বায়নের দুনিয়ায় মানুষের সম্পদ, সম্ভাবনা, জ্ঞান, মেধা সবই একতরফা দখল ও নিয়ন্ত্রণের বৈধতা তৈরি করেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। গবেষণা ও উন্নয়নের নামে জনগণের মেধা ও বুদ্ধিজাতসম্পদের একতরফা ছিনতাই ও ডাকাতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে লোকায়ত জ্ঞান ও প্রাণসম্পদ হচ্ছে করপোরেট বাণিজ্যের অব্যর্থ নিশানা। জনগণের লোকায়ত ঔষধি জ্ঞান ও প্রাকৃতিক উৎসের উপরেই দাঁড়িয়েছে করপোরেট ঔষধ বাণিজ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩টি অসম চুক্তির একটি হচ্ছে 'বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি বা ট্রিপস'। ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ) অনুচ্ছেদে প্রাণসম্পদ, জ্ঞান, প্রযুক্তির ওপর পেটেন্টের অধিকারের রাখা হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজ দেশের জ্ঞান ও সম্পদ সুরক্ষায় একটি কার্যকর আইন তৈরির কথাও বলা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অসম ময়দানে বাংলাদেশের মতো ক্ষমতাহীন একটি গরিব দেশ তার নিজ মেধাসম্পদ সুরক্ষায় যে আইন কাঠামোই তৈরি করুক না কেন, তা উত্তরের ধনী দেশের বাহাদুরির কাছে কখনোই 'কার্যকর' হিসেবে ঠেকে না।
বুদ্ধিজাত সম্পদ ও স্বত্ব ঘিরে বাংলাদেশে কিছু সরাসরি আইন আছে। ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯, দ্য পেটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট ২০০৩ (১৯১১ সনের আইন), কপিরাইট আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০০৫) এবং ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। এছাড়াও নিদারুণভাবে 'বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড কমিউনিটি নলেজ প্রটেকশন অ্যাক্ট' নামে একটি আইনের খসড়া ১৯৯৮ সন থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের দিন গুনছে। মেধাস্বত্ব ও বুদ্ধিজাত সম্পদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের 'বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা (ডাব্লিউআইপিও)'। বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ২০০০ সনে ২৬ এপ্রিলকে 'বিশ্ব মেধাসম্পদ অধিকার দিবস' হিসেবে নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সনে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার সদস্য হয়। প্রতি বছরই বিশ্ব মেধাসম্পদ অধিকার দিবসের একটি প্রতিপাদ্য থাকে। ২০০১ সনে পয়লা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, 'আগামীর নির্মাণ আজকেই'। ২০০২ সৃজনশীলতাকে সহযোগিতা, ২০০৩ আপনার কাজে মেধাসম্পদ তৈরি করুন, ২০০৪ অর্থনীতি-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মেধাসম্পদের ভূমিকা, ২০০৫ চিন্তা-কল্পনা ও নির্মাণ, ২০০৬ একটা চিন্তা থেকেই মেধাসম্পদের শুরু, ২০০৭ মেধাসম্পদ ও সৃজনশীলতার সম্পর্ক, ২০০৮ বরণীয় উদ্ভাবন ও মান্য মেধাসম্পদ, ২০০৯ সুরক্ষিত আগামীর জন্য তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনীকে গুরুত্ব দিতে হবে, ২০১০ উদ্ভাবনের বিশ্বসংযোগ, ২০১১ ভবিষ্যত নির্মাণের কারিগরি, ২০১৩ উত্তর প্রজন্মের সৃজনশীলতা, ২০১৪ চলচ্চিত্র, ২০১৫ সংগীত, ২০১৬ ডিজিটাল সৃজনশীলতা, ২০১৭ উদ্ভাবন-জীবনযাত্রার উন্নয়ন, ২০১৮ সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনে নারী, ২০১৯ খেলাধূলা। করোনা মহামারিকালে ২০২০ সনের বিশ্ব মেধাস্বত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল সবুজ আগামীর জন্য উদ্ভাবন; চলতি ২০২১ সনের প্রতিপাদ্য 'ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের চিন্তা ও বাজারের সংযোগ'।
চলতি আলাপখানি আবারও গানের, বিশেষ করে নিম্নবর্গের গানের মেধাস্বত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। ময়মনসিংগের গীতিকার নয়ন রাজার 'কেন এলে না' গানটি বেহাত হয় ২০০৩ সনে। বহুদিন পর ২০২১ সনে তিনি গানটির মেধাস্বত্ব অধিকার পেয়েছেন। কিন্তু দেশের গ্রামগঞ্জের সহস্র গীতিকার-শিল্পী-সুরকার যাদের সৃষ্টি একসময় ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে ছড়িয়ে যায়, যাদের গান সামাজিক বয়ান হয়ে ওঠে তাদের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের অধিকার ও সুরক্ষার ধরন কেমন হবে? কে তার সুরাহা করবে? গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের বিশ্ব মেধাস্বত্ব দিবসে 'আইপিডিসি ফাইনান্স'কে দেশের লুপ্তপ্রায় লোকসংগীত নান্দনিক উপস্থাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস 'মেধাস্বত্ব সুরক্ষা সম্মাননা' দিয়েছে।
আইপিডিসির কাজ বা আয়োজন বা উপস্থাপন নিয়ে প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো এমনসব গানের মেধাস্বত্ব সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে। যেমন তাদের পরিবেশিত জনপ্রিয় ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের গান 'তুরুরুতু তুরুরু', শাহ আবদুল করিমের 'বসন্ত বাতাসে' কিংবা 'সর্বত মঙ্গল রাধে' এমন অবিস্মরণীয় সামাজিক গানগুলির মেধাস্বত্ব কার? এসব সৃষ্টি বারবার নানাভাবে পরিবেশন ও আয়োজনের ভেতর দিয়ে যে ধরনের বাণিজ্যিক এবং সামাজিক মুনাফা তৈরি হয় তা কী কোনোভাবে যে সমাজ থেকে এসব সৃজনশীলতা বিকশিত হয়েছে সেই সমাজের সাথে বণ্টিত হয়? আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদেও (সিবিডি ১৯৯২) 'প্রবেশাধিকার ও লভ্যাংশ বিনিময়কে' গুরুত্ব দিয়েই ব্যাখা করা হয়েছে।
এখনো দেশের হাওরাঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, প্রতাপ চন্দ্র তালুকদারের ধামাইল এবং শীতালং শাহ, দুরবীণ শাহ বা এমনকি হাসন রাজারও অনেক গান নিজেদের বংশ পরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে এসব গানের সামাজিক সুরক্ষা এবং সৃজনশীল ভিত্তি মজবুত করে চলেছেন। তাহলে নিম্নবর্গের এসব গানের মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় কাকে স্বীকৃতি বা সম্মাননা জানানো জরুরি? হাওরের যে নারী পাহাড়ি ঢল থেকে ফসল রক্ষা করেন আবার ঝড়-জলের ভেতর অবিস্মরণীয় সব গানকেও বুকে আগল রাখেন, আর কেবল রাখেনই না, প্রতিবেশী ও উত্তর প্রজন্মকে এসব গানের সামাজিক তালিম দেন, তাহলে গানের সামাজিক প্রহরী এই গরিব নারীর জন্য কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি বা সম্মাননা নেই কেন? বা দেশের পাহাড় কি সমতল, বরেন্দ্র কি চর, উপকূল কি সমতট, গড় কি অরণ্য নানা জীবনের শত-সহস্র মানুষ যারা জীবন্ত রেখেছেন লোকগানের এক তরতাজা প্রবাহ?
এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, গানসহ মেধাস্বত্বের চলমান তর্কের তলটি দখল করেছে করপোরেট বাণিজ্য মনস্তত্ত্ব। এখানে চিন্তার স্বাধীনতা কি জ্ঞানপ্রবাহের অসীম বিস্তারের দর্শনকে ধাক্কা মেরে মেধা, সৃজনশীলতা ও প্রাণসত্তার জটিল সম্পর্ককে বাজারি দরদামের ভেতর আটকে ফেলা হয়েছে। যেন একটি গান এত দামে এত বছরের জন্য এই-এই ভাবে বেচা-বিক্রি করা যাবে। কাল থেকে কালে বহমান নানা সুরই কখনো লালন, কখনো শীতালং শাহ, কখনো রাধারমণ, কখনো শাহ আব্দুল করিম এভাবেই মূর্ত হয়েছে। বহমান সুর এক ভিন্ন ব্যাঞ্জনায় রূপ নিয়েছে। সুরের এই মহাবয়ান কি তুচ্ছ কপিরাইট আর পেটেন্ট আইনের দেয়াল ঘিরে বন্দি হয়ে যাবে? লালন কি, রাধারমণ কি কোনোদিন এই চেয়েছেন?
গ্রাম-বাংলার গানের মেধাসম্পদের সত্যিকারের স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রকে নিম্নবর্গের গান-দুনিয়ার ব্যাকরণ থেকেই সুরক্ষাবলয় তৈরি করতে হবে।
-
লেখক: লেখক ও গবেষক। [email protected]