পৃথিবীকে শীতল করতে মন্দের ভালো উপায় কোনটি?
বর্তমান বিশ্ব সভ্যতায় শক্তি উৎপাদনের যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার অবশ্যই পরিবর্তন দরকার। এ সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুতই আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে "সবুজায়ন" বা সবুজ শক্তি, যেমন- সৌর কিংবা পারমাণবিক শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে।
কিন্তু, কার্বন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেলেও এর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর উত্তাপ কমবে না। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল। এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি হলো, শিল্পায়নের এ যুগে উষ্ণায়ন ক্রমবর্ধমান নির্গমনের সঙ্গে সমানুপাতিক। অর্থাৎ, বছরের পর বছর ধরে কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানিগুলো ব্যবহার করে আমরা জলবায়ুকে এমন একটি স্তরে নিয়ে গিয়েছি যেখানে, এই মুহূর্তে সমস্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করে দিলেও পৃথিবীর উত্তাপ সমানুপাতিকভাবে বাড়তেই থাকবে।
২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ একেবারে নির্মূল করা একটি কঠিন কাজ হলেও, তা বাস্তবায়নযোগ্য। ধরা যাক, এ লক্ষ্য অর্জন হলো। তবে, নির্গমন বন্ধ হলেও গড় তাপমাত্রা কিন্তু বাড়তেই থাকবে; বায়ুমণ্ডলে ধীরে ধীরে বিচ্ছুরিত হতে থাকবে গ্রিনহাউস গ্যাস, যার কারণে পৃথিবীর উত্তাপ কমতে সময় লাগবে হাজার হাজার বছর।
এছাড়া উত্তাপ কমতে থাকলেও, উষ্ণ বিশ্বে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্র স্তর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাড়তে থাকবে। চলতি বছরের জুলাই ছিল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণতম মাস, অথচ এই সময়ে কার্বন নির্গমন শূন্যে পৌঁছানোয়, এটি হতে পারতো শতাব্দীর অন্যতম শীতল জুলাইগুলোর মধ্যে একটি।
তাই আমাদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যেনো, কার্বন নিঃসরণ কমানো বা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রাও কমতে থাকে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে যেনো আমরা কিছুটা হলেও বাঁচতে পারি।
তাহলে সম্ভাব্য সেই পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে?
পৃথিবীকে শীতল করতে কার্বন নিঃসরণ দূর করার সঙ্গে সঙ্গে সোলার জিও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি চরম তাপমাত্রা, ঝড় এবং অন্যান্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবগুলো হ্রাস করতে পারে।
কার্বন অপসারণ কিংবা সোলার জিও ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা উভয়ই এক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। চলতি শতাব্দীতে পৃথিবীর উত্তাপ কমাতে এই দুই পন্থার মধ্যে অন্তত একটি প্রয়োজন। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সোলার জিও ইঞ্জিনিয়ারিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের প্রধান ড. ডেভিড কেইথের মতে, কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং পৃথিবীর উত্তাপ কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি কার্বন ক্যাপচার করা হয় এবং সেটি মাটির নিচে পাম্প করে দেওয়া হয়, নতুবা কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রয়োজন হয় এমন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তবে কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং বা কার্বন অপসারণ প্রযুক্তির প্রধান সমস্যা হলো এটি অনেক ধীর গতিতে কাজ করে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন জমেছে, এ পন্থায় তা সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে দীর্ঘদিন সময় লেগে যাবে। তবুও, এ প্রযুক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদী নিরাময়ের অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে।
অন্যদিকে, জিও ইঞ্জিনিয়ারিং যথেষ্ট সস্তা এবং এটি দ্রুত কাজ করে। তবে এটি কার্বন অপসারণ করে না; সেদিক দিয়ে জিও ইঞ্জিনিয়ারিং একটি অস্থায়ী সমাধান, সম্পূর্ণভাবে নিরাময়ের উপায় নয়।
বিশ্ব নেতারা যেমনটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদি সেটি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়; যদি সত্যিই কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে পৃথিবী শীতলকরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় কোনটি হতে পারে?
এক্ষেত্রে কার্বন অপসারণ ভালো কাজ করতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বৃক্ষরোপণ হতে পারে এর প্রাথমিক পদক্ষপ। কারণ গাছ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- ঝড়-ঝঞ্জা, চরম উত্তাপ, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়ের মতো আপদ থেকে আমাদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এছাড়া গাছপালা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে, নির্গমন করে জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেন।
তবে এটাও সত্য যে, কেবল গাছ লাগিয়েই আমরা পৃথিবীর উত্তাপকে সামাল দিতে পারবো না।
জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্ল্যান্ট ব্যবহার, সেচ প্রক্রিয়া, এবং বনাঞ্চলকে আগুনে পোড়া থেকে বাঁচিয়ে এই ধীর প্রক্রিয়ায় কিছুটা গতি সঞ্চার করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, শিল্প অপসারণ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর বায়ুমণ্ডল থেকে কয়েক মিলিয়ন টন কার্বন দূর করতে পারে। তবে এখানে সমস্যা হলো, এই প্রক্রিয়া চালাতে প্রয়োজন শক্তি, যা উৎপাদন করতেও প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে কার্বন।
তাই কার্বন নিঃসরণ দূরীকরণের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, শিল্প ভিত্তিক প্রক্রিয়া এবং জৈবিক প্রক্রিয়ার মাঝে বিতর্ক। এ দু'টি উপায়ের কোনোটিই বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল এনে দিতে পারেনি।
এক্ষেত্রে আবার জিও ইঞ্জিনিয়ারিংও কাজ করতে পারে। তবে এই পন্থার অবদানও খুব বেশি চোখে পড়ার মতো নয়। প্রতি বছর দুই মিলিয়ন টনেরও কম সালফার বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে বিমানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা সূর্যের আলোতে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীর উত্তাপ কমাতে সহায়তা করে। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। প্রতি দু'বছরে একবার সালফার ছড়ানো যেতে পারে; এবং এই প্রক্রিয়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জড়িত।
বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত সালফার মেশালে তা আমাদের পৃথিবী এবং মানবজাতির জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
এছাড়া জিও ইঞ্জিনিয়ারিং বায়ু দূষণকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং বেশকিছু জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, বেপরোয়াভাবে জিও ইংজিনিয়ারিং-এর ব্যবহার উপকারের বদলে আরও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
জিও ইংজিনিয়ারিং এর বড় চ্যালেঞ্জ হলো জিও-পলিটিক্যাল বা ভূ-রাজনৈতিক গত সমস্যা। অর্থাৎ, কোন দেশ তার বায়ুমণ্ডলে কতখানি সালফার ছাড়বে এবং সেটি কতদিন পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে থাকবে এর একটি মান নির্ধারণ প্রয়োজন; তবে এই অস্থিতিশীল বিশ্বে সেরকম কোনো মান এখনও পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
তাহলে কোনটি সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে? কার্বন অপসারণ নিঃসন্দেহে স্থায়ী এবং সবচেয়ে নিরাপদ উপায়; তবে চলতি শতাব্দীতে সোলার জিও ইঞ্জিনিয়ারিং পরিবেশ ও সমাজের উপর সবচেয়ে কম প্রভাব রেখে এবং কম অর্থনৈতিক ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিশ্বকে শীতল করতে পারে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা পৃথিবীর উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে ও পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে রাখতে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব নেতাদের নিয়ে কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস) সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই মূলত বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধের বিভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় এবং তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সেই রূপরেখাও নির্ধারণ করা হয়।
চলতি শতাব্দীতে পৃথিবীকে শীতল করে মানুষের দুর্ভোগ কমাতে, কার্বন অপসারণ কিংবা সোলার জিও ইঞ্জিনিয়ারিং বা উভয়ই অত্যাবশ্যকীভাবে প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এই দুই উপায়ের মাঝে তুলনা করতে গেলে খুব বেশি কার্যকর ফলাফল আসবে না; কারণ বিষয়গুলোর সব দিক নিয়ে এখনও পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। তাই সমসাময়িক পরিবেশবাদে এর কোনো একটিকে বা উভয়কেই নিষিদ্ধ করা হবে ভয়াবহ ভুল পদক্ষেপ। এই মুহূর্তে, জলবায়ুর জন্য শুধু প্রয়োজন কার্বন নির্গমন কমাতে এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীকে শীতল করতে সম্ভাব্য সকল পথের অনুসন্ধান করা।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস