বার্মিজ ইতিহাসবিদ থান্ট মিন্ট ইউয়ের বয়ানে রোহিঙ্গা গণহত্যা
বার্মার (মিয়ানমার) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সে দেশের সামরিক বাহিনী (তাতমাদো) কর্তৃক জঘন্য গণহত্যার শিকার হয়েছে এবং একটি জাতিগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, একবিংশ শতাব্দীতে মিডিয়ার এই যুগে যখন এই জঘন্য গণহত্যা ঘটছিল (আগস্ট ২০১৭), তখন বার্মার জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে নৃশংস গণহত্যার তেমন কোন প্রতিবাদ বা সমালোচনা হয়নি বললেই চলে। বরং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের অনেকেই এ বিষয়ে সমর্থন, উৎসাহ দিয়েছে। সে দেশের অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ইতিহাসবিদ রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টিকে এক ধরনের ঘৃণা, সন্দেহ, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে দেখেছে। এক্ষেত্রে বার্মার ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক থান্ট মিন্ট ইউ একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তবে এটাও ঠিক যে, সেনা শাসনে নিষ্পেষিত বার্মিজ লেখকরা এ বিষয়ে লিখেছেনও খুব কম।
থান্ট মিন্ট ইউয়ের বিখ্যাত বই 'দি হিডেন হিস্টোরি অব বার্মা: রেস, ক্যাপিটালিজম এন্ড ক্রাইসিস অব ডেমোক্রেসি ইন দি টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি' (২০১৯) গ্রন্থের নবম অধ্যায়ে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা হত্যা ও নির্যাতনের বিষাদময় বয়ান রয়েছে। রোহিঙ্গা শব্দটিও তিনি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন। বলা যায়, এখানে লেখক তার সততার পরিচয় দিয়েছেন।
থান্ট মিন্ট ইউ: কম্বোডিয়ার সবুজ প্রান্তরে আমার দূরবর্তী সহকর্মী
১৯৯২-১৯৯৩ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কম্বোডিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত শান্তি মিশনে (আনটাক) আমি কাজ করেছিলাম। সেই সময়ে বার্মার তরুণ থান্ট মিন্ট ইউও কর্মরত ছিল আনটাকের মানবাধিকার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে। থান্ট মিন্ট ইউয়ের কথা আমি প্রথম শুনি কম্বোডিয়ার এক অনুন্নত মফস্বল ট্রামখানায়, আমাদের বার্মিজ নারী সহকর্মী ডাঃ মানমারের কাছ থেকে। বর্ণিল বার্মিজ পোশাক ও কালো চুলে ভরা মাথায় সাদা কাঠ গোলাপ শোভিত, প্রাণবন্ত ও মানবিক ব্যবহারের জন্য ডাঃ মানমার খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কখনো কখনো আমরা তাকে নমপেনের "অং সান সু চি" বলেও ডাকতাম।
নমপেন আনটাক ইনফরমেশন সেন্টার ও বিদেশীদের আড্ডায় থান্ট মিন্ট ইউয়ের সঙ্গে কয়েকবার দেখা ও কথা হয়েছে। কিন্তু কেন জানি ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তবে তার একটি বিশিষ্ট পরিচয় তখনো আমি জানতাম না। তিনি হলেন জাতিসংঘের প্রথম এশিয়ান সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের নাতি। নমপেনের লেনিন বুলেভার্ডের পুরনো এক ফরাসি ভিলায় মানবাধিকার বিষয়ক অফিসটি স্থাপিত হয়েছিল। থান্ট মিন্ট ইউয়ের অফিসে ঢুকেই চোখে পড়ত দৃষ্টিনন্দন কাঠ গোলাপ ও বর্ণিল রঙ্গন ফুলের গুচ্ছ।
থান্ট মিন্ট ইউয়ের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা আমেরিকায়। কম্বোডিয়ার পর তিনি আরও দুটি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে (যুগোস্লাভিয়া, বসনিয়া) অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষিত থান্ট মিন্ট ইউ ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্মায় চলে আসেন। ২০১১ সালের পর বার্মায় সেনা শাসন থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণে এবং বিশেষত বার্মা সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থিন সেইন (২০১১-২০১৫)-এর 'বিশেষ উপদেষ্টা' হিসেবে যুদ্ধরত বার্মিজ গেরিলা দলগুলোর যুদ্ধ বন্ধে পরিচালিত শান্তি প্রক্রিয়াতেও অবদান রাখেন।
'হিডেন হিস্টোরি অব বার্মাসহ' থান্ট মিন্ট ইউয়ের প্রকাশিত বার্মার ইতিহাস ও রাজনীতির উপর বইগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিমপেলের মতে, "থান্ট মিন্ট ইউ হলেন বার্মার শ্রেষ্ঠ জীবিত ইতিহাসবিদ"।
থান্ট মিন্ট ইউ এক সময় রেঙ্গুনের ডালহৌসি স্ট্রিটের (বর্তমান মহাবান্দুরেলা রোড) 'সুরতি ম্যানশনে' থাকতেন। উল্লেখ্য, এই কলোনিয়াল দালানটিতেই গত শতাব্দীর বিশের দশকে চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা দুই বছর বসবাস করেছেন। নেরুদা চিলির বাণিজ্যদূত হিসেবে (১৯২৭-১৯২৮) বার্মায় কাজ করেছেন। কবি তার দুর্ধর্ষ প্রেমিকা জোসি ব্লিসকে নিয়ে "মৃতদের তাঙ্গো নাচ" কবিতাটি লিখেছিলেন এখানে বসেই।
আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যা
বইটির নবম অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য (আনফিনিশড নেশান) এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
"কফি আনান ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে অং সান সু চি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের (কমান্ডার ইন চিফ) সঙ্গে দেখা করে রাখাইন বিষয়ে তাঁর প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে জাতিসংঘের এই সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, "যদি রাখাইন সরকার পরিচালিত ও সরকারের সব সেক্টর ও সমাজের সমর্থনে সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এখানে পুনরায় সহিংসতা ও রেডিকেলাইজেশনের পুনরাবৃত্তি আশঙ্কা করছি"। অং সাং সুচি কমিশনের সুপারিশগুলো গ্রহণ করেন ও সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর, ২৫ আগস্ট (২০১৭) গভীর রাতে উত্তর আরাকানের ৩০টি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)। প্রত্যেক আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা অংশগ্রহণ করে। তবে তাদের অল্প কয়েক জনের কাছেই গোলাবারুদ ছিল। অধিকাংশের কাছেই ছিল দেশীয় অস্ত্র ও দা। আরসার এই আক্রমণে ১০ জন পুলিশ, একজন সেনা সদস্য ও একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা নিহত হয়। সরকারি ভাষ্যমতে ৭৭ জন আক্রমণকারীও নিহত হয়। আরসা টুইট করে, "এটি হলো নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য ন্যায্য পদক্ষেপ।" আরসা এসময় কিছু আরাকানি বৌদ্ধ গ্রামসহ ম্রো ও দৈনাক অধ্যুষিত গ্রামের আক্রমণ চালায়।
এ ঘটনার পর, বার্মার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচণ্ড ভয়, ঘৃণা ও রাগে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একজন সিনিয়র অফিসিয়াল আমাকে জানান, "ইসলামী সন্ত্রাসীরা সমগ্র উত্তর আরাকান দখল করেছে, মংডু ও বুধিডংয়ের পতন হয়েছে"।
আসলে এটা মোটেই সত্য ছিল না। কিন্তু অমুসলমানদের প্রতি আরসার নৃশংসতা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। "পশ্চিম দ্বারের" শত্রুদের ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি জোর দাবী ওঠে।
এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ংকর ও নির্মম।
"কোনো গোলযোগ হলেই সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া আছে। যদি তোমাদের গ্রামবাসী শান্তিপূর্ণভাবে বাস না করে, তাহলে আমরা সব কিছু ধ্বংস করে দিব"। এটি ছিল আগস্টের শেষে ইন চিন গ্রামের (মংডু টাউনশিপ) একজন রোহিঙ্গার সঙ্গে একজন বার্মিজ সেনা অফিসারের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামটিকে সত্যি সত্যিই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই বর্বর যুদ্ধ সেপ্টেম্বর (২০১৭) পর্যন্ত চলে, যেখানে হাজার না হলেও শত শত মানুষ নিহত হয়।
জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, বার্মিজ সেনাবাহিনী অন্তত তিনটি গ্রামে হত্যাকাণ্ড চালায়। মূলত পুরুষরা লক্ষ্যবস্তু হলেও বেশ কিছু নারী ও শিশুও নিহত হয়। আরসা যে গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেছিল, সেই গ্রামগুলোতেই হত্যাকাণ্ড ঘটে। অন্তত আরও চারটি গ্রামে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। প্রতিটি গ্রামে অন্ততপক্ষে ৭০ জন করে রোহিঙ্গা নিহত হয়। এই গ্রামগুলোতে আরসার প্রভাব ছিল। এটি ছিল বিদ্রোহী আক্রমণের জন্য সমষ্টিগত শাস্তি। অধিকাংশ গ্রামবাসী পাশের গ্রামের সহিংসতা দেখে পালিয়ে যায়, সেনাবাহিনী ও আরাকানি মিলিশিয়া আসার আগেই।
পরবর্তী দিনগুলোতে সেনাবাহিনী বা আরাকান বৌদ্ধ মিলিশিয়া অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। এসময় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক গ্রাম থেকে পালিয়েছে।
কত মানুষ নিহত হয়েছে, তা বলা কঠিন। কেননা এখানে স্বাধীন তদন্ত বা মূল্যায়ন এখনও হয়নি এবং ফরেনসিক দলকে এলাকায় আসতে দেওয়া হয়নি। ফরাসি সাহায্য সংস্থা মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ার্স এর মতে, ১৭'র ডিসেম্বরে কমপক্ষে ৬৭০০ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। নিহত সংখ্যার এই মূল্যায়নটি বাংলাদেশে প্রবেশ করা শরণার্থীদের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই সংখ্যাকে স্যাটেলাইট ইমেজারির সঙ্গে মিলিয়ে সত্যতা প্রমাণ করেছে। তবে যথাযথ তদন্ত ছাড়া এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
সবচেয়ে জঘন্য ঘটনাটি ঘটে নদী পাড়ের গ্রাম তোলাতুলিতে। এই গ্রামেই সরকারি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল আরসা। পুড়িয়েছিল একটি ম্রো গ্রাম, যাতে নিহত হয় ৬ জন। ৩০ আগস্ট, ২০১৭ এর মধ্যে সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া একত্রে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে, শত শত রোহিঙ্গাকে সামুদ্রিক জলবেষ্টিত উপদ্বীপের দিকে দৌড়াতে বাধ্য করে। তাদের অধিকাংশই সাতার জানত না, ফলে তারা সেখানে আটকে পড়ে। হত্যার আগে পুরুষ ও বড় ছেলেদের আলাদা করা হয়। কিছু নারী ও শিশুও গুলিতে আহত হন। অনুমান করা হয়, এখানে শতাধিক রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে।
এর দুই দিন আগে, সেনাবাহিনী ও আরাকান মিলিশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী ইন ডিন গ্রামে উপস্থিত হয়। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ও নিকটবর্তী পাহাড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১ সেপ্টেম্বর শত শত রোহিঙ্গা, যারা আগের দিন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে পালিয়েছিল, সমুদ্রতীরে এসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে ১০ জনকে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে হত্যা করা হয়।
পশ্চিমা ও ইসলামি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ। নিউইয়র্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেন "বার্মায় একটি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে ধ্বংসের জন্য নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে"। অন্যদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন "এটি মানবাধিকারের দুঃস্বপ্ন"। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান দাবি করেন, এখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছে।
মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী, যাদের প্রায় সবাই মুসলমান, বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এদের অনেকেই অনাহারে দিনের পর দিন হেঁটেছে। এটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থীদের একক বৃহত্তম পলায়ন। অবশেষে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে অং সান সুচি তাঁর নীরবতা ভাঙেন। নাইপিদোতে কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া টেলিভিশন বক্তৃতায় তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যে কাহিনী প্রচারিত হচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন,"গত দুই সপ্তাহে কোন সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়নি। রাখাইনের অধিকাংশ মুসলমান পালিয়ে যায়নি, যা প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি এত খারাপ নয়, যতটা বলা হচ্ছে"।
অং সান সুচি আরও বলেন, যারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের দেশে স্বাগত জানানো হবে। বহির্বিশ্বে অবশ্য খুব কম মানুষই এ প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করল। আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা বেড়েই চলল।
বার্মার অভ্যন্তরে দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ভিন্নই নয়, পুরাপুরি উল্টা ছিল। বার্মার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করল যে আরসা বার্মার জন্য প্রকৃত বিপদ। এই বাহিনী আরাকানে অমুসলিমদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। বার্মায় ফেসবুক ভরে যায় আরাকানে নিহত হিন্দু ও বৌদ্ধদের ছবিতে। রেডিও ষ্টেশনগুলো আরসার আক্রমণে বেঁচে যাওয়া আহত ব্যক্তিদের ক্রন্দনরত সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করতে শুরু করে। যে কারণে অধিকাংশ জনগণ আরসা উৎখাতে পরিচালিত সেনা অভিযানে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
কিয়কপুর অধিবাসী আই আই সো (যেখানে পাঁচ বছর পূর্বে দাঙ্গা হয়েছিল) এলাকাবাসীদের বলতে শোনেন, "সেনাবাহিনী ২০১২ সালে এভাবে আমাদের রক্ষা করেনি কেন?" খুব কম বার্মিজই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখ থেকে বেরোনো নৃশংসতার বুলি বিশ্বাস করল। অনেকে বলল, "এখন তো সবার কাছে স্মার্টফোন আছে, তাহলে সেখানে ছবি বা ভিডিও নেই কেন?" কেউ বলল, "কেন পশ্চিমা সরকার গণকবরের স্যাটেলাইট ইমেজ দিতে পারল না?" অনেকে বলল, "এটা বহুবছর ধরে বার্মায় পরিচালিত সেনা কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনের চেয়ে বেশি কিছু নয়।"
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাং অনেকগুলো আপোষহীন বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাগুলোতে তিনি তার দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দেন ও "১৯৪২ সালের অসমাপ্ত কাজ" সম্পন্ন করার কথা বলেন। অর্থাৎ, দেশের প্রতিরক্ষায় দুটি হুমকি- বাঙালি ইমিগ্রেশন ও মুসলিম বিদ্রোহ। ফেসবুকে জেনারেলের ফলোয়ার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ইসলামি আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর দেয়াল নির্মাণের জোর আওয়াজ উঠে। অং সান সু চি সরকার ও সেনাবাহিনী উভয়ই এটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন এবং এক্ষেত্রে প্রধান ব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে বলেন। খুব কম বার্মিজই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বিশ্বাস করে। বরং এ বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষপাতিত্বের জন্য অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আঞ্চলিক সরকারগুলো অধিকাংশই বার্মার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এই হত্যার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করতে অসম্মতি জানান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্মিজরা অনুমান করতে শুরু করে, আরসার সহিংসতার বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকার না করাটা সৌদি-পশ্চিমা বিশ্ব পরিচালিত একটি প্লট। এর উদ্দেশ্য হল, আরাকানকে অস্থির করা এবং বার্মাকে হাজার হাজার নতুন বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের গ্রহণ করতে বাধ্য করা।
ওয়াশিংটন পোষ্টের সাংবাদিকদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলাপকালে অং সান সু চি বলেন, 'পুরা বিষয়টি একটি অর্থহীন দীর্ঘ কাহিনী'। ২০১৭'র শেষের দিকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর প্রায় অর্ধেকই শিশু। বার্মা সরকার প্রথমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দাবি করা জাতিগত নিধনের দাবির বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এটার অভ্যন্তরীণ সমালোচনার কথা ভেবে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
আরাকানে সর্বশেষ জঘন্য ভয়ানক সহিংসতা শুরু হয় ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপর আরসার আক্রমণের মধ্য দিয়ে। আর এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও নৃশংসতা বিশ্বকে হতভম্ব করে। কিন্তু যা ঘটে তা ইন্সারজেন্সি ও কাউটার ইন্টারজেন্সি থেকে বেশি। এই সংকটের মূলে রয়েছে রক্ত (ব্লাড) ও তার সম্পর্ক (বিলোগিং) এর বিষয় যা, প্রথমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় নামিয়েছে এবং পরবর্তীতে উদীয়মান গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
এই পরিস্থিতিতে বার্মা সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যারা পুরনো নাগরিকত্ব সনদপত্র দেখাতে পারবেন। তবে এটা পরিষ্কার নয় কোন সাক্ষ্য প্রমাণ গৃহীত হবে। যাই হোক, আরাকানে এখনও কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তারা ক্যাম্পে হতাশাপূর্ণ জীবন-যাপন করছে, যেখানে সাহায্য খুব সীমিত। এই ক্যাম্পগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই, আন্তর্জাতিক তদন্তের অনুমতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজ থেকে খুব শীঘ্রই বার্মায় ফিরতে চাইবে, এমন সম্ভাবনা কম।
ভবিষ্যতে যদি রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে আসে, তবে তারা পরবর্তীতে অন্য এক দৃশ্যপটে ফিরবে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে পুড়ে যাওয়া অনেক গ্রামকে বুলডোজার দিয়ে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। উত্তর আরাকানের সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বাড়াতে নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বার্মার অনেকে মনে করে, বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত এলাকাটি অবৈধ চলাচল, অপরাধ ও জঙ্গি সহিংসতার স্থান। এজন্য তারা বিশ্বাস করে, এ অঞ্চলকে বাঙালি-মুক্ত করা ও এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। উপযুক্ত ভেরিফিকেশন শেষে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বসতি স্থাপন করানো হবে সীমান্ত এলাকা থেকে অনেক দূরে।
থান্ট মিন্ট ইউকে ধন্যবাদ
থান্ট মিন্ট ইউয়ের লেখায় রোহিঙ্গা ও আরাকান বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। লেখক এ বিষয়ে সেনাবাহিনী ছাড়াও আরাকানের রাখাইন সম্প্রদায় (বৌদ্ধ), বার্মিজ সরকার, অং সান সু চি ও সাধারণ বার্মিজ জনগণের মতামত, প্রতিক্রিয়া প্রায় নির্মোহভাবে তুলে ধরেছেন। ধারণাটি সত্য বা মিথ্যা হোক, রোহিঙ্গা নিয়ে পশ্চিমদ্বার, বাঙালি বসতি স্থাপনকারী ও ইসলামী আগ্রাসন নিয়ে সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায় ছাড়াও সাধারণ বার্মিজদের উদ্বেগ রয়েছে।
অথচ বাংলাদেশে এই বিষয়ে তেমন আলোচনা নেই। বার্মা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং তার ঐতিহাসিক পরম্পরা বিষয়ে আমাদের জানা-শোনা অত্যন্ত সীমিত। তাই আমাদের বার্মা চর্চা বাড়ানো জরুরী। আরসার বিষয়ে এখানে লেখা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র দ্বারা রাখাইনে এই সংগঠনের উপস্থিতি ও কার্যক্রম শনাক্ত করা যায়নি।
রোহিঙ্গা গণহত্যার পর অং সান সু চি পশ্চিমা বিশ্বে ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সু চির এই অমানবিক পদক্ষেপগুলো আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে, যা ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে প্রকৃতিই যেন অবশেষে এক ধরনের প্রতিশোধ নিয়েছে। ২০২১ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বার্মায় সেনা অভ্যুত্থান হয়। সেনাবাহিনী সু চি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বার্মায় ব্যাপক সহিংসতা ও নাগরিক অসন্তোষ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহী যোদ্ধাদের লড়াই চলছে। গণতন্ত্রপন্থীরা গড়ে তুলেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামের প্রতিরোধ বাহিনী। গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐক্য সরকার। সমগ্র বার্মায় এখন গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
সু চি এখন বন্দী, বিচারের মুখোমুখি। এনএলডি দলের অধিকাংশ নেতা ও মন্ত্রী হয় জেলখানায়, না হয় এক ধরনের বিপন্ন শরণার্থী। ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অসংখ্য উগ্র জাতীয়তাবাদী বার্মিজ নাগরিক ফেসবুকে নিষ্ঠুর সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাংকে রোহিঙ্গাদের হত্যায় উৎসাহ যুগিয়েছিল। সেই দুর্ধর্ষ জেনারেলের আদেশেই ইতোমধ্যে কমপক্ষে এক হাজার বার্মিজ গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদকারী নিহত হয়েছে।
একজন বিবেকবান নাগরিক বা মানবিক কারণ ছাড়াও রোহিঙ্গা ও আরাকান বিষয়ে আমার এক ধরনের স্মৃতিকাতরতা রয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে (বিডিআর) কর্মরত থাকাকালীন কয়েকবার বার্মার মংডু ও তুমব্রু এলাকায় গিয়েছি। বার্মা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সৌজন্যে ইউএনএইচসিআরের গাড়িতে আরাকানের ভেতরে মাইলের পর মাইল দেখেছি। এটি ছিল বিরল এক অভিজ্ঞতা। আমার দেখা রোহিঙ্গাদের সেই সবুজ জনপদ, গ্রাম, নদী, ধানক্ষেত এখন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো গ্রামকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাহীন এ অঞ্চলে এখন শুধুই কবরের নীরবতা। আরাকান এখন কম্বোডিয়ার মতোই এক বিশাল বধ্যভূমি।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ থান্ট মিন্ট ইউ বর্তমানে নিউইয়র্ক নিবাসী। দুঃখজনকভাবে, তিনি নিজেই এখন একজন দেশহীন বিপন্ন নাগরিক। বাইরে থেকেই তিনি এখন নিজ দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের জন্য এক ধরনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৩ সালের পর থেকে আমার এই জাতিসংঘ সহকর্মীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। দেশটির গৃহযুদ্ধের এ সময়ে, কম্বোডিয়ার আমার আরেক বার্মিজ সহকর্মী ডাঃ মানমার কি অবস্থায় আছেন, তাও জানি না। তবে ফেসবুকে থান্ট মিন্ট ইউকে ফলো করি। তার সঙ্গে দেখা হলে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য আন্তরিক সমর্থন দিতাম। আর রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নির্মোহ ও সাহসী লেখার জন্য তাকে খেমার ভাষায় (কম্বোডীয়) বলতাম, 'আকুন'; অর্থাৎ 'আপনাকে ধন্যবাদ'।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক ময়দানে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে দিন দিন আরও জটিল হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা সমস্যা। এর জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন সঠিক রণকৌশল, দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি; একই সঙ্গে জরুরী প্রয়োজন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর "ডেটারেন্স" অর্জন। কারণ, শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট কূটনীতিই কার্যকর হয়। এ সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য বার্মাকে বাধ্য করতে হবে।
রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ বিষয়ে বার্মার সেনাবাহিনী, সরকার ও জনগণের ভাবনাগুলো জানা প্রয়োজন। নাফ নদীর ওপারে কী ঘটছে তা আমাদের জানতে হবে। সুউচ্চ মায়ু পর্বতমালার ওপারে বার্মার শাসকগোষ্ঠী ও নাগরিকরা কী ভাবছে, তা জানতেই হবে। থান্ট মিন্ট ইউয়ের মতো বার্মার লেখক, গবেষক বুদ্ধিজীবীরা কী লিখছেন, কী ভাবছেন, তা জানতেই হবে। তা না হলে আরও দুঃখ, ঝামেলা ও সমস্যা অপেক্ষা করছে। তাই আমাদের বার্মা চর্চা বাড়ানো জরুরী। একই সঙ্গে, ভারত ছাড়া একমাত্র সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী বার্মা সম্পর্কে কেন এতদিন আমরা প্রায় ঘুমিয়ে ছিলাম; অজ্ঞ, উদাসীন ও বিচ্ছিন্ন ছিলাম তার নির্মোহ আত্ম-জিজ্ঞাসাও করতে হবে। শুরু হোক বার্মাকে চেনা, জানা ও জানানোর নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযান। তবে এই কাজ শুধু সরকারের নয়, নাগরিকদেরও।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।