বড় সঙ্কটে মধ্যবিত্ত, তারাও মনোযোগ দাবি করে
নভেল করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা আজ স্পষ্ট। মানুষ বুঝেছে, যদি এবার তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, তাহলে তাদেরকে অনেককিছুই করতে হবে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি কেমন হবে, কীভাবে এই আর্থিক মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে- তা নিয়ে প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদের মতো করে পলিসি তৈরি করছে; দিচ্ছে প্রণোদনা। মানুষকে সাহায্য করে কীভাবে সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসা যায়, সেটাই এখন সব সরকারের প্রাধান উদ্দেশ্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, সেটি যথাযথ ও সতর্কভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে এবং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার মূলত চারটি কৌশল অবলম্বন করবে- (ক) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি; (খ) আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ প্রণয়ন; (গ) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি; এবং (ঘ) মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি।
তাছাড়া এই চারটি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে- (১) ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া; (২) ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া; (৩) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো; (৪) প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম প্রণয়ন করা।
সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সামগ্রিক অর্থনীতিতে ধনাত্মক প্রভাব তৈরি করবে, এই প্রত্যাশা করি। তবে এই প্রণোদনা সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা আরও বাড়বে। কারণ এই প্যাকেজের একটা বড় অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করা হবে এবং সেটা হবে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে; তার অর্থ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো তাদের বর্তমান গ্রাহকদের মধ্যে যারা পরীক্ষিত, তাদেরকে ঋণ দিবে। তারাও যেহেতু ভর্তুকি পাবেন, এই সুযোগ হাতাছাড়া করতে চাইবেন না। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্যই আছেন, যারা এই প্যাকেজের সুবিধা না গ্রহণ করলেও টিকে থাকতে পারতেন। অন্যদিকে, যাদের ব্যাংকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই, কিন্তু এই দুঃসময়ে একটু সহযোগিতা হলে টিকে থাকতে পারতেন, তাদের কিন্তু ঋণ পাবার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ; কারণ, ব্যাংকগুলোর ওপর এই ঋণ দেওয়ার তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যাহোক, তবু এই প্রণোদনা অর্থনীতিতে গতি আনতে কিঞ্চিৎ হলেও সহায়তা করবে বলে মনে করি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খুবই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে এবং কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে।
অন্যদিকে, সরকার তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তৈরি পোশাকশিল্পে যে ৪১ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন, তাদেরকে সাহায্য করবার জন্য। এই প্রণোদনা খুবই আকর্ষণীয় এবং সময়োপযোগী- তাতে সন্দেহ নেই; কারণ, আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে এই তৈরি পোশাকখাত থেকে। আমার মনে হয়, এই প্রণোদনা সবাইকে ঢালাওভাবে দেওয়ার দরকার নেই। এটা জাতির জন্য একটা ক্রান্তিকাল। এই সময় যাদের অতীব প্রয়োজন, তারাই সরকারি প্রণোদনা নেবেন।
সম্মানিত পাঠক, আপনারা কি মনে করেন যারা এতকাল ধরে তৈরি পোশাকখাতে ব্যবসা করছেন, তাদের অধিকাংশই দুই-তিন মাসের খরচ চালাতে পারেন না? উত্তর হবে, অধিকাংশই পারেন। জানি অনেকেই পারবেন না। ঋণ না পেলে তারা কোনোভাবেই বেতন-ভাতা দিতে পারবেন না; কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হবে, রাস্তা ব্লক হবে, মারামারি হবে। সরকারের কাছে এই তথ্য আছে, কারা সামর্থ্যবান আর কারা অসামর্থ্য। সরকারের উচিত যারা সাহায্য না পেলে চলতে পারবেন না, সত্যি কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন, তাদের এই প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা। শুধু মুখ চিনে, শুধু ভালো সম্পর্কের কারণে, সরকারি উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ থাকার কারণে তারা এই সুবিধা নিবেন, এমনটি হওয়া উচিত নয়। তাছাড়া অন্যান্য শিল্পের কথাও, বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের দিকেও সরকারকে সমান নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
সরকার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করবে। পূর্বের চেয়ে বেশি মানুষকে এর আওতাভুক্ত করবে। তাতে অন্তত অনেক মানুষ উপকৃত হবে। মোট কথা হচ্ছে, যদি আমরা প্রণোদনাটা দেখি, তাহলে সমাজের নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সরকার থেকে সাহায্য পাবেন। কেউ হাত পেতে নিবেন, কেউবা অনেকটা জোর করে আদায় করে নেবেন।
কিন্তু সমাজে আর একটা শ্রেণি আছে, যারা মধ্যবিত্ত। তাদের আবার দুটো শ্রেণি আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্ত। এরা সংখ্যায় কম নয়, বরং অধিক। তাদের অবস্থা কী?
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩৭ মিলিয়নের অধিক- যাদের প্রতিদিনের মাথাপিছু আয় ২ থেকে ২০ ইউ এস ডলার। এরা সমাজ বিনির্মাণে এবং সমাজকে টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দেশের মানুষের মূল্যবোধ, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনকানুনসহ নানাবিধ বিষয়ে তাদের খেয়াল, অংশগ্রহণ ও ভূমিকা অনিবার্য এবং অনস্বীকার্য। তাদের সবচেয়ে বড় একটা সমস্যা হচ্ছে তাদের 'আত্মসম্মানবোধ'। সম্মান তাদের কাছে বড়। তারা অন্যের দুঃখে কাঁদেন, অন্যের সঙ্গে ব্যথা ভাগ করে নেন, প্রয়োজনে দেশের জন্য রক্ত দেন। তারা অন্যের কাছে হাত পাততে চান না। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতে পছন্দ করেন, নিজের দুর্বলতা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চান না। তাই এই সমাজ দেখতে পায় না তাদের দুঃখের উপাখ্যান। তারা দুঃখও লুকিয়ে রাখেন, যেমন করে দুর্নীতিপরায়ণেরা মাটির তলায় বা বিদেশি ব্যাংকে অবৈধ অর্থ-সম্পদ লুকিয়ে রাখে।
যেহেতু তারা কষ্টের কথা বলতে ইচ্ছুক নন, নিজের বুকের মধ্যে রাখেন নিজের কষ্ট লুকিয়ে, তাই তারা বঞ্চিত থাকেন। সমাজ তাকে বঞ্চিত করে; রাষ্ট্র তার পাশে থাকে না। হয়তো রাষ্ট্র তাদের কষ্টকে অনুধাবনই করে না। অথচ তারা ভেঙে যান, সমস্যায় জর্জরিত হয়ে থাকেন, অভাবে কষ্ট পান। এই যেমন করোনার কারণে মানুষ এখন একপ্রকার ঘরবন্দি, কাজ নেই, আয় নেই। অনেকের হাতে যা পয়সা ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। যাদের হাতে কিছু নেই, তাদের খাবার কষ্ট শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকায় দেখেছি অনেকে গরিব মানুষের পাশাপাশি সাহায্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন; কিন্তু তাদেরকে পোশাক-আশাকে যথেষ্ট গরিব নয় বলে সাহায্য দেওয়া হয়নি। ভদ্রলোকেরা মন খারাপ করে বেরিয়ে গেছেন নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে। এমন অনেক তথ্য আশেপাশে আছে আমাদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদের ব্যাপারে বলেছেন, কিন্তু এরা অনেকেই জানেন না কীভাবে কোথায় তাদের যেতে হবে সাহায্যের জন্য।
যারা অল্প বেতনের চাকরি করেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেন, ছোট ব্যবসা করেন, তাদের বিপদ তারা নিজেরাও। কারণ, এরা বিশ্বাস করেন না যে তাদের কেউ সাহায্য করবে। এখানে সরকারের দায়িত্ব আছে। এখন সময় একটা ডাটাবেজ তৈরি করে এই সকল মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই শ্রেণিটির সাহায্য হিসেবে প্রয়োজন নগদ টাকা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তাদের এই সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। সরকার হিসেব করে একটা তহবিল গঠন করতে পারে, যা দিয়ে এই শ্রেণির লোকদেরকে সাহায্য করা যায়। তাহলে সমাজের সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের সহায়তার আওতায় আসবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত ১০ বছরে আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে অতি গরিব বা হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে। সব মিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া তিন কোটি মানুষ।
আমরা জানি, গত প্রায় এক দশক ধরে এশিয়ান অর্থনীতিগুলোর বড় চালিকা শক্তি এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের হার ধীরে ধীরে বাড়ছে। মধ্যবিত্তের হার বাড়া মানে দারিদ্রের হার কমে আসা-যারা আগে দরিদ্র ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কিছু মানুষ এখন দারিদ্রের চক্র থেকে বের হয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে যোগ দিচ্ছেন। বিবিএস'র জুন ২০১৯ সালের হিসেব মতে, জুন মাসের শেষে দেশের দারিদ্র্য হার সাড়ে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের জুন মাস শেষে এই হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত জুন শেষে অতি দারিদ্রের হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে। এক বছর আগে এর হার ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমান এই সঙ্কটে যদি নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা আর্থিক সহায়তা না পান বা এই লকডাউন আরও লম্বা সময় ধরে দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে এই শ্রেণিটি আবার হতদরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারেন- যা সমাজ ও অর্থনীতির জন্য আদৌ ভালো সংবাদ নয়।
করোনা ভাইরাস সব দেশের হিসাব নিকাশ উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। আইএমএফ-এর ধারণা, এশিয়ান অর্থনীতির হয়তো এবার কোনো প্রবৃদ্ধি হবে না। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কত হবে, আমরা জানি না। প্রবৃদ্ধি নির্ভর করছে এই স্থবির অবস্থা কতদিন থাকে তার ওপর।
তবে বাংলাদেশের যে বিরাট মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে, তারা যদি সরকারের মনোযোগ থেকে সরে যায়, তাহলে অর্থনীতির সব হিসাব উল্টে যেতে পারে। তাই সরকারকে বলি, শুধু উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত নয়, সবাই মধ্যবিত্ত নিয়ে একটু ভাবুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামাজিক বিপর্যয়ে, এই সর্বনাশা সঙ্কটে তাদের পাশে দাঁড়ান। এই সমাজ বিনির্মাণে এবং অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে তাদের ভূমিকা অনিবার্য।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল