মধ্যরাতের ঘটনা কি আসল ঘটনাগুলোকে আড়াল করে দেয়!
হঠাৎ করেই দেশে একটি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। দেশের একজন চলচিত্র অভিনেত্রী নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের চেষ্টা এবং হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করলেন।
যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দেশের প্রখ্যাত সামাজিক সংগঠন উত্তরা ক্লাবের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে বোট ক্লাবের সদস্য ও সাবেক সভাপতি। সংবাদ সম্মেলন করা হয় ১৩ জুন রাতে। আর ঘটনা ৮ জুন মধ্যরাতের। সংবাদ সম্মেলনের পর দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। ১৪ জুন সকালেই আশুলিয়া থানায় মামলা নেয়া হয়। মামলা গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার, মাদক উদ্ধার, অভিযুক্ত, মদ ও মাদকের ফটোসেশন এবং সকল গণমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া।
এরপর সারাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াসহ গণমাধ্যম ভীষণ তৎপর হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রগুলোয় কে নিউজটাকে কতটা গুরুত্ব দেবে তা নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা গেল। টেলিভিশনগুলোর টকশোতে নানা আলোচনা স্থান পেল। পরের দিন ফলোআপ নিউজ করা হলো। গণমাধ্যমগুলোর কাছে 'সংবাদ মূল্য' বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর নির্ভর করে, পাঠক-দর্শক জনপ্রিয়তা। এই পাঠক-দর্শক জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটতে যেয়ে কোনো বিষয়কে অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে কিনা বা কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেল কিনা তা দেখা, গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম নীতি। কেউ যেন মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার না হন।
অভিযোগ প্রমাণের আগে অভিযুক্তের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার, উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্বেও সেটি প্রায়ই উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেকটা 'সরকারি প্রেসনোটের' ভাষায় চলে। এক সময় ছিল, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কাছে অকেজো অস্ত্র বা গুলির খোসা পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যায়, ইয়াবা বা ওই জাতীয় অন্য কিছু। অভিযুক্তরা প্রচুর বিদেশী মদ ও অন্যান্য মাদকসহ গ্রেফতার হন। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন হয় ও পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। মামলাগুলো এ রকম একটি 'চেনা' পথেই এগিয়ে চলে। পথ খুব 'চেনা' বলে মানুষ এখন আর খুশি হয় না বরং আতঙ্কিত হয়। খুশি হওয়ার মত তথ্য নেই।
আমাদের জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে। নানা কারণে এবারের বাজেট মানুষের মনোযোগের মধ্যে রয়েছে। করোনা মহামারি জাতীয় অর্থনীতিসহ ব্যক্তি পর্যায়ের জীবন ও জীবিকার চরম সংকটকালীন সময়ে জাতীয় বাজেট কেমন হয়, তা নিয়ে সকলের আগ্রহ রয়েছে। করোনা স্বাস্থ্যবিধির প্রয়োজনে এক তৃতীয়াংশ সদস্য নিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে সংসদ পরিচালিত হচ্ছে। সদস্যদের আলোচনার জন্য বরাদ্দকৃত সময় কঠোরভাবে মেনে চলা হচ্ছে। সে রকম একটি অধিবেশনে একটি নির্দিষ্ট ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যা চেষ্টার কথিত অভিযোগ নিয়ে লম্বা সময় ধরে আলোচনা কোনো বিশেষ বার্তা দেয় কিনা! আমরা যদি সত্যি নারী নির্যাতনের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা ও নারীর প্রতি যে কোনো সহিংসতা প্রতিরোধ করতে চাই তা হলে, সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডার বা অনির্ধারিত আলোচনায় সমাধান পাওয়া যাবে না।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের শেকড় অত্যন্ত গভীরে। সমাজের এমন কোন পর্যায় নেই যেখানে নারী নির্যাতন নেই। ঘরে, বাইরে, রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে এমন কি ধর্মীয় উপাসনালয়েও নারী নিরাপদ নয়। এই করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজ গৃহেই নির্যাতন এখন সব চেয়ে বেশি। মানবাধিকার রক্ষা, লিঙ্গসমতা, সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি আইনগত সহায়তা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর প্রকাশিত রির্পোট মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই চিত্র তুলে ধরে। দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং অনলাইন পোর্টালগুলোর প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে নারীর প্রতি সহিংসতা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর পিরিয়ডিক রির্পোটও প্রকাশ করে থাকে।
মানবাধিকার লংঘনের অন্যান্য দিক বাদ দিয়ে কেবল যদি নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র দেখি, তা হলে তা চমকে ওঠার মতো। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যে রির্পোট প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত ৫ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে ৫০২টি। এর মধ্যে ২২জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ১০৪টি ধর্ষণ চেষ্টা এবং এই প্রেক্ষিতে ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই সংখ্যাগুলো কোন না কোন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখান থেকে অনুমান করা যায়, গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি এমন সংখ্যা তাহলে কত! সামগ্রিক চিত্র নিয়ে কোন আলোচনা বা তার কোন উদ্দ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না।
যে সময়টাতে চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর সংবাদ সম্মেলন বা জাতীয় সংসদে নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই সময়ে আর একটি ঘটনা ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করে, এখন থেকে কোন নারী কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গার্ড অব অনার দিতে পারবেন না। কারণ, তিনি নারী যা ধর্মীয় দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলন ওই ঘটনাকেও ছাপিয়ে যায়। ক্লাবগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। সমাজ গঠনে এই সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোন ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল শহরের ক্লাব কোন কোনটার বয়স ১০০ বছরের অধিক। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে এরকম ক্লাব দেখা যায়। যারা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ রকম প্রতিটি ক্লাব তার নিজস্ব বিধি-নিষেধের আওতায় পরিচালিত হয়। এবং এসব বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার কথা। কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা বা বেপরোয়া আচরণের স্থান হওয়ার কথা না।
কিন্তু কী হয়? একটা বড় দুঘর্টনা ঘটার পর আমরা জানতে পারি, গাড়িটির ফিটনেস ছিল না। শত মানুষের সলিল সমাধি ঘটলে জানা যায়, লঞ্চটির যাত্রী পরিবহনের কোন অনুমোদন ছিল না। ঢাকার ক্লাবগুলো নিয়েও একই ভাবে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ যেন সমাজের উঁচু স্তরের ব্যাপার, সাধারণের না জানলেও চলবে। দখল পাল্টা দখল।
হঠাৎ পুলিশ ও মাদক অথবা ভ্যাট কর্তাদের অভিযান। বিপুল মদ ও মাদক জব্দ, সরকারের বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত ইত্যাদি। সেই চেনা পথ, চেনা কথা। প্রথম লাইন পড়লে পরের তিন লাইনে কি আছে তা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। এই ক্লাবগুলো কারা স্থাপন করেন, কারা অনুমোদন দেন, কারা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন, আমরা জানি না।
অভিযোগ আছে, নদীর জায়গা দখল করে অথবা অন্য কারো স্থাপনা দখল করে কোন কোন ক্লাব গড়ে উঠেছে। কোনোটি আবার আবাসিক প্লটেই স্থাপিত। এগুলো যাদের দেখভাল করার কথা, তারা সেটা করেন বলে মনে হয় না। বা রাখতে পারছে কিনা তা দেখা দরকার। আমাদের যুবা-তরুণদের দেখি ক্লাবগুলোতে ভিড় করতে। রাতে তারা এ ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। আকণ্ঠ মদ পান করছেন, নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। যুব সমাজের জন্য একদিকে মাদকের ভয়াল থাবা অন্য দিকে অ্যালকোহলিক হবার যে প্রবণতা- এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে।
একটা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল থাকাটা জরুরি। গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ যদি হয় ভোটের মাধমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, তাহলে তারপরের পাঠ অবশ্যই রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালীকরণ। সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতির বিকাশ সাধন। এর ঘাটতিগুলো চিহ্নিত না হলে উন্নয়নগুলো সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না। গণতন্ত্রের প্রকৃত পরিধি কমতে কমতে 'সীমিত' গণতন্ত্র বা 'নিয়ন্ত্রিত' গণতন্ত্রে পরিনত হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক