সাংবিধানিক পদগুলোর জন্য সংবিধানের নির্দেশিত আইনটি ৫০ বছরেও হলো না!
নিরুত্তাপ রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ চাঞ্চল্য। গতমাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এক দলীয় আলোচনায় আগামী নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় স্বাভাবিক কারণেই অন্যান্য দল নড়েচড়ে বসে। একই সাথে প্রস্তুতি নিতে না পারলে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো ধারাবাহিক মিটিংয়ের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সংগঠিত করা ও মতামত নেবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে চলমান এই আলোচনার সাথে যুক্ত হয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া নিয়ে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই সময়ের মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আলোচনা এমন সময় সামনে এলো যখন আবারো আর একটি এডহক ব্যবস্থা ছাড়া স্থায়ী ও সর্বজনগ্রাহ্য কোন ব্যবস্থায় যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে সব মহল একটি দায়সারা অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। সকলে বলছেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারের ওপর দায়টা বেশি। আর অন্যদের 'শীত ঘুম' ভঙ্গলো এমন সময় যখন একটি নতুন আইন তৈরি করে সেই আলোকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া কতটা সম্ভব সেটা নিয়ে আর একটা বিতর্ক হতে পারে।
আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারার (১) উপ-ধারায় বলা আছে, আইনের বিধানাবলীর আলোকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দিবেন। রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়। সংবিধানের ৪৮ ধারার (৩) উপধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে কাজ করবেন। সে কারণেই সেই পুরাতন আলোচনা নতুন করে সামনে আসছে। কীভাবে গঠিত হবে কমিশন, কারা থাকবেন কমিশনে, কীভাবে বাছাই করা হবে এমন সব প্রশ্ন। ইতোমধ্যে সরকারের এক দায়িত্বশীল মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এতো ভাববার কিছু নেই। গত দুইবার যেভাবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশনের তালিকা তৈরি হয়েছে এবারো তাই হবে। ক্ষমতাসীন একাধিক নেতা খুব জোরের সাথে বলছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে অনুসন্ধানের কাজটি গণতান্ত্রিক রীতির অংশ এবং এটাও একটি "আইনী" প্রক্রিয়া।
গত দুটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধভাবে করলেও বর্তমানে বিরোধী আসনে বসা জাতীয় পার্টির নেতারা জোর দিয়েই বলছেন, গত দুইটি নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে যে আলাপ আলোচনা হয়েছিল তা ছিল 'আইওয়াশ'। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অন্য বিরোধী দলটি ইসি গঠনের বর্তমান তৎপরতার তীব্র সমালোচনা করলেও তাদের সময়কালে কেন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন তৈরি করা হয়নি বা ক্ষমতায় গেলে তারা কী ধরনের আইন করবেন তা অনেক চেষ্টা করেও জানা সম্ভব হয়নি। তবে যে আলোচনাটি খুব জোরের সাথে সামনে আনা দরকার তা হলো, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এক ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে। সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাটি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন থেকে জনগণ ভীষণভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, কোথাও ৫ শতাংশ ভোট আবার কোথাও ১০৫ শতাংশ, কোন কিছুতে মানুষ অবাক হয় না। এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে।
এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। এই মালিকরা জানিয়ে দেন আগামী ৫ বছর প্রজাতন্ত্রটি কীভাবে এবং কারা পরিচালনা করবেন। মালিকদের প্রত্যক্ষ মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটিই জনগণের সার্বভৌমত্ব। এটার ব্যাত্যয় ঘটলে প্রজাতন্ত্রের মালিকানার সংকট তৈরি হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমরা দেখেছি অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন না হতে। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে যাওয়ার অভিযোগ শোনা যায় প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রায় সকল স্তরে নির্বাচন না করেই বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতীয় সংসদে কুমিল্লার একটি আসনে সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচন থেকে শুরু করে চলমান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও যে মাত্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তা অতীতে হয়নি। রাজনৈতিক মনোযোগটি দিতে হবে এখানে। রাষ্ট্র পরিচালনায় মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অন্যতম উপায় হলো নির্বাচনে অংশ নিতে পারা। ফলে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হতে হবে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে সরকারের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সেখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্বেষ ও বৈরিতাপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার নির্বাচন কমিশন এখানকার মত আস্থার সংকটে পড়েনি। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান এমন কি পাকিস্তানেও নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য আইন রয়েছে। নেপালের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি দল ও বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে সেখানে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল রয়েছে। কাউন্সিল বসে একটা খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। প্রকাশিত তালিকার ব্যাপারে কারো কোন অভিযোগ থাকলে জানাতে পারে। গণশুনানির বিধান রয়েছে সেখানকার আইনে। এরপর তালিকা যায় সংসদে । সংসদ তালিকা চূড়ান্ত করে। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন।
সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য ভূটানে পার্লোমেন্টের উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যানের নেতুত্বে একটি পর্ষদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও বিরোধীদলের নেতা এই পর্ষদের সদস্য। এই পর্যদের তালিকা অনুযায়ী সেখানকার রাজা নিয়োগ প্রদান করেন। উপমহাদেশের অপর একটি দেশে ১২ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে আগে বিচারপতিরাই থাকতেন। এখন সেখানে দুইজন সাবেক আমলার যুক্ত হওয়ার বিধান তৈরি হয়েছে। সংসদীয় কমিটির অর্ধেক থাকেন সরকারি দল হতে বাকি অর্ধেক বিরোধী দল হতে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটা প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করে সংসদীয় কমিটিতে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দল ঐকমত্যে আসতে না পারলে দুই জন আলাদাভাবে সংসদীয় কমিটিতে নাম দিতে পারেন। সংসদীয় কমিটি সেখান থেকে নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। পশ্চিমা দেশগুলো আরো এগিয়ে এক্ষেত্রে। ফ্রান্সের নাম আসে সবার আগে।
সাম্প্রতিক সমাজের ৫৩ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি একটি বিবৃতি দিয়ে সাংবিধানিক পদগুলোর জন্য সংবিধানের নির্দেশিত আইনটি করবার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। চলতি কমিশনের মেয়াদ শেষে নতুন কমিশন নিয়োগ, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এটা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন। সংবিধানে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকার পরও গত ৫০ বছরে আইনটি না হওয়ায় তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। গত ৫০ বছরে কেন আইনটি হয়নি বা কাদের অবহেলা ছিল সেটা তারা বলেননি। এই অর্ধ শতাব্দীতে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তাদের বলতে হবে, কেন তারা আইনটি করেন নি। বা ক্ষমতায় গেলে কী ধরণের আইনের বিধান রাখবেন তা তো জানাতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে বহুদিন ধরে। এক বিশেষ ব্যক্তিকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার জন্য সংবিধান সংশোধন বয়স বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ২৩ মে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি একই সাথে বিচারপতি ও সিইসি দুই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত বিচারপতি এম এ আজিজের সিইসি পদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন। সিইসি ও অন্যান্য সাংবিধানিক পদের জন্য আইন অবশ্যই হতে হবে কিন্তু তাছাড়াও রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার সর্বাগ্রে, সেটা কেউ বলছেন না। সমঝোতা ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। '৯০ এ সমঝোতা হয়েছিল বলেই আমরা রাষ্ট্রপতি শাসনের পরিবর্তে আজকের সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় আসতে পেরেছি। প্রতিনিয়তই রাজনীতির ঐক্য ও সমঝোতার উপায় ও কৌশল আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। সংঘাতময় ও বৈরিতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের অবসান জরুরি। একে অন্যের 'নির্মূলের' রাজনীতি আমাদের প্রান্তিক সীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে।