সিইসিদের চোখে ইউপি নির্বাচন
২০০৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়ম তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এ সাঈদকে হতাশ করেছিল। সেই নির্বাচনকে 'পণ্ডশ্রম' অভিহিত করে বেশ কয়েকবার তিনি ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তৎকালীন বিএনপি সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তার মন্তব্যে মোটেও খুশি হননি। সংসদে ক্ষমতাসীন দলের কিছু সংসদ সদস্য এক অনির্ধারিত আলোচনায় এম এ সাঈদকে সমালোচনার বাণে জর্জরিত করেন এবং তার অভিশংসনের দাবি জানান।
বর্তমান সিইসি কেএম নুরুল হুদা অবশ্য দেশব্যাপী চলমান ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বেলায় পূর্বসূরি এমএ সাঈদের চেয়ে ভিন্ন পথে হেঁটেছেন।
দুই সপ্তাহ আগে তিনি বলেছিলেন, চলমান নির্বাচনে সংগঠিত সহিংসতার জন্য নির্বাচন কমিশন বিব্রত।
কিন্তু, সোমবার তার বিব্রত ভাব ও উদ্বেগ সহসা উধাও হয়ে গেল। সেদিন তিনি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করেন।
যদিও বাস্তব তথ্যপ্রমাণ তার দাবির পক্ষে কথা বলছে না।
নির্বাচনটি সামগ্রিকভাবে অংশগ্রহণমূলক হয়নি। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দল নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রার্থী দিয়েছিল। আর গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭টিতে।
দুই ধাপে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যা জনগণকে ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। স্থানীয়ভাবে তীব্র সহিংসতায় ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছে।
প্রথম দুই দফায় সহিংসতা ও নির্বাচনী অনিয়ম বন্ধের এই ব্যর্থতা প্রভাব ফেলবে অবশিষ্ট ২ হাজার ইউপি নির্বাচনে।
আসন্ন নির্বাচনকে সহিংসতা ও অনিয়মমুক্ত রাখতে ইসি নতুন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েও সিইসি কেএম নুরুল হুদা বোধহয় শান্তিতে ও আরাম-আয়েশে বসবাস করছেন। নির্বাচনের মান যা-ই হোক না কেন, সমালোচনামূলক মন্তব্য করে তিনি বোধকরি ক্ষমতাসীন দলকে চটাতে চান না।
তার কৌশল ভালোই কাজ করছে। রোববার থেকে গত দুই দিনে সংসদে চলমান ভোটে সহিংসতা ও অনিয়মের সমালোচনা করেছেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। তবে পূর্বসূরি এমএ সাঈদের মতো কেএম নুরুল হুদাকে এখনও ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি।
নুরুল হুদা আসলে তার ঠিক আগের সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের পথে হাঁটছেন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ইসির নেতৃত্বে ছিলেন রকিবুদ্দীন আহমেদ। ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের মধ্যে সংগঠিত ওই নির্বাচন স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী নির্বাচনগুলোর একটি হিসেবে। ২০১৬ সালের সেই নির্বাচনে প্রায় ১০০ জন মানুষ নিহত হয়।
নির্বাচনে রক্ত ঝরলেও, কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ব্যতীত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে মন্তব্য করে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সিইসি রকিবউদ্দিন ও তার সহকর্মীরা।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর নতুন আঘাত হয়ে এসেছিল ওই ইউপি নির্বাচনগুলো।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনেও ইসির নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল হুদা। সেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে।
তবু, ২০০৩ ও ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বিগত ইউপি নির্বাচন এবং চলমান নির্বাচনের মধ্যে তুলনা করলে বর্তমান নির্বাচন থেকে সান্ত্বনা পেতে পারেন সিইসি নুরুল হুদা। গত দুই দশকের একমাত্র ব্যাপক ও সুষ্ঠু ইউপি নির্বাচন ছিল ২০০৯ সালের ইউপি নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ইসির নেতৃত্বে ছিলেন এটিএম শামসুল হুদা।
২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হয়েছিল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি। তার পূর্বসূরি এমএ সাঈদের নেতৃত্বেও ২০০১ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে ইসি।
তবে রকিবুদ্দীন ও নুরুল হুদার নেতৃত্বে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি সংসদীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজন করে ইসি। ওই নির্বাচন দুটি যেভাবে হয়েছে, তা ইসি ও নির্বাচনী গণতন্ত্রের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অনুপস্থিতিতে বেশিরভাগ চেয়ারম্যান পদে জিতলেও, চলমান ইউপি নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীন দল খুব বেশি লাভবান হতে পারবে না। তবে অন্যপক্ষও খুশি নেই। সব প্রতিযোগীই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন তুঙ্গে। এই অন্তর্কোন্দলের জেরে ঘটছে সহিংসতার ঘটনা। আর নিহতদের অধিকাংশই শাসকদলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী।
নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চলমান নির্বাচনের কারণে, যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য এক বিশাল রাজনৈতিক ক্ষতি। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয় বলে বিরোধীরা যে যুক্তি দেয়, তা আরও শক্তিশালীই হবে।
চলমান ইউপি নির্বাচনের সঙ্গে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত নির্বাচন-পদ্ধতির মিল খুব সামান্যই। অথচ এই নির্বাচনের সব খরচই জোগাচ্ছেন করদাতারা। এবারের নির্বাচনের বাজেট গত ইউপি নির্বাচনের ৫০০ কোটি টাকার বাজেটকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া দরকার: ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতায় ভরপুর এরকম নির্বাচনের অর্থ কী?
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
মূল লেখা: UP polls: In the eyes of CECs