সুখের মূলমন্ত্র জানা বটগাছের গল্প
১৯৯২ সালের ৩০ নভেম্বর বিকালবেলা সোবহানবাগ থেকে হেঁটে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যাচ্ছিলাম। ধানমন্ডি ২ এর কাছাকাছি পৌঁছুতেই হঠাৎ শরীর কাঁপতে থাকলো। মুহুর্তের মধ্যে সব শক্তি হারিয়ে গেল এবং আমি রাস্তার পাশে বসে পড়লাম। এরপর ভয়ে ভয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিজের বাসায় না গিয়ে আসাদগেটে আব্বার বাসায় চলে এলাম। ভাবলাম সেখানে সবাই আছে আর আব্বাকেও দেখে আসি। দু'দিন ধরে তার হালকা জ্বর ছিল।
বাসায় এসে দুর্বলতা কমে গেল। আব্বার পাশে বসে থাকলাম। আব্বা বিছানা থেকে উঠে তার প্রিয় ও নিত্য ব্যবহার্য বেতের চেয়ারে বসতে চাইলো। এরমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একে একে সবাই ঘরে ফিরে এলো। আমি মাটিতে বসে আব্বার পা টিপে দিচ্ছিলাম। আম্মা অন্য ঘরে নামাজ পড়ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আব্বা চোখ মেলে একবার আমাকে দেখলো এবং এরপরেই তার মাথাটা একপাশে ঢলে পড়লো।
সেই শেষ দেখা আব্বার সাথে। এরপর ধরাধরি করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃতদেহটাই টেনে নিয়ে গেছি। ডাক্তার আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করার পর, আবার আমার সম্পূর্ণ শরীর শক্তিহীন হয়ে গেল, ঠিক বিকেল বেলার মতো। বুঝলাম আব্বাকে বিদায় দিতেই কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে এনেছিল। আব্বা আমাকে শেষ দেখা দেখবে বলেই আমার শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আমি সেদিন আসাদগেটে আসতামই না, রাতে বাসায় ফিরে এই খবরটা পেতাম। একেই বলে আত্মজার প্রতি টান।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেই সোহাওয়ার্দী হাসপাতালে আব্বার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শুধু মনে হচ্ছিল, মাত্র ৫৭ বছর বয়সে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি চলে গেল, এখন এই সংসারটি চলবে কিভাবে? ছোট ভাই, আম্মা কিভাবে এই শহরে থাকবে? ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ আসবে কোথা থেকে? কী জটিল বাস্তবতা আমার। কেবল চাকরিতে যোগ দিয়েছি, এই এতটুকু টাকা দিয়ে কী হবে। ফেরার পথে এই কথাই ভাবতে থাকলাম।
বাসায় ফেরার পর আম্মার বুক ফাটা আর্তনাদ, কলেজে পড়–য়া ছোট ভাইয়ের নির্বাক দৃষ্টি, আত্মীয়-স্বজনের হাহাকার কিছুই আমাকে আর কাঁদাতে পারেনি। আব্বা আমাদের বটগাছ ছিল, হয়তো সব পরিবারেই তাই থাকে। বটগাছের ছায়া সরে গেলে জীবন ছায়াহীন হতে বাধ্য। তখন সংসারের বড় সন্তানের উপর যে দায়িত্ব বর্তায়, আমার উপরেও তাই বর্তেছিল।
ভাইদের ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় আব্বাকে নিয়ে দেশের বাড়ি রওনা দিলাম পরদিন সকালে। যাওয়ার আগে প্রাণপ্রিয় প্রেসক্লাব চত্বরে জানাজা হলো। সেখানেই প্রখ্যাত সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী চাচা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, "তুমি ফিরে এসে আমার সাথে দেখা করো।" সেরকম একটি মূহুর্তে এরকম একটি আশ্বাস আমার জীবনীশক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে আমার চোখের পানি একদম শুকিয়ে গিয়েছিল। দেশের বাড়িতে আব্বার মরদেহ পৌঁছে দেয়ার পর, আবার আমি উপলব্ধি করলাম আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ খুলে হাউমাউ করে কাঁদলাম। মনে হলো আমার দায়িত্ব শেষ। আব্বাকে তার বাপ দাদার ভিটায় পৌঁছে দিয়েছি।
কিন্তু সেদিন বুঝিনি যে আমার দায়িত্ব কেবল শুরু হলো। বাবা মা যতোদিন বেঁচে থাকে, সন্তান বুঝতেই পারেনা তাদের ছায়া মায়া কতটা গাঢ়। আমরা কতটা নির্ভরশীল থাকি তাদের উপর। বড় হয়ে যাওয়ার পরও এদের ভালবাসাই আমাদের আগলে রাখে। প্রতিদিন প্রতি কাজে বুঝেছি আব্বা কিভাবে তার কাঁধে আমাদের সংসারের বোঝা টেনে চলেছিল। একটি পরিবারে কী অপরিসীম শূন্যতা তৈরি হয় বাবাকে ছাড়া।
সেদিন আমি যখন একদম ভেঙে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, কে আম্মাদের দায়িত্ব নেবে এই ঢাকা শহরে, আমি কিভাবে ওদের দেখবো? কোথায় পাবো টাকা? কারণ আব্বা এত বড় বড় চাকরি করেও মৃত্যুকালে ব্যাংকে মাত্র ১০ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিল। তবে যার কথায় সেদিন সংসার চালানোর জন্য শক্তি পেয়েছিলাম, সে আর কেউ নয়, সে আমার শ্বাশুড়ি, শিরীন আহমেদ, যার বয়স এখন ৯৬ বছর। উনি বলেছিলেন, "তোমার বাবা তোমাকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করেছেন কেন, তুমি ছাড়া কে দেখবে তোমার মা, ভাইকে?
ওনার এই কথাটা আমাকে সেদিন এতটাই নির্ভার করে তুলেছিল যে, এরপর থেকে এতগুলো বছর আমি আমার মা-ভাইকে আগলে রেখেছি। অনেকেই আমাদের পাশে ছিলেন, আছেন। কিন্তু মূল শক্তি ছিল মায়ের সেই কথাটি। তাই ভাবি একটি মেয়ে তার বাবার ফেলে যাওয়া দায়িত্ব খুব ভালভাবেই পালন করতে পারে, যদি তাকে শক্তি যোগান হয়। সন্তান ছেলে হলো, না মেয়ে হলো, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সন্তান মা বাবার পাশে দাঁড়াচ্ছে কিনা।
আব্বা চলে যাওয়ার ২৯ বছর হয়ে গেল। কতকিছু তোমাকে দেখানোর ছিল, দেখাতে পারিনি তোমাকে। এতটুকু আরামের ব্যবস্থা করে দিতে পারিনি তোমাকে। আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়া তুমি দেখতে পেলে না। দেখতে পেলে না শুধু পড়াশোনা আর সততা শিখিয়ে দিয়ে তুমি কিভাবে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড় হতে শিখিয়েছো।
আজকাল মানুষের ক্ষমতার দাপট, অসততা, লোভ, হিংসা আমাদের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। অথচ বাবার সারল্য ও সততার আদর্শ যদি সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তাহলেই জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায়। এরকমই একজন সৎ, যোগ্য ও ক্ষমতাধর সাংবাদিকের আজ মৃত্যুদিন। আত্মজা হিসেবে তাই তাকে লেখার মাধ্যমে স্মরণ করছি।
আব্বার যখন বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, তখন সে ইত্তেফাকের সাংবাদিক। আম্মা সাংবাদিকতা পেশাটির সাথে একদম পরিচিত ছিলনা। কাজেই বিয়ের কিছুদিন পর আব্বা যখন আম্মাকে নিয়ে ভূতের গলিতে বাসা ভাড়া নিয়েছিল, তখন সেই বাড়িওয়ালি এসে আম্মাকে বলেছিল, সাংবাদিকরা নাকি ঠিকমতো বেতন পায়না, আপনারা কি সময় মতো ভাড়া দিতে পারবেন? একথা শুনে আম্মার অবস্থা শোচনীয়। আম্মা বলেছে, সে নাকি ২/৩ দিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল।
এরপর তাদের বিবাহিত জীবনের ২৮ বছর চলে গেছে। দু:খ, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, অভাব-অনটন নিয়ে আমাদের সংসার বেশ ভালই কেটেছে। চাকুরি থাক বা না থাক আব্বার অবশ্য বাড়িভাড়া দিতে কোন অসুবিধা হয়নি। আম্মারও আব্বার প্রতি কোন অভিযোগ ছিলনা। কারণ তারা দুজনেই ছিল পারিবারিক মানুষ।
তবে মশারি টাঙানো নিয়ে প্রায়শই দু'জনের খ্যাচম্যাচ কানে আসতো। আব্বা মশারি টাঙিয়ে ঘুমাবে না। আর আম্মা মশারি ছাড়া ঘুমাবে না। প্রতিরাতে এটাই ছিল দু'জনের ঝগড়ার বিষয়। শেষপর্যন্ত আমাদের বাসায় ডবল বেডের মাঝ বরাবর একটা সিঙ্গেল মশারি টানানো হতো। মশারির বাইরে আব্বা আর ভিতরে আম্মা ঘুমাত।
১৯৭৮/৭৯ সালের দিকে আব্বাকে তার পরিচিত এক ভদ্রলোক বার্মা থেকে বেশ চকচকে সিল্ক টাইপের একটি লুঙ্গি এনেছিল। উপহার পেয়ে আব্বাতো দারুণ খুশি। ছোটদের মত টানা কিছুদিন ঐ লুঙ্গিটিই ধুয়ে ধুয়ে পরলো। সেইসময় বাসায় যে আসতো তাকেই লুঙ্গিটা দেখাতো এবং বার্মার কাপড়, ব্যবসা ইত্যাদি প্রসঙ্গে কিছু না কিছু একটা আলোচনা হতোই। ব্যাপারটা বাসার লোকদের কাছে রীতিমত অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছুল ।
প্রায় বছরখানেক পরার পর লুঙ্গিটি এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গেল। আমরা ভাবলাম যাক এবার মনেহয় এর পাট চুকবে। কিছুদিন এই লুঙ্গি পরাটা বন্ধ থাকলো। এরপর একদিন আমাদের বাসায় আমার খালাতো বোন এলো, যে ছিল সেলাই বিদ্যায় খুব পটিয়সী। ব্যস আব্বার মাথায় আবার নতুন করে ঐ লুঙ্গির চিন্তা এলো, এটা দিয়ে আর কী কী হতে পারে ? এবার সেই বোনের উপর দায়িত্ব পড়লো লুঙ্গিটা দিয়ে আব্বাকে টুপি বানিয়ে দেয়ার। অতঃপর সেই লুঙ্গি থেকে প্রায় ৪/৫ টা টুপি বানানো হল ।
এই সাধারণ মানুষ আব্বার এমন সব হাস্যকর গল্প আছে, যা শুনলে মনেহবে বানানো কাহিনী শুনছি। আবার তার জীবনের অর্জনও কম ছিল না। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আব্বা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস) এর নিউজ এডিটর। হঠাৎ একদিন অফিসে ফোন এল। আব্বা হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে গলদ গম্ভীর স্বর ভেসে এল। কে, শামসউল হুদা বলতেছো? আব্বা বলল জি। আপনি? ঊত্তর এলো, আমি শেখ মুজিব।
একথা শুনে আব্বা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে ফোন করেছেন? আব্বা বলেছিল জানিস সেইমূহুর্তে ভয়ে আমার দম আটকে যাচ্ছিল। কোনভাবে তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাকে ফোন করেছেন? এতো আমি ভাবতেই পারছি না। কী করতে হবে বলেন? বঙ্গবন্ধু আব্বাকে বলেছিল, "হুদা তুমি কালকে বাসায় চলে আসবা। তোমাকে মর্নিং নিউজের সম্পাদক বানানো হইছে।"
একথা শুনে আব্বার হাত পা আরো বেশি করে কাঁপতে শুরু করেছিল উত্তেজনায়। ইতোমধ্যে অফিসের সবাই চেয়ার ছেড়ে আব্বার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খবর শুনে সবাই মিষ্টি খেতে চাইলো। আব্বার পকেটে তখন টাকা ছিল না বলে, সবাই মিলেই মিষ্টি কিনে খেয়েছিল। আম্মার কুলখানিতে এসে এই কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন সাংবাদিক নেতা আজিজুল ইসলাম ভুইঁয়া ভাই।
এত বড় সন্মান পাওয়ার পরও একজন মানুষ কতটা মাটির কাছাকাছি থাকতে পারে, আব্বাকে না দেখলে আমার দেখা মনেহয় অপূর্ণ থেকে যেতো। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার পর আব্বার যতো সাফল্য, সবকিছুর মূলে ছিল সততা ও মানুষের পাশে থাকার ইচ্ছা। নিজে কখনো কোন প্রতিযোগিতায় যায়নি, আমাদেরও প্রতিযোগিতা বিমুখ করে বড় করেছে।
সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে আব্বার ছিল না কোন উদ্বেগ, রেজাল্ট ভাল করা নিয়ে ছিল না কোন চাপ। আমাদের চেহারা-ছবি নিয়েও আব্বার নিজস্ব একটা যুক্তি ছিল, বলতো নিজের চেহারা বা গায়ের রং নিয়ে মন ছোট করাটা একধরণের অপরাধ। যা পেয়েছো, যা আছে, তাই নিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করো।
যে মানুষ অল্পে সুখ খুঁজে পায়, সে সুখী হবে, নিশ্চিত। কারণ তার মধ্যে না থাকার কোন দু:খও থাকবেনা। যদিও এই জগতে এখন এই নিয়ম আর চলে না কিন্তু এখনো চেষ্টা করি আব্বার এই সুখের মূলমন্ত্রটা নিয়ে বেঁচে থাকতে।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন