‘লকডাউন’ থেকে আমরা কী পেলাম?
সরকার যেদিন দুই মাসের দীর্ঘমেয়াদী সাধারণ ছুটি শেষ টানার ঘোষণা দিল, সেদিন বাংলাদেশ একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের হারের রেকর্ড গড়ল- ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের দিনই অবশ্য সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়ে হলো ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের আক্রান্তের হার তৃতীয় সর্বোচ্চ। ৫৪ দশমিক ১ শতাংশের আফগানিস্তান ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশের পাকিস্তানের ঠিক পেছনেই আমরা।
এই তথ্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছে: দেশের অর্থনীতিকে থমকে দেওয়া এবং এর ফলে গত দুই মাসে লাখো মানুষকে চাকরিচ্যূত করে তোলা এই 'লকডাউন' বা 'শাটডাউন' বা 'সাধারণ ছুটি' থেকে আমাদের দেশ কী পেয়েছে?
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জারি করা লকডাউন থেকে অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার প্রশ্নে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় একটি ভিন্ন পথে হাঁটছে।
চীন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি দেশগুলো তাদের দেশে ভাইরাসটির আক্রমণের রেখাচিত্র সহনশীল হওয়ার পরই শুধু লকডাউন শিথিল করেছে অথবা তুলে নিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে ভিন্ন রকম।
এখানে এখনো রেখাচিত্রটির সহনশীল হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই, তবু সরকার রোববার থেকে গণপরিবহণ চলাচল করার সিদ্ধান্ত এবং সরকারি ও বেসরকারি- সব ধরনের অফিস খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
দুঃখের বিষয় হলো, এই শাটডাউন একদম শুরু থেকেই খুব একটা কাজে লাগেনি। আমাদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই অকার্যকর ও বৃথা শাটডাউনের দিকে বারবার আঙুল তুলেছেন, এবং জানিয়েছেন, সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে এটি ব্যর্থ।
ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের মতো ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে লকডাউন জারি করার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন আক্রান্তের হার কমতে শুরু করেছে।
কিন্তু আমাদের দেশে 'সাধারণ ছুটি'র নামে জারি করা একটি নিরুৎসাহজনক শাটডাউনের কারণে কমার বদলে আক্রান্তের সংখ্যা এখনো দিন দিন বাড়ছে।
খেয়াল করা দরকার, বাংলাদেশে ভাইরাসটি যেভাবে সক্রিয় রয়েছে, সেটি ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের মতো যেসব ইউরোপিয়ান দেশে এটি সবচেয়ে বাজেভাবে আঘাত করেছে, সেগুলোর তুলনায়ও অস্বাভাবিক।
দেশে প্রথমবার ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে সেটির আক্রান্তের হার কমিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে ইউরোপিয়ান দেশগুলো; এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম ছিল যুক্তরাজ্য, যেখানে আক্রান্তের হার কমতে শুরু করে ৭০ দিন পর।
এমনকি আফ্রিকান দেশগুলোও এই বৈশ্বিক মহামারির মোকাবেলা তুলনামূলক ভালোভাবে করছে। কেননা, সেখানে অতীতে বেশ কিছু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং পরবর্তীকালে যথেষ্ট ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে তোলা এর কারণ।
করোনাভাইরাসকে আফ্রিকার সামলানোর প্রসঙ্গ টেনে বুধবার এক প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, 'ভাইরাসটিতে আক্রমণের মাত্রা বুঝে লকডাউন, আংশিক লকডাউন, জনসমাগম নিষিদ্ধকরণ, কারফিউ জারি ও সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঝটপট পদক্ষেপ নিয়েছে অনেক দেশ।
দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যামেরুন, মৌরিতানিয়া এবং নাইজেরিয়ার একটি অংশ ঘরে ঘরে গিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে মানুষের খোঁজ নিতে এবং সম্ভাব্য আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষার জন্য শনাক্ত করতে। মহাদেশটির মূল ভূখণ্ডের স্বল্প জনসংখ্যার কিছু রাষ্ট্র ও কিছু দ্বীপরাষ্ট্রও আক্রান্তের সংখ্যা অল্পতে আটতে রাখতে পেরেছে।'
অথচ আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেখা যাচ্ছে, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার ৮৩ দিন পরও নতুন শনাক্তের হার প্রতিদিনই বাড়ছে।
পার্থক্য বোধ হয় এটিই- ব্যাপক মাত্রায় নমুনা পরীক্ষা বেশিরভাগ দেশকেই এ রকম রোগী শনাক্ত করতে এবং রোগীদের 'বিচ্ছিন্ন' করে রেখে আক্রান্তের হার কমাতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
ফলে লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল করার মাধ্যমে তারা যখন নিজেদের অর্থনীতির চাকা আবারও সচল করতে যাচ্ছে, একইসঙ্গে তারা নিজেদের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতাকে আরও বেশি জোরাল করে তুলেছে।
অথচ আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ রোগী শনাক্ত ও তাদের আইসোলেশনে রাখার সক্ষমতা বাড়াতে এখনো হিমশিম খাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য কতগুলো সংখ্যা হাজির করাই যথেষ্ট।
যেদিন থেকে দুই মাসের সাধারণ ছুটি শুরু হলো, সেই ২৬ মার্চ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ঘোষণা দিয়েছিল, গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৬টি নমুনা পরীক্ষা থেকে ৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এবং কেউ মারা যাননি।
এক মাস পর সরকার যখন তৈরি পোশাক কারখানা খুলে দিল, স্বাস্থ্য বিভাগ জানাল, ৩ হাজার ৪৭৩টি নমুনা পরীক্ষা থেকে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪১৮ জন, আর মারা গেছেন ৫ জন।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার সরকার যখন ঘোষণা করল, সাধারণ ছুটির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না, সেদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাল, ৯ হাজার ৩১০টি নমুনা পরীক্ষা করে ২ হাজার ২৯ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
আজ শুক্রবার ১১ হাজার ৩০১টি নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছেন সর্বাধিক ২ হাজার ৫২৩ জন।
এ মাসে এ নিয়ে মাত্র চার বার একদিনে ১০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম হলো বাংলাদেশ। গত তিন মাসে মাত্র ২ লাখ ৮৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, আর শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ৫৮২।
যেখানে সফলভাবে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর চাবিকাঠি হলো যতদ্রুত সম্ভব নমুনা পরীক্ষা এবং আক্রান্তদের শনাক্ত করা, সেখানে নমুনা পরীক্ষার এত কম সক্ষমতা নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ অনিশ্চয়তার ভেতর অপেক্ষমান। যাদের নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে, তাদের অনেকেই যথাযোগ্য চিকিৎসা পাচ্ছেন না; দুর্বল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পরিণাম ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
এই হলো আমাদের অবস্থা!
'সাধারণ ছুটি' থেকে বেরিয়ে আসছে দেশ; নাগরিকরা এখন নিজেদের ইচ্ছেমতো বাইরে বের হতে পারবেন। যদিও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ, কিন্তু সেই পরামর্শে তো আগেও খুব একটা সাড়া মেলেনি।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখা: What did we achieve from the 'lockdown'?