সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া কঠোর সংকোচনমূলক উদ্যোগে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে
আগামীতে দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাবে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে বিশ্ব অর্থনীতির গতি প্রকৃতির ওপর। তবে গত কয়েকদিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দামে কিছুটা আশার আলো দেখা গেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যেও বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তির সুবাদে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও সারের দাম কিছুটা কমে এসেছে। এই দুই দেশ থেকে ইতোমধ্যেই বড় অঙ্কের গম সরবরাহ শুরু হওয়ায় পণ্যটির দামও কমতে শুরু করেছে।
তবে এটাও ঠিক যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ বিরতি শুরু হলেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের সামরিক যুদ্ধের সহসাই অবসান হচ্ছে না। এর ফলে ইতোমধ্যেই সংকটে পড়ে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হয়ত মন্দা এড়াতে পারবে না।
বড় বাজারগুলোতে সংকটের কারণে তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেলে আমাদের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। এর ফলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের দামও কমতে পারে। এর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রপ্তানি আয়ে। এর ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও টাকার বিনিময় হারের চাপ সহসাই কমবে না।
এ ধরনের সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের কোনটা সংকট মোকাবেলায় কাজ করবে আর কোনটা উল্টো ফলাফল নিয়ে আসবে এ বিষয়ে বিষদ আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের নেওয়া সংকোচনমূলক বিভিন্ন উদ্যোগের বড় লক্ষ্য ডলার সংকট মোকাবেলা করা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। ডলার সরবরাহের ওপর আমাদের খাদ্য, অন্যান্য পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের বিভিন্ন উপকরণের আমদানি নির্ভর করে।
ফুল, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। তাছাড়া সরকারি কর্মীদের বিদেশ সফর, প্রকল্পের ব্যয় সীমিত করার ফলে বিদেশি মুদ্রার কিছুটা সাশ্রয় হবে। এসব উদ্যোগের বাড়তি কোনো প্রভাব নেই।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে আমাদের অনেক পণ্যের উৎপাদন আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের শিল্প উৎপাদন ঠিক রাখতে গ্যাস, বিদ্যুতের যেমন দরকার, তেমনি বিভিন্ন উপকরণও আমদানি করা দরকার।
সময়মতো সার, কীটনাশক ও বীজ আমদানি করতে না পারলে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তাও বড় ধরনের ঝুকিতে পড়তে পারে।
আফ্রিকায় ইতোমধ্যেই খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে। খাদ্যের উৎপাদন ব্যাহত হলে এমন সংকট আমাদের দেশেও হতে পারে।
এ অবস্থায় কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করতে বিদ্যুত ও তেলের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। বৃষ্টি না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেচের মাধ্যমে আমন চাষ শুরু হয়েছে। লোডশেডিং না থাকায় সেচে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে।
আবার লোডশেডিংয়ের কারণে বাসাবাড়ি ও অফিসে তেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। আর শিল্প কারখানায় ক্যাপটিভ জেনারেটর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে।
তেল আর গ্যাসের সাশ্রয়ের জন্যে লোডশেডিং দেওয়া হলেও এর ফলে জ্বালানি ব্যবহার না কমে উল্টো বাড়তেও পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আগে সুচিন্তিতভাবে বিবেচনা করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই।
আর এই লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পখাতে উৎপাদন কম হলে রপ্তানি আয় কমে আসবে। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার কম পণ্য উৎপাদন হলে দাম বেড়ে যাবে। জ্বালানি সাশ্রয় করতে সৃষ্ট লোডশেডিংয়ের ক্ষতি সাশ্রয়ের চাইতে আরও অনেক বেশিও হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে এটা উল্লেখ করা যায়, শ্রীলঙ্কায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সার আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে সারের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় যে পরিমাণ খাদ্যের উৎপাদন কম হয়েছে তার মূল্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। এ অবস্থায় সংকট মোকাবেলায় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও বিষদভাবে লাভ লোকসানের হিসাব করতে হবে।
মুদ্রার বিনিময় হারেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিধিবহির্ভূত ধারণা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের চাইতে অনেক কম হার নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাজারে এই হারে ডলার পাওয়া না যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একদিকে ব্যহত হচ্ছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের অর্থ ঠিকমত দেশে আসছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া রেটের চাইতে ডলারে সাত-আট টাকা বেশি পাওয়া গেলে প্রবাসীরা নিয়মিত চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠাবে না। বাজারের চাইতে অনেক কম বিনিময় হার ধরে তা কার্যকর রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার বাজারে ছাড়তে হবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই সামর্থ্য থাকায় তারা ডলারের রেট ৪০ রূপিতে নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে মূদ্রার বিনিময় হার ধরে রাখতে ব্যয় করার মতো পর্যাপ্ত ডলার আমাদের রিজার্ভে নেই। বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট এড়ানোর পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রাখতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের আগে বাজারের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে।
টেলিফোনে টিবিএসের সিনিয়র স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন ড. জাহিদ হোসেন