‘ও মানুষ…দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা শোনবা; একটা মুখ তো, কতা কম কবা’
বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে—পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এই মন্তব্যের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় হুরপরির জন্য তীব্র আকুতি। কারণ, বেহেশতে পুরুষের সঙ্গী হিসেবে হুরপরি থাকার কথা। ফলে মানুষ প্রশ্ন করছে, যদি বেহেশতেই থাকি, তাহলে হুর কোথায়?
মানুষের এইসব রসিকতার ভেতরে যে ক্ষোভ আছে—সেটি মন্ত্রী মহোদয় নিজেও জানেন, বোঝেন। কিন্তু কথাটি তিনি বলেছেন প্রতীকী অর্থে। এই অর্থে যে, পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাই খারাপ। সেই তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। এরকম কথা আমরা সব সময়ই বলি। কেউ একটু ভালো থাকলে আমরা তাকেও বলি যে, আপনি তো বেহেশতে আছেন। এই বেহেশত পুণ্যবানদের মৃত্যুপরবর্তী আবাসস্থল নয়। বরং এই বেহেশতের মানে হলো খুব ভালো থাকা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতীকী অর্থেও যদি বলেন যে বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে, সেটি কতখানি যৌক্তিক?
একজন সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, 'এই বেহেশতের চুলায় গ্যাস নাই, কলে পানি নাই, ঘরে আলো নাই, কুপিতে তেল নাই, কাঁচামরিচের কেজি ২০০, আলু কেজি ৩৫ টাকা, ডিমের ডজন ১৫০টাকা...গরীব বইলা গরম চা? বাংলাদেশি বইলা কি এইরম ঠকায়ে দিলো?'
এটিও রসিকতা। মানুষের আসলে রসিকতা ছাড়া করার কীই বা আছে। মন্ত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করলে বা খারাপ ভাষায় কিছু লিখলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। তারচেয়ে রসিকতাই ভালো। সৃষ্টিশীল তরিকায় রাগ ঝাড়া গেলো। আবার আইনি ঝামেলা থেকেও বাঁচা গেলো।
পরিস্থিতির কারণে কি তারা খেই হারিয়ে ফেলেছেন? অথবা নিজেরাই বুঝতে পারছেন না যে, এই মুহূর্তে ঠিক কোন কথাটি বলা উচিত?
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনের প্রথম পর্বে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য। তিনি বলেছিলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি।' তখনও তার এই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ রসিকতা হয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী কি-না, অনেকে সেই প্রশ্নও তোলেন।
প্রশ্ন সেটা না। প্রশ্ন হলো, মন্ত্রী বা এরকম দায়িত্বশীল পদের লোকজন কথাবার্তা বলার সময় কেন এটি চিন্তা করেন না যে, লোকেরা এটা নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে? নাকি তারা চান লোকেরা হাসাহাসিই করতে থাকুক যাতে মূল সমস্যাটা আড়ালে থাকে? অথবা অর্থনৈতিক সংকটকালে এইসব হাস্যরসের মধ্য দিয়ে মানুষকে কিছুটা বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা। নাকি পরিস্থিতির কারণে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছেন? অথবা নিজেরাই বুঝতে পারছেন না যে, এই মুহূর্তে ঠিক কোন কথাটি বলা উচিত? যদি তা-ই হয়, তাহলে তাদের এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বেহেশত তত্ত্বের আগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, 'দেশের কোথাও কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও না খেয়ে নেই। শুধু খাবারই নয় বরং প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় রয়েছে। আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি তা আমি মনে করি না।'
আপনি যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তখন কী বলবেন সেটি জরুরি। কিন্তু কী বলবেন না, সেটি আরও জরুরি।
তার মানে জামাকাপড় পরে থাকাটাই একজন মন্ত্রীর কাছে ভালো থাকার সংজ্ঞা। অথচ একজন ভিখারিও জামা কাপড় পরেন। তিনি জামা কাপড় ছাড়া রাস্তায় ভিক্ষা করতে বের হন না। সুতরাং মানুষ জামাকাপড় পরছে বলে দেশে কোনো সংকট নেই; কোথাও মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না বলে দেশের অর্থনীতি খুব ভালো আছে—এই উপসংহারে পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই।
এটা ঠিক যে, করোনার অতিমারির ভেতরেও বিশ্বের অনেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও যেখানে বিপর্যস্ত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খেয়েপরে এখন পর্যন্ত খুব খারাপ অবস্থায় নেই। করোনার ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা চলছে। একটানা দীর্ঘ সময় লকডাউন না দিয়ে জীবন-জীবিকা সচল রাখা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সাহসী ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল, সেটিও অস্বীকারের সুযোগ নেই।
কিন্তু গত ৮ বছর ধরে সরকারের একমাত্র লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যাংক গ্রাহক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল বিক্রি করে ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার পরেও ছয় মাসে তেল বিক্রিতে ৮ হাজার ১৪.৫১ কোটি টাকা পরিচালন লোকসানকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য যে সর্বোচ্চ ৫১.৬ শতাংশ বাড়লো—তার যুক্তিটা কী?
শত ভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার পরেও কেন এখন দৈনিক তিন চার ঘণ্টা বা কোথাও তারও চেয়ে বেশি লোডশেডিং? বিদ্যুৎ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের যৌক্তিকতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন; এই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের যে অভিযোগ; গ্যাসের মজুদ ফুরাতে থাকা এবং অন্যদিকে বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরেও সরকার কেন গ্যাস অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে এলএনজি আমদানিতে বেশি উৎসাহী—এইসব প্রশ্নও জনমনে আছে।
বিপুল পরিমাণ টাকা যে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, তা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। অথচ কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, 'আমি টাকা পাচার করি না। কীভাবে পাচার হয় জানবো কীভাবে?' প্রশ্ন হলো, কারা টাকা পাচার করে এবং কীভাবে টাকা পাচার হয় সেটি তার জানা উচিত, তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী। 'কীভাবে পাচার হয় জানবো কীভাবে?' এর জবাব হওয়া উচিত ছিল: কীভাবে টাকা পাচার হয়, কোন কোনো চ্যানেলে যায়, সেটা আমরা খুঁজে বের করব। মানুষ তখন তার কথায় ভরসা করতো। কিন্তু যখন বলেন যে কারা পাচার করে জানেন না, কীভাবে পাচার হয় জানেন না, তখন পাচারকারীরা একধরনের দায়মুক্তি পেয়ে যায়। পাচারকারীরা আরও উৎসাহী হয়।
তবে যদি মন্ত্রী মনে করতেন যে টাকা পাচারের বিষয়টি স্পর্শকাতর এই বিষয়ে কথা বলে চুপ থাকতে পারতেন। সমস্যা হলো, আমাদের নেতারা চুপ থাকতে পারেন না। সব বিষয়ে তাদের কথা বলতে হয়। যিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নন, সেই মন্ত্রণালয়ের বিষয়েও তিনি কথা বলেন। ফলে মানুষের গায়ে জামা কাপড় আছে আর কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না বলে দেশ বেহেশতখানা হয়ে গেছে—এইসব উদ্ভট কথাবার্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নীতিনির্ধারকদের ব্যাপারে মানুষের মনে বিরক্তির জন্ম দেয়। যে বিরক্তির বাইপ্রোডাক্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল বা রসিকতা।
সমস্যা হলো, আমাদের নেতারা চুপ থাকতে পারেন না। সব বিষয়ে তাদের কথা বলতে হয়।
পাঠকের মনে থাকার কথা, 'উই আর লুকিং ফর শত্রুজ' মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। এই দলের আরেকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী আলোচনায় এসেছিলেন গুলিতে নিহত একটি শিশুর পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছেন' বলে। আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর সমালোচিত হয়েছিলেন 'বিএনপির লোকেরা পিলার নাড়িয়েছে বলে রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়েছে' মন্তব্য করে। এই দলের আরেকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘন ঘন বলতেন, 'দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো'।
আবার সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এনডিএমের সঙ্গে সংলাপের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তলোয়ারের বিপরীতে প্রতিপক্ষকে রাইফেল নিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদিও তার এই কথা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে সেদিন বিকেলেই বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে তলোয়ার ও রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ সকালের বক্তব্য থেকে সরে আসেন।
সিইসি তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর কথাটি প্রতীকী অর্থে বললেও কোন পদে থেকে কী কথা বলা যায় বা বলা উচিত এবং মানুষ কোন কথাটি নিয়ে রসিকতা করতে পারে বা সমালোচনা করতে পারে, সেটি ভাবনায় রাখা দরকার। তারা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো যা খুশি তাই বলবেন না বলেই তাদেরকে ওইসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। কিন্তু পদে বসার পরে যদি নিজেদের পদের ভার ও ধার সম্পর্কে নিজেরাই ওয়াকিবহাল না থাকেন, তাহলে বেহেশতের কথা বলার পরে লোকজন হুরপরি খুঁজবেই।
এ কারণে কম কথা বলার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটি প্রবাদ আছে: বোবার শত্রু নেই। কথাটা প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হলেও আমাদের জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য। কেননা, কোনো জাতীয় সংকট বা বড় কোনো সমস্যার ভেতরে যখন একটি রাষ্ট্র নিপতিত হয়, সেজন্য যার যতখানি দায় থাকুক না কেন, ওই সময়ে নীতির্ধারকদের প্রতিটি কথা ভেবেচিন্তে বলা উচিত। কারণ মানুষ তখন এমনিতেই তেতে থাকে। তার উপরে দায়িত্বশীলরা দায়িত্বজ্ঞানহীন বা অপ্রয়োজনীয় কথা বললে তাতে মানুষ আরও ক্ষুব্ধ হয়।
সৈয়দ শামসুল হক 'মার্জিনে মন্তব্য' বইয়ে লিখেছেন, 'আপনি কী লিখবেন সেটি জরুরি। কিন্তু কী লিখবেন না, সেটি আরও জরুরি।' এই কথার সাথে মিল রেখে বলা যায়, আপনি যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তখন কী বলবেন সেটি জরুরি। কিন্তু কী বলবেন না, সেটি আরও জরুরি।
খুলনা-সাতক্ষীরা এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় একজন অপরিচিত শিল্পীর গাওয়া একটি গান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি এরকম: 'ও মানুষ…দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা শোনবা, একটা মুখ তো, কতা কম কবা।'
তুরস্কের কবি ইউনুস এমরের একটি কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করা যাক:
চুপ থাকাই বাকপটুতা সবার সেরা
বাচালতা হৃদয়জুড়ে মরচেপড়া
- আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।