তবে কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতি বোঝেন কম?
রাজনীতিবিদদের দেশ পরিচালনার জন্য নানান কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কখনো কখনো সাধারণ মানুষ খুবই বিভ্রান্ত হয় এবং সঠিক বিষয়টি তারা বুঝতে পারেন না। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতেও দেখেছি। আমাদের দেশেও তাই দেখছি আমরা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নানা ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যস্ত রাখছেন নানা কথা বলে। তালিকা করলে অনেক বড় একটি তালিকা হয়ে যাবে।
শুধু এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নয় তার সাথে আছেন আরো দু একজন মন্ত্রীও, তারাও প্রায় কাছাকাছি ভাষাতেই বিভিন্ন কথা বলেন যা সাধারন মানুষের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ে হুদয়ঙ্গম করা, তারা বুঝতে পারেন না আসলে এরা কি চাচ্ছেন দেশে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নানান কথা বলেছেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাই নিয়ে তুমুল মন্তব্য-হাস্যরস চলছে। এর আগেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ রাখার প্রসঙ্গে সুইস রাষ্ট্রদূত 'মিথ্যা বলছেন' এ রকম অকূটনীতিসুলভ বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
কিন্তু তারপরেও থামেনি তার অমৃত বাক্য প্রয়োগ। চিন্তার ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা আছে তা তিনি বারবার প্রকাশ করছেন তার এ ধরনের বাক্য প্রয়োগ করার ভেতর দিয়ে। তাকে ভুলে গেলে চলবে না যে এই ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছিল ভারত বিভক্তির মাধ্যমে এবং সেই ভারত বিভক্তি ঘটেছিল ধর্মভিত্তিক একটি চিন্তার জায়গা থেকে, যার নাম হয়েছিল পাকিস্তান ।
বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নানা পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, কিন্তু সবসময়ই ধর্মীয় বিষয় কিংবা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসমূহ এড়িয়ে চলতে হয়েছে। যে কারণে স্বাধীনতার আগে প্রকাশ্যে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি রাজনৈতিক অঙ্গনে কখনো শুনতে পাইনি । ১৯৫৫ সন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগের মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার ভেতর থেকে আওয়ামী লীগ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে চেয়েছে।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়েছি তখন দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মৌলবাদীরা কিন্তু পাকিস্তানিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে ওই একই জায়গাতে, তা হচ্ছে ধর্মীয় অবস্থান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তারা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে যে আমরা ভারতীয়দের উস্কানিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রর ক্ষতি সাধন করতে চাচ্ছি। ভাঙতে চাচ্ছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টা এই ছিল এই প্রচারণা। পৃথিবীর কোন মুসলিম রাষ্ট্রই আমাদেরকে তখন সমর্থন করেনি।
ফলে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেই খুব দ্রুততম সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এ ভূখণ্ড থেকে চলে যেতে ভারতীয় পক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী খুব দ্রুততম সময় বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেছিল। এমনকি যুদ্ধশুরু হওয়ার দিন থেকেই ভারত বাংলাদেশকে একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল যেন কখনো এই আলোচনা যাতে সামনে না আসে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তান ভাঙার একটি ভারতের কারসাজি ।
বিশ্ব মুসলিম জগতে নিজেদেরকে পরিষ্কার অবস্থানে ধরে রাখার জন্য মুসলিম প্রধান জনগোষ্ঠীর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ এর ইসলামিক রাষ্ট্রের সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এবং বাংলাদেশ ওআইসি রাষ্ট্রভুক্ত হয়েছিল। যদিও এ পদক্ষেপ আমাদের সংবিধানের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সংঘর্ষিক ছিল কিনা তা কখনোই স্পষ্ট করা যায়নি।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরে যেন কখনই অন্য কোন সম্পর্ক দ্বারা আখ্যায়িত না হয, এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন। কিন্তু আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সকল মেধাসত্তার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে যে বাক্যগুলো বলেন তাতে জাতির আমাদের মতন অর্ধশিক্ষিত মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন হয়। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে 'স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক' পৃথিবীর এরকম বিরল উপমা কোন কূটনৈতিক কোথাও দিয়েছে কিনা আমরা জানি না ।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে যে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন ঢাকার তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে। এটা একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিনের ভাষণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বাইরে প্রশ্ন উঠতে পারে এই ধরনের কোন বাক্য উচ্চারণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদেরকে সমর্থন করার জন্য মূলত বঙ্গবন্ধু সেদিন ইন্দিরা গান্ধীকে ওই সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন।
আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধ দেখেছি, আমরা কোরিয়া যুদ্ধ দেখেছি সেখানে কখনোই চীন সরাসরি তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেনি। যুদ্ধের আগে না পরেও না। এখনো উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের নানা দেশের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে সব সংকট আছে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে সরাসরি ভূমিকা রাখছে, কিন্তু বিশ্ব জনমতের কাছে তা প্রকাশ করছে না সরাসরি।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উত্তাপ শেষ হতে না হতেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামে শ্রীকৃষ্ণর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যে বক্তৃতা দেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য তার ব্যাখ্যা আমাদের মত অর্ধ শিক্ষিত সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। চট্টগ্রামে তিনি বললেন, আমি ভারতকে বলেছি বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে- এ কোন কথা? তাহলে নির্বাচনের প্রশ্ন আসে কেন? সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নানান উদ্যোগ কেন নিচ্ছে?
বিরোধীদলকে আস্থায় রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নানা কথা বলছেন। কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ যেন বিরোধীদলকে বাধা না দেয়।
সবকিছুই তো তার এই কথার ফলে অর্থহীন হয়ে পড়ে? প্রশ্ন হল তিনি যে কথাগুলো পাবলিকলি বলছেন তাকি দলের অভ্যন্তরে আলোচনার ভিত্তিতে বলছেন? না তিনি কোন অদৃশ্য ক্ষমতা বলে এই ধরনের কথা বলে যাচ্ছেন। তার এসব উক্তি যে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমঝোতার রাস্তা দুর্বল করে দেয় তা কি তার উপলব্ধিতে আছে?
ইসলামী মৌলবাদীরা- যতই ধারণা করা হোক যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আছে, এ ধারণা ভুল। কারণ রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা কখনোই তারা মেনে নেবে না, যেমনটি মেনে নিচ্ছে না ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা। রাষ্ট্রের সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এদেশের সংখ্যালঘুরা, এটাও সত্য। বহু ঘটনা ঘটছে ধর্মবিদ্বেষের জায়গা থেকে।
এমনি একটি পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য কখনোই গ্রহণযোগ্য না, কিংবা সুখকর না। এই ধরনের বক্তব্য পর্দার অন্তরালের অশুভ শক্তির হাতকেই শক্তিশালী করে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বিশেষ দ্রষ্টব্য- নিবন্ধের বিশ্লেষণ লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।