চীনা গণতন্ত্র, মাওয়ের পর সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্রেসিডেন্ট শি
সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দেশ ও দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি চীনের দিকে। দেশটি শাসিত হয় চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর দলটির জাতীয় কংগ্রেস (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা হচ্ছে দেশ এবং দলের নেতা নির্বাচন। এখান থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং যিনি আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবেও মনোনীত হন।
১৯৪৯ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছিল, এর আগে সেই পার্টির সবচেয়ে বেশি সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাওসেতুং আর এবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়বারের মতন পার্টির নেতা এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এই নির্বাচন পদ্ধতি পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নয়। প্রথমত, চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির এই জাতীয় সম্মেলনে যারা সারাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা নানানভাবে মনোনীত হন। পশ্চিমা দেশের মতো কোন একক ভোট দ্বারা তাদের মনোনয়ন করা হয় না। সম্প্রতি ২২৯৬ জন প্রতিনিধি বেইজিং এর গ্রেট হলে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের নেতার ভাষণ শোনার জন্য, যে ভাষণের ভাষা পৃথিবীর কোন রাজনীতিক বিশ্লেষণ করতে পারে না। কারণ সে ভাষণে যা থাকে তা খুবই সাংকেতিক। পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেই ভাষণকে অতীতে ব্যাখ্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।
এই ২২৯৬ জন প্রতিনিধি নানাবিধ প্রক্রিয়ার ভিতর থেকে মনোনীত হয়েছেন। দেশের প্রশাসনিক সেক্টর, কৃষক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, সেনাবাহিনী- এমনকি মাইনরিটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদেরকেও এই সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়। যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তারা সমস্ত দেশের ভিন্নভিন্ন প্রান্ত থেকে আশা নানা পেশার মানুষ। যে কারণে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির এই সম্মেলন মূলত অত্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। যদিও তা পশ্চিমা গণতন্ত্রকে অনুসরণ করে না। তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া একক কোনো ভোটের মাধ্যমে হয়না। তারা এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য মনোনীত হন।
প্রায় তিন মাস ধরে সারা দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে তাদেরকে মনোনীত করা হয়। আর সারাদেশ থেকে আসা এই ২২৯৬ প্রতিনিধিই চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচিত করেন। এদের মধ্যে আছেন ২০৫ জন স্থায়ী সদস্য ১৭১জন বিকল্প সদস্য। সারাদেশের এই প্রতিনিধিরাই বর্তমান প্রেসিডেন্টকে তৃতীয়বারের জন্য মনোনীত করছেন।
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান সম্মেলন জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কেবলমাত্র প্রতিনিধিরাই তাতে অংশ নিতে পারেন এবং তার তথ্য কখনো বাইরে আসে না। এমনকি চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংগুলো একই রকম। চীনের এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজের কাছে গৃহীত নয়। যে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম সবসময় চীনের এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অটোক্র্যাটিক ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে।
টেলিভিশন পত্রিকা সবকিছুর উপরেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একক নিয়ন্ত্রণ। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক চিন্তার কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এই গণমাধ্যমকে পশ্চিমা গণতন্ত্র গ্রহণ করে না। অথচ পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশগুলো নানান ভাবে বিশ্বের নানান প্রান্তরে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে চলছে।
চীন ১৯৪৯ সালের জন্মের পর থেকে কেবলমাত্র ভারতের সাথে কিছু সীমান্ত সংঘর্ষ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও কোন যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। পশ্চিম ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো আফগানিস্তান, সিরিয়া- সর্বত্রই যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও নানান রকমের আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে। ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখল করে যে ইসরাইলি রাষ্ট্র গঠিত হলো তার প্রতিও যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
চীনের বিভিন্ন অংশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে পশ্চিমা জনগোষ্ঠীর গণমাধ্যম ভিন্ন মত প্রকাশ করলেও সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে গোয়ান্তানামো বে কারাগারে বহু মানুষকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছিল, এখনো রাখ হয়।
চীনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৪৫ কোটি যা পৃথিবীর এক নম্বর জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে তারা পিছিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ববাদীতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে চীনের এই নেতৃত্ব।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বই আজকের চীনকে সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। ১৯৬২ সালে মাওসেতুং জীবিত থাকাকালে চীন ও ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, যুদ্ধের সেই বিষয়টি আজও তারা নিষ্পত্তি করতে পারেনি। দশক ধরে মাঝে মাঝেই তাদের এই সীমান্ত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তা সত্বেও পারস্পরিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠিকই ব্যাপকতা পেয়েছে। চীনের উৎপাদিত নানান পণ্য ভারতীয় বাজারে প্রধান ভূমিকা রাখছে।
চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিশ্বের অর্থনৈতিক নেতৃত্বে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দিয়েছে।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ এ সময়ে চীনে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষে প্রায় পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল। সেই চীন প্রকৃতপক্ষে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বহু আগেই। পৃথিবীর সকল দেশগুলোতেই চীনের উৎপাদিত সব ধরনের পণ্য, বাজার দখল করে নিয়েছে। সেখানে মেশিন থেকে মেশিনে যে কাঁচামাল ব্যবহুত হয় তাও আছে।
আমাদের দেশেও চীনের নানান প্রযুক্তির সাথে কৃষিপণ্যের (মসলা) উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ দেশেই তাদের উৎপাদিত টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি এবং গাড়িও তারা রপ্তানি করছে।
১৯৭৯ সাল থেকে তারা বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ অনুসরণ করেছে। এই ব্যবস্থার নাম তারা দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চীনা বৈশিষ্ট্যে।
চীনের উত্থানের প্রথম পর্যায়েই সারা পৃথিবীর বস্ত্রখাত প্রায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। পৃথিবীর উৎপাদিত তুলার অর্ধেকের বেশি কনজিউম করতে শুরু করে। ফলাফল ৯০ দশক থেকে শুরু করে তারাই হয়ে ওঠে পৃথিবীর বস্ত্র খাতের প্রধান সরবরাহকারী। যদিও তাদের উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ে নানান বিতর্ক হয়েছে। রাষ্ট্রায়াত্ব খাতকে নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সক্ষমতা অর্জন করেছে চীন।
চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম, পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা যতই বিতর্ক করুক, চীনের জনগণের সামগ্রিক সূচকগুলো যেভাবে উন্নত হয়েছে তাতে ওই দেশের মানুষ যে এই পদ্ধতিকে সমর্থন করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও কখনো কখনো পশ্চিমা গণমাধ্যমে ফুলিয়েফাপিয়ে নানা ধরনের বিক্ষোভের খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তার ব্যাপকতা, উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না।
চীনের জিনজিয়ান প্রদেশের উইঘুর সম্প্রদায়কে নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম সবসময়ই ব্যাপক প্রচারণায় লিপ্ত। কিন্তু অনেক ভ্রমণকারীদের মতো, আমি নিজেও ২০১৮ সালে ওই অঞ্চলে ১৫ দিন কাটিয়ে তেমন ঘটনার অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ, যে কারণে রাজনৈতিক অস্তিত্বশীলতার বিপক্ষে চীনের শাসন ব্যবস্থা খুব বেশি নজরদারি করে; যা স্বাভাবিক। অঞ্চলটির চতুর্দিকের সীমান্ত দেশগুলোতে মুসলিম উগ্রবাদীদের অবস্থান রয়েছে। তাদের প্রভাব কখনো কখনো অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার জন্ম দেয়। কিন্তু তা দিয়ে সবকিছু প্রমাণ করা যাবে না।
জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে যে রাজনীতি, যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা - তা গ্রহণ করাই প্রধান। বিশেষ করে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতন আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে না চীন। তবে এবারের জাতীয় কংগ্রেসের আগে এক চীনা নীতিকে যেভাবে তারা সামনে নিয়ে আসছে তাতে আগামী দিনে তাইওয়ানকে তারা সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিবে কিনা তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।
১৯৯৯ সালে হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব চীনের কাছে ফেরত আসার পর থেকে গত ২২ বছর যাবত তারা হংকংকে যেভাবে তাদের অংশ বানিয়েছে, তাতে হয়তো একসময় সরাসরি তাইওয়ানের জনগণও চীনের অংশ হতে রাজি হয়ে যাবে। তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রায় একই রকম। ফলে চীনের এই অব্যাহত উন্নয়নের কারণে তাইওয়ানের জনগণ চীনের সাথে একত্রিত হইতে চাইবে। তবে তখনো হয়তো কোনো গণভোটের ফলাফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানতে চাইবে না।