কেন সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘদিনের কার্যকর ব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে চায় বিজেপি?
ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য গুজরাট। এই গুজরাটের দুই রাজনৈতিক নেতা গত শতাব্দীতে ভারতবর্ষকে ভাগ করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও অপরজন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী। দু'জনই দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের জাতির পিতা। এই গুজরাট থেকেই জন্ম ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির ক্ষমতায়ন। ২০০২ সালে ইতিহাসের জঘন্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সরকারি হিসেবেই গুজরাট দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ১০৪৪, নিখোঁজ ২২৩ এবং আহত ২৫০০ জন। যাদের অধিকাংশ মুসলিম। প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি।
তৎকালীন বিজেপি'র রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই দাঙ্গায় উসকানি দেওয়া ও হত্যাযজ্ঞ থামাতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন তদন্তে গুজরাট দাঙ্গার ক্ষয়ক্ষতি ও সরকারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও বিচার বিভাগীয় তদন্তে রাজ্য সরকার ও নরেন্দ্র মোদীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। যদিও ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদীর সেই দেশে ভিসার আবেদন খারিজ করে দেয়, যা ছিল গুজরাট দাঙ্গার বিরুদ্ধে মার্কিন ব্যবস্থা।
সদ্য সমাপ্ত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি'র ফলাফল প্রমাণ করে গুজরাট দাঙ্গার দায় থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেশের ভিতরে ও বাইরে সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষিতে অনেকে বিজেপির পরাজয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা।
গুজরাটে প্রায় ৯ থেকে ১০ শতাংশ মুসলিম ভোটার। ৩০টিরও বেশি বিধানসভা আসন রয়েছে যেখানে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ১৫ শতাংশের বেশি। মুসলিম ভোটারদের উপর ভর করে কংগ্রেস অন্যবার জয়লাভ করলেও এবার তেমনটি ঘটেনি। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে বিজেপি আগেরবার মুসলিম প্রার্থী দিলেও এবার তা করেনি। তারপরও বিজেপি সেখানে জয় পেয়েছে। দিল্লি ও পাঞ্জাবের ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি গুজরাটেও চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভাবা হয়েছিল আম আদমি পার্টি দিল্লির মতো হয়তো গুজরাটেও ভালো অবস্থান সৃষ্টি করবে কিন্তু দেখা গেল ভিন্ন। গুজরাটে কংগ্রেসের আলাদাভাবে নির্বাচন করার কৌশল বিজেপির অনুকূলে গিয়েছে। নির্বাচনে বিজেপি ৫০ শতাংশ ভোট পেলেও আম আদমি ও কংগ্রেস মিলে পেয়েছে ৩৮ শতাংশ ভোট। এই দুই দল যৌথভাবে নির্বাচন করলে বিজেপিকে হারানো যেতো।
হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছে। হিমাচল ছোট ও ভারতীয় রাজনীতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও বিরোধীদের জয় হয়েছে এবং কংগ্রেস জাতীয় ক্ষেত্রে তার পরিচয় ধরে রাখতে পেরেছে।
গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতীয় পার্লামেন্টে এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০১৬ সালে ভারতীয় সংবিধানের নিরানব্বইতম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগের জন্য কলিজিয়াম (ভারতের কলিজিয়াম সিস্টেম বলতে যা বুঝায় তা হল, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ জ্যেষ্ঠ অপর দুই বিচারপতি দিয়ে এই কলিজিয়াম গঠিত হয়) ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংসদে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয়ই মিলে সংবিধানের নিরানব্বইতম সংশোধনী পাস করে।
ভারত কলিজিয়াম ব্যবস্থায় হাইকোর্ট সমূহের বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ অনুমোদন করেন।
এই ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলোর পছন্দ নয়। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলগুলো মতামত রাখতে চায় বা অন্যভাবে বললে, দলগুলো তাদের পছন্দের লোককে বিচারপতি হিসেবে পেতে চায়। কলিজিয়াম ব্যবস্থায় সে সুযোগ সীমিত। সেকারণেই বিজেপি কংগ্রেস উভয়ই কলিজিয়াম ব্যবস্থার অবসান চেয়েছে। কিন্তু বাধ সেধেছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা সংবিধানের এই সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে বলেছে বিচারপতি নিয়োগের আগের কলিজিয়াম ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। এটা আমাদের দেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রদানের মতই। যদিও আমাদের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বাতিল করে সংসদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। আমাদের উচ্চ আদালত বিচারপতি অপসারণে জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদ অংশটুকু বাতিল করে দেয়। সরকার এই রায়ে রিভিউয়ের আবেদন করেছে যা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কলিজিয়াম ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেও আঘাত যে আসবে তা অনুমান করা যাচ্ছিল। সরকার কলিজিয়ামের দুই জাস্টিসের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার প্রেক্ষিত ঐ কলিজিয়াম থেকে মনোনীত সকল মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। কলিজিয়ামের আপত্তি ওঠানো একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর নতুন করে কলিজিয়াম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিচারপতির বিরুদ্ধে সরকারের কী আপত্তি তা জানতে চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। বিচার অঙ্গনের বিষয় আদালত পাবলিক করতে চায় না বিধায় রিটটি খারিজ করে দেওয়া হয়।
বিচার বিভাগ বনাম সরকার- এ বিতর্কের কোন অন্ত নেই। সম্প্রতি এই বিতর্ক নতুন করে উসকে দিয়েছেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। ২০১৬ সালে সংসদে পাস হওয়া ঐ কলিজিয়াম ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধান সংশোধন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের উপস্থিতিতেই বলেন, 'সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি, সংসদে পাশ করা কোনও আইন বাতিল করা যেতে পারে। তিনি এই ঘটনাকে 'গুরুতর' আখ্যায়িত করেন। যদিও সুপ্রিম কোর্ট ইতিপূর্বেই ওই সংশোধনীকে 'অসাংবিধানিক' বলে বাতিল করে দেয়। ঐ একই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি কারো নাম উল্লেখ না করে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, কলিজিয়াম ব্যবস্থা একটি আইনী ব্যবস্থা। সরকারি পদধারী কেউ এর বিরুদ্ধাচারণ করা উচিত নয় এবং আদালত এটা ভালোভাবে নিবে না। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের জন্য আইন প্রণয়নের এখতিয়ার অবশ্যই সংসদের এবং সেই মোতাবেক তারা আইন প্রণয়ন করে থাকেন। তবে কোন আইন সংবিধান পরিপন্থী কি না অথবা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তা দেখার দায়িত্ব অবশ্যই আদালতের এবং আদালত সংবিধান প্রদত্ত এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। জাতীয় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন আদালতের মান্যতা না পাওয়ায় সরকার হয়ত অখুশি কিন্তু এটা আইন না মানার যুক্তি হতে পারে না, বলে প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেন।
এ রকম পরিস্থিতিতে ভারতের লোকসভায় একটি বেসরকারি বিল উত্থাপন করা হয় যেখানে একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয় এবং প্রস্তাবটি লোকসভায় আলোচনার জন্য কণ্ঠভোটে সমর্থিত হয়। যদিও আম আদমি পার্টির একজন সদস্য বিষয়টির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে একাধিকবার এ বিষয়ে আমাদের লোকসভায় আলোচনা হয়েছে সুতরাং বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কোন আলোচনার প্রয়োজন নাই। ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশেই বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্নে নানা প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের বিচারক নিয়োগের আইন করার কথা '৭২ সালের সংবিধানে বলা আছে, যা আজও করা হয়নি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিতর্কিত অবস্থান আছে। এই বিচার ব্যবস্থার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বহুদিন যাবত কার্যকর ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিজেপি তথা মোদী সরকারের।