আন্দিজের বিমান দুর্ঘটনা: বাঁচার তাগিদে নরখাদকে পরিণত হওয়ার ৫০ বছর পর
১৯৭২ সালের কথা। উরুগুয়ের একটি রাগবি দলকে নিয়ে যাচ্ছিল বিমানটি। আন্দিজ পর্বতমালায় বিধ্বস্ত হলো সেটি। ঘটনাক্রমে বেঁচে রইলেন ১৬ জন। চোখের সামনেই প্রাণ হারালেন তাদের আহত বন্ধুরা। প্রাণ হারানো বন্ধুদের শব খেতে বাধ্য হলেন বেঁচে থাকা মানুষগুলো। নেহাতই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শবাহার করতে হলো তাদের।
৫০ বছর পরও তাদের সে কাহিনি শিহরণ জাগায়। এ কাহিনি নিয়ে 'অ্যালাইভ' নামে পুস্তক রচিত হয়েছে। পিয়ার্স পল রিড এর বইটি গোটা দুনিয়াতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ৫০ লাখের বেশি বই বিক্রি হয়েছে। একই নামে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রও তৈরি করেছে হলিউড। এমনকি হালে তৈরি 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' নামের ভারতীয় বাংলা ওয়েব সিরিজেও এ ঘটনার দূরাগত ছায়া রয়েছে।
ঘটনার পাঁচ দশক পরে সেই বেঁচে যাওয়া মানুষদের নিয়ে নেটফ্লিক্সে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। তাদের সেই ৭২ দিনের অগ্নিপরীক্ষার কাহিনি আজও মানুষকে টানছে। তবে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো প্রাণ রক্ষার তাগিদে নরমাংস ভোজের মতো চরম পথ বেছে নেওয়ার জন্য একবারও অনুতাপ বোধ করেননি।
সে দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া রামন সাবেলা সম্প্রতি বলেন, 'অবশ্যই মানুষের মাংস খাওয়ার ভাবনা-চিন্তা ভয়ানক ঘৃণ্য।' তিনি এখন একজন সফল ব্যবসায়ী এবং তার বয়স ৭০। তিনি আরও বলেন, 'মানুষের মাংস মুখে দেওয়া প্রথম দিকে খুবই কষ্টদায়ক ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তারপর থেমে তিনি বলেন, এক অর্থে আমাদের বন্ধুরা হলেন দুনিয়ার সেরা মরণোত্তর অঙ্গদানকারী ব্যক্তি। তাদের মৃতদেহ আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি যুগিয়েছে।'
দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। প্রতিবছর ২২ ডিসেম্বর তারা একসাথে মিলিত হন। ৫০ বছর আগে এ দিনটিতে তাদের উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছিল। সে ঘটনার স্মরণে বারবিকিউয়ের আয়োজন করেন তারা। খাদ্যতালিকায় থাকে গরুর স্টেক বা শুকরের সসেজ। এছাড়া ৫০ বছর আগের সেই দুর্ঘটনার দিন ১৩ অক্টোবর নিহত বন্ধুদের স্বজনদের সাথে গণউপাসনায় যোগ দেন এ দলের সবাই। এ বছর ১৩ অক্টোবর দুর্ঘটনার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উরুগুয়ের জাতীয় ডাক দপ্তর নতুন এক সেট ডাকটিকেট অবমুক্ত করেছে।
বেঁচে যাওয়া মানুষদের দলের অন্যতম সদস্য কার্লিটোস পেজ ফোনে সাক্ষাৎকার দেন ব্রিটিশ দৈনিক টাইমকে। উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিও থেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'সে সময় আমাদের হাতে যদি মোবাইল ফোন থাকত তবে গল্পটি ভিন্ন হতো। বিমান দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে যে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তেমনটি ঘটত না।'
বিধ্বস্ত বিমানের লেজের দিকে উষ্ণতার ছলনাময়ী আশ্বাসে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো গাদাগাদি করে কাটায়। চকলেট, মিষ্টি, জ্যাম ও মদের নগণ্য সরবরাহ কয়েকদিনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়। দুর্ঘটনার ধকলে ফেয়ারচাইল্ড বিমানটির ডানাগুলো দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যায়। দানবাকৃতি স্লেজ গাড়ির মতো প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসে বিমানটি। পর্বতমালার ৪০০০ মিটার বা ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় বরফের স্তূপে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় বিমানটি।
বেঁচে যাওয়া মানুষের দলে অনেক খ্যাতনামা এবং বিত্তবান পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। দুর্ঘটনার পরে বেতার সংবাদে তারা শুনতে পান, উরুগুয়ের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য তল্লাশি অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রামন সাবেলা বলেন, 'দেশে আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে কী মারাত্মক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বেদনানুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে তা মনে হতে থাকে। আর তাতে বৈরি পরিবেশকে টেক্কা দিয়ে বেঁচে থাকার আকুতি আগের চেয়েও জোরদার হয়ে ওঠে।'
উরুগুয়ের নামজাদা চিত্রকরের সন্তান কার্লিটোস পেজ বলেন, 'ওই পর্বতমালায় বরফ, তুষার, পাথর বা নুড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই চারদিকে। এমন অবস্থায় টিকে থাকার জন্য নরমাংস আহার তেমন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। কৌতূহলীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যতদূর মনে করতে পারছি নরমাংসে বিশেষ কোনও স্বাদ পেয়েছি বলে মনে হয় না।'
ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে বক্তৃতা দেওয়াকে পেশা হিসেবে নেন পেজ। এ বিষয়ে আমেরিকায় তিনি অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমেরিকার এয়ারলাইনসগুলোতে আমি ষাট লাখ মাইল ভ্রমণ করেছি।' তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবে বিটলসদের যেমন ইয়েসটারডে গানটি বারবার গাইতে হয়েছে আমাকেও একই দুর্ঘটনার কথা বারবার শোনাতে হয়েছে। আমি শ্রোতা-দর্শকদেরকে প্রতিবারই প্রশ্ন করেছি, আপনাদের মধ্যে কেউ কী কখনও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু কখনও কেউ হাত তোলেননি।'
মন্টিভিডিও থেকে বিমানটি উড়েছিল সান্তিয়াগোর পথে। সেখানে চিলির একটি দলের বিরুদ্ধে খেলার জন্য যাচ্ছিল সৌখিন রাগবি দলের সদস্য এবং তাদের সমর্থকরা। রাগবি দলের খেলোয়াড় হিসেবে যাচ্ছিলেন পেজ ও অন্যান্যরা। ঘন কুয়াশায় দিগভ্রান্ত হয়ে যান উরুগুয়ের বিমান বাহিনীর ফ্লাইটটির পাইলট। আন্দিজের পর্বতমালায় বিধ্বস্ত হয় বিমানটি।
৪৫ যাত্রীর মধ্যে দুর্ঘটনায় নিহত হন ১২ জন। আহত হওয়ার ধকলে অনেকেই চোখের সামনে মরতে থাকেন। বেঁচে থাকা মানুষগুলোর অসহায় দৃষ্টিতে এসব দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। দুর্ঘটনার পর প্রথম রাতের কথা মনে করেন সাবেলা। তিনি বলেন, 'চট করে নেমে এলো রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্নার আওয়াজ চারপাশে। মানুষজন আটকে পড়েছে। ভয়ে হতবিহবল। একজন নারী আর্তস্বরে চিৎকার করছেন, "চেয়ারের তলে আটকে গেছে আমার ভাঙ্গা পা।" তিনি যখন মারা যান তখনও আমি তার হাত ধরেই ছিলাম।'
বাইরে বরফের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহগুলো।
মেডিক্যালের ছাত্র বরার্তো ক্যানেসাই প্রথম এসব লাশ খাওয়ার কথাটি তোলেন। তিনিই প্রথম ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে মৃতদেহ থেকে মাংসের টুকরা তুলে আনেন। তিনি বলেন, শবভুক ছাড়া আমাদের আর কোনও গতিই ছিল না। না হলে ক্ষুধায় ভুগে মরতে হবে। মৃতদেহ থেকে মাংস কেটে আনার কথা বলতে যেয়ে তিনি আরও বলেন, 'এসব আমাদের বন্ধুদের মরদেহ– এটাই ছিল একমাত্র বড় ধরণের সমস্যা। বেঁচে ফিরে আসার পর তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে যেতে হয়েছে এবং শবভুকের ব্যাখ্যা দিতে করতে হয়েছে।' ক্যানেসা আরও বলেন, 'বিমান দুর্ঘটনায় যদি আমি মারা যেতাম এবং জীবন বাঁচানোর তাগিদে যদি বন্ধুরা আমার লাশ খেত, তবে আমি সম্মানিত বোধ করতাম।'
তবে বেঁচে যাওয়া সবাই চট করে শবভুকের কাতারে নেমে আসেননি। অনেকের মনেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঝড় বয়ে গেছে। সাবেলা বলেন, এভাবে মৃতদেহের মাংস খাওয়া ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনও পথই খোলা ছিল না। কিন্তু মরদেহ খাওয়ার জন্য আগেভাগে কোনও অনুমতি তো নেয়া হয়নি। কাজেই আমরা একে অন্যের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম যে মারা গেলে জীবিতরা তাদের প্রাণ রক্ষার প্রয়োজনে আমাদের মৃতদেহ খেতে পারবেন।
অ্যালাইভের ব্রিটিশ লেখক রিড বলেন, মৃতদেহ ভক্ষণে অংশ নিতে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসকেও ব্যবহার করা হয়েছে। যিশু এবং তার নৈশভোজ ইউক্যারিস্টের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যিশু তার দেহ অনুগামীদেরকে দিয়েছেন।
প্রথম প্রথম মৃতদেহের চামড়া এবং চর্বি কেটে নিতো তারা। তারপর তাদের সাহস বাড়তে থাকে। খাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পেশী এবং মস্তিষ্কও কাটতে থাকেন। মৃতদেহ খাওয়া নিয়ে বাধা-নিষেধের বেড়াজাল কাটাতে পারেন তারা। করোটিতে খাবার গ্রহণ করতে থাকেন। নরমাংস দিয়ে তৃপ্তিদায়ক খাবার বানানোর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। মূল পাণ্ডুলিপিতে ঘটনার এমন বিশদ বর্ণনা দুর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে আবেগময় করে তোলে। তারা আশংকা করেন যে মানুষজন হয়ত রাস্তায় তাদের ইট-পাথর মারবে। তবে লেখকের যুক্তি হলো, সামগ্রিকভাবে একটা ধারণা তৈরি হয় যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লোকজন হয়ত সত্যিকার পরিস্থিতি বুঝতে পারবে।
একসময়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো তাদের উদ্ধার পাওয়ার সব আশা হারিয়ে ফেলেন। সে সময়ে ক্যানেসা এবং দলের আরেক সদস্য ফার্নান্দো প্যারাদো সহায়তা লাভের তালাশে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা পাঁচ হাজার মিটার উঁচু পাহাড় ডিঙ্গানোর ঝুঁকি নেন। পর্যাপ্ত সাজ-সরঞ্জাম নিয়েও এমন পাহাড় ডিঙ্গানোর কাজ রীতিমত দুঃসাধ্য! হাতে তৈরি নিদ্রাথলি বা স্লিপিং ব্যাগ এবং রাগবি মোজা ভর্তি মানুষের মাংস নিয়েই আপাত অসম্ভব সে কাজটি করেন এই দু'জন।
দশদিন পথ চলার পর প্রচণ্ড স্রোতের পানিধারার এক পাড়ে পৌঁছালেন তারা। অপর পাড়ে রয়েছে চিলির এক রাখালের ঘর। পানির গর্জনে তাদের চিৎকারের কিছুই বুঝতে পারলেন না ওই রাখাল। তবে রাখালটি চিৎকার করে বললেন, মানানা। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ হলো সকাল। আর ইঙ্গিতে জানালেন, পরদিন সে আবার আসবে।
পরদিন একটা কাগজে মোড়া পাথর ছুঁড়ে দিলেন সে রাখাল। তাতে বাধা রয়েছে একটা পেন্সিল। প্যারাদা লিখলেন, পর্বতমালায় যে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে আমি সেখান থেকে এসেছি। আরও লিখলেন, তার সঙ্গী বন্ধু ক্যানেসার হাঁটার মতো কোন শক্তিই নেই। এদিকে দুর্ঘটনা স্থলে তাদের আরও বন্ধুবান্ধব রয়েছেন। যদি কোনও সহায়তা না মেলে তবে সবাই বেঘোরে মারা যাবে। লোকটা সাহায্যের জন্য সবাইকে সতর্ক করতে ঘোড়ায় চড়ে একশ মাইল পথ পাড়ি দিলো।
দুর্ঘটনার আড়াই মাস পরে অকুস্থলে হেলিকপ্টার আসছে দেখে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে ফুর্তির জোয়ার বয়ে গেলো। এর মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর অনেকেই আধাআধি ওজন হারিয়েছে। উদ্ধার পাওয়ার দিনটির কথা মনে করে সাবেলা বলেন, ওরা প্রথমেই আমাদের নিয়ে যান সান্তিয়াগোর একটি হাসপাতালে। সেখানে প্রথম গরম পানিতে গোসল করার আনন্দের কথা আজও ভুলতে পারিনি।
পেশাগত জীবনে ক্যানেসা এখন এক খ্যাতনামা শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাজ্যের গাই'স হাসপাতালে পড়ার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ঈশ্বর আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেছেন। আরও বলেন, পর্বতমালায় টেকার সংগ্রাম করার সময় নিজেদের মধ্যে বেঁচে থাকার যে অদম্য ইচ্ছা শক্তি দেখেছেন নিজের রোগীদের মধ্যে সেই একই শক্তি প্রত্যক্ষ করেন তিনি। রোগীদেরকে তিনি বলেন, আমাদেরকে পর্বত বাইতে হবে এবং এ কাজে আমিই তোমাদের পথ দেখাবো।