থাইল্যান্ডের তরুণ নেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ যে কারণে জটিল
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড। দেশটি ১৯৩২ সালে রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদ থেকে বেড়িয়ে এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করে । তবে দীর্ঘমেয়াদীভাবে, চূড়ান্ত অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। নানান সময়ই সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সাল থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর করেছে সামরিক জান্তা।
বর্তমান সংবিধান অনুসারে, দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু করেছে সামরিক জান্তা। সর্বমোট ৭৫০ জন সংসদ সদস্য রয়েছে এই পার্লামেন্টে। ৫০০ জন সরাসরি নিম্নকক্ষে, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। সিনেট সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন না। সিনেটের ২৫০ জন সদস্য মনোনয়ন লাভ করেন। এই সদস্যরা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস এন্ড অর্ডার (এনসিপিও)-র মাধ্যমে মনোনীত হন। ২৫০ জন সিনেট সদস্যদের মধ্য থেকে ১৯৪ জনকে সামরিক বাহিনীর সরাসরি মনোনয়ন দেয়। এর বাইরে ১০টি পেশা থেকে নেওয়া হয় ৫০ জন। সামরিক বাহিনীর বাইরের যে পেশাগুলো থেকে এই সদস্য সংগ্রহ করা হয় তার মধ্যে শিক্ষক, আমলা, আইনজীবী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, বেসরকারি কোম্পানি মালিক উল্লেখযোগ্য। দশটি পেশা থেকে ২০০ জনের নামের তালিকা এনসিপিও-র কাছে পাঠানো হয়। যাদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত করা হয় ৫০ জনকে। আর ৬ জন রাজার প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত হন।
সংবিধানের উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন আইন কার্যকর করা যায় না। নিম্নকক্ষের নির্বাচনে যে-ই জয়লাভ করুক না কেন, ৩৭৬টি ভোট প্রয়োজন হবে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হওয়ার জন্য। এই ৩৭৬টি ভোটের মধ্যে আবার ৭৫টি ভোট উচ্চকক্ষ থেকে পেতে হবে। এমনি একটি সংবিধান দ্বারা থাই সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত রোববার। নির্বাচনে সরাসরি ভোট কারচুপির কোনো অভিযোগ সামনে আসেনি। এতে একটা বিষয় প্রমাণিত হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট, যে সদিচ্ছার অভাব আমরা দেখেছি আমাদের বিগত দুটি নির্বাচনে।
থাইল্যান্ডের নিম্নকক্ষের ৫০০ আসনের নির্বাচনে দশটির অধিক রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে । সামরিক বাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দলটি তৃতীয় স্থান দখল করেছে ১২৫টির মতন আসন পেয়ে। প্রথম স্থানে থাকা রাজনৈতিক দলের নাম হচ্ছে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি)। এ দলের প্রধান একজন তরুণ নেতা। বয়স ৪২ বছর। এই নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাথের দল মোট ১৫১টি আসন লাভ করেছে । কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ৩৭৬ জন সদস্যের সমর্থন দরকার।
তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া অনিশ্চিত হয়েছে এই জন্য যে, বর্তমান সংবিধানে একটি জটিল ধারা সংযোজিত আছে। থাইল্যান্ডের কোনো নাগরিকের গণমাধ্যমের অংশীদারিত্ব থাকলে তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পাবেন না। এমন একটি ধারা রয়েছে সংবিধানে। যেকারণে এই তরুণনেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক জটিল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কারণ একটি গণমাধ্যমের মালিকানা রয়েছে তার।
থাইল্যান্ডের গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক প্রভাবশালী নেতা প্রাক্তন টেলিকমিউনিকেশন মোগল থাকসিন সিনাত্রা। তিনি ১৯৯৮ সালে থাই রাখ থাই নামক একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন। ২০০১ সালের এক নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তার সঙ্গে এই দল ক্ষমতায় আসে এবং গণতান্ত্রিকভাবে পূর্ণ মেয়াদে শাসন পরিচালনা করে। একইসঙ্গে তার টেলি-যোগাযোগ ব্যবসার আরো প্রসার ঘটে এবং দেশে তিনি মাদক-বিরোধী যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ফলে কয়েক হাজার মাদক ব্যবসায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। তারপরও তার জনপ্রিয়তার কোনো কমতি ঘটে না। স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য তিনি বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু তিনি ক্ষমতা হারান। কীভাবে? তার ক্ষমতা হারানোর প্রধান কারণ ছিল- দেশের প্রচলিত আইন পাল্টে তিনি তার পক্ষে নতুন আইন করেছিলেন। আইনটি ছিল কোনো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করলে তার আয় থেকে সরকারকে কর দিতে হবে না। এই আইন প্রণয়নের কিছুদিনের মধ্যেই তার কোম্পানির শেয়ার সিঙ্গাপুরের সিংটেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন এবং এই বিক্রির ফলে সেই সময়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, কয়েকশো মিলিয়ন ডলার কর অব্যাহতি লাভ করেন থাকসিন । তখনই থাইল্যান্ডে হলুদ শার্ট আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং সেই আন্দোলনের পরিণতিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। এবং থাকসিন দেশ ছাড়েন। থাকসিনের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়েই থাইল্যান্ডের রাজনীতি গণতান্ত্রিক ধারা থেকে ছিটকে যায়।
থাইল্যান্ডের বর্তমানের এই সংবিধান পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত একটি সংবিধান। পশ্চিমা গণতন্ত্র-প্রেমীরা থাইল্যান্ডের এই সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন গণতন্ত্রের ব্যাপারে কখনো কোন সমালোচনা করেননি। কিংবা সেই ২০০০ সালের শুরুতে যে ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল- তা নিয়েও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখিনি আমরা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হতে যাচ্ছেন, তা নির্ধারিত হবে। তবে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়- দেশটি নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিতর্কে জড়িয়ে নেই।
রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান প্রচলিত এই নির্বাচন ব্যবস্থাকেই মেনে নিয়ে এবারকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনের ঘোষণা সরকারিভাবে প্রকাশিত হওয়ার আগে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়; কোথাও কোন অনিয়ম ধরা পড়লে নির্বাচন আইন অনুসারে প্রার্থীকেই সেক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা ও জেলে যেতে হবে- সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন এরকম একটি সংবিধান তাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকের অন্তত বিতর্কে উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছে।
হয়তো সামরিক বাহিনীর মনঃপুত সরকার গঠিত না হলে আবার একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটবে। তবে গত ১০ বছর যাবত যে গণতান্ত্রিক সংস্কার আন্দোলন চলছে তাতে বিশ্বব্যাপী পর্দার অন্তরালে থাকা সামরিক বাহিনী- পশ্চিমা গণতন্ত্র-প্রেমীদের কাছে আদরের হয়ে উঠেছে। থাই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এখনো তেমন কোনো বড় ধরনের গণআন্দোলনের ইতিহাস নেই। জনসংখ্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান। সাড়ে সাত কোটির মতো। দেশটির বর্তমান সংসদ সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে সাড়ে সাতশ। বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে মার্কিনিরা এফ-১৬ বিমান বিক্রি করেছিল এই দেশটিতেই।
তাছাড়া, এশিয়ার এই দেশটি কোনদিন উপনিবেশিকতার শিকার হয়নি।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক