‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার জন্যই কি দরিদ্র মানুষের ওপর বাধ্যতামূলক আয়কর?
এবারের বাজেটে কীসের দাম বাড়ছে বা কীসের দাম কমছে, এর চাইতেও আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে দরিদ্র মানুষের ওপর বাধ্যতামূলক আয়কর চাপানোর ব্যবস্থাটা। বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে, সরকার এমন ব্যক্তিদের ওপর কর ধার্য করেছে, যাদের আয় করযোগ্য নয়। অর্থাৎ করযোগ্য আয় না থাকলেও নূন্যতম ২,০০০ টাকা কর দিতে হবে। বিষয়টা দাঁড়ালো এমন যে, 'সরকারি সুবিধা যদি পেতে চাও, আয়কর রিটার্ন জমা দেও।'
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই নিয়ম কার্যকর করা হবে। সরকারের কি ধারণা নেই যে, কতজন মানুষের পক্ষে নূন্যতম ২,০০০ টাকা কর দেওয়া সম্ভব হবে? যে মানুষগুলোর নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, সেই মানুষগুলোকে কেন করের বোঝা ও ঝামেলা টানতে হবে? বছরে দুই হাজার টাকা দিতে হলে, একজন অতি দরিদ্র মানুষকে প্রতিদিন ৫.৪৭ টাকা করে সঞ্চয় করতে হবে, যা একেবারে অসম্ভব।
অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, 'স্মার্ট বাংলাদেশে' মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ ডলার। তাহলে কি আমরা ধরে নেবো যে, সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে গরীবের ২,০০০ টাকা কর প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে? দেশে এত ঋণ খেলাপি রেখে, এত কালো টাকা রেখে এবং দুর্নীতি ও টাকা পাচার অব্যাহত রেখে সেই স্মার্ট বাংলাদেশটা কবে হবে জনিনা। তবে হলে হয়তো, কারো জন্যেই আয়কর দেওয়াটা তেমন আর কঠিন থাকবে না। স্মার্ট বাংলাদেশ দেখার সুযোগ কতজন মানুষ পাবেন, তা জানিনা। তবে জানি যে, এভাবে নানাদিক দিয়ে গলা চেপে ধরলে সাধারণ মানুষ এমনিই দমবন্ধ হয়ে মারা যাবেন।
তাছাড়া, দেশের অসংখ্য মানুষ এখনো নিরক্ষর, অনেক মানুষ ফরম পূরণ ও স্বাক্ষর করতে পারেন না এবং আয়কর ও আয়কর রিটার্ন দেওয়ার বিষয়টিও তাদের কাছে খুবই অপরিচিত ও ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। নিবন্ধিত করদাতাদের তাদের আয়, ব্যয় এবং সম্পদ বিবরণী ফাইল করতে হবে এবং ৩৮ ধরনের পরিষেবা পেতে রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণ দিতে হবে। এদেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এটি একটি তামাশা ছাড়া আর কী হতে পারে?
এর মানে এই দাঁড়ালো যে, আয়কর মুক্ত সীমা বলতে আর কিছুই থাকলো না। সরকার যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যয় করবে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করবে, প্রকল্প বা ভবন নির্মাণ করে ফেলে রাখবে, সরকারি লোকজন বিদেশ ভ্রমণ করবে, সরকার যেমন খুশি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন বাড়াবে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেবে, ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সুযোগ দেবে; অন্যদিকে, গরীবের ঘাড় ভেঙে কর আদায় করবে।
রিটার্ন দাখিলের রশিদ না দেখালে ৩৮ ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে নাগরিককে। যেমন- ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলে, গাড়ির মালিক হলে, ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে, কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, ব্যবসায় সমিতির সদস্য হলে, সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করলে ইত্যাদি।
বছর বছর দেশে বাজেট হয়, কিছু জিনিসের দাম কমে, অধিকাংশই বাড়ে। দাম বাড়ানো নিয়ে সাধারণ মানুষ চূড়ান্তভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। বাজেটে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসার আগেই অসংখ্য জিনিসের দাম বেড়ে বসে আছে; নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, ওষুধ, খাদ্যপণ্য। বাজেটে যার দাম কমে, বাজারে তা সাধারণত কমে না।
করোনার সময় থেকে আমরা শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়তেই দেখেছি। ভেবেছিলাম করোনা বিদায় নিলে দাম কমে যাবে। কিন্তু না, জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে, কিন্তু তাও কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো উত্তেজনাও নেই। দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে আদতে ২৪৮ পৃষ্ঠার কোনো বাজেট দরকার হয়না। বাজেট ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম এতোটাই বেড়ে যায় যে, বাজেট নিছক একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর বেশি কিছু নয়।
পাচার করা অর্থ বা সম্পদের ঘোষণা দিয়ে তা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে পাচার করা বা চুরি করা অর্থ আনেন, তাহলে তাঁকে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার এই বহুল আলোচিত সুযোগটি বাতিল হচ্ছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এই বিষয়ে কোনো ঘোষণা নেই। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় বিদেশে পাচার করা টাকা বিনা প্রশ্নে ফেরত আনার সুযোগ নিয়ে। তখন এ সুযোগ দেওয়া নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়।
অর্থনীতিবিদেরা বলেছিলেন, কেউ এ সুযোগ নেবে না। তাঁদের কথাই সত্য হতে চলেছে। কারণ, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে টাকা দেশে আনেননি। (সূত্র: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাচারকৃত টাকা এভাবেই পড়ে থাকলো। সরকারের ঘরে কোনো টাকা ফিরে এলোনা। সুযোগটি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, কেউ পাচার করা টাকা কর দিয়ে দেশে আনলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। তখন নীতিনির্ধারকেরা আশা করেছিলেন যে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই টাকা দেশে ফেরত আনবেন। কিন্তু 'পাচারকারী' হিসেবে খাতায় নাম ওঠাননি কেউ।
পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে যে, বাজেটে সুযোগ দেওয়ার ফলে পাচারের অর্থ সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে আনা যায়। কিন্তু পাচারকারীরা এই সুযোগ না নিয়েও লাভবান হতে পারেন। যেমন কোনো পাচারকারী যদি মনে করেন, তিনি দেশে টাকা আনবেন, তাহলে রেমিট্যান্স হিসেবেও তা পাঠাতে পারেন। এতে কর তো দিতেই হবে না, বরং আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাবেন। বাজেট, অর্থনীতি, রিজার্ভ বড় পরিসরে না বুঝলেও বেশ বুঝতে পারছি এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট, ক্রমাগত ডলারের দাম বৃদ্ধি, আই এম এফের শর্ত পূরণের চাপ, নতুন করের বোঝা, ভ্যাটের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট ব্যাংক থেকে মেটানোর চেষ্টা সব ঘুরেফিরে সাধারণ জনগণের ঘাড়েই চাপবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
দেশের পরিবারগুলোতে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। চারটি মানুষের জন্য ডাল, ভাত, সবজি খেতে গিয়েও ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ। বাড়িভাড়া বেড়েছে, বেড়েছে বাস ভাড়া এবং রিকশাভাড়া। আর শিক্ষা ব্যয়তো আছেই। এমনকি যারা নিজেদের স্বচ্ছল বলে মনে করেন, তাদেরও ভাবতে হচ্ছে সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং চালের দাম বাড়া মানে বাজারে অন্য সব কিছুর দাম তরতরিয়ে বাড়া। এককথায় বলা যায় জীবনযাত্রার ব্যয় করোনাকালের চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। যারা সেইসময়ে কাজ হারিয়েছেন, তাদের সিংহভাগ এখনো যুৎসুই কাজ ফিরে পাননি। ফলে জীবনযুদ্ধের এই টানাপোড়েন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।
বাজার মূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের আয় বাড়েনি। আয়-ব্যয় জরিপটি সর্বশেষ ২০১৬ সালে করেছে বিবিএস। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে উচ্চ আয়ের পরিবারে আয় বেড়েছে। তাদের মাসিক গড় আয় ৯ হাজার ৪৭৭ টাকা বেড়ে ৪৫ হাজার ১৭২ টাকা দাঁড়িয়েছে। আর হতভাগ্য দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। আয়ের দিক দিয়ে সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকা ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪ হাজার ৬১০ টাকা, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৫৩৯ টাকা কম। অবশ্য এ জরিপে সবচেয়ে ধনীদের প্রকৃত হিসাব আসে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। সার্বিকভাবে বিবিএসের হিসাবে, আয় বৈষম্য অনেকটাই বেড়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি। এদের মধ্যে যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা ভবিষ্যতে আরো কঠিন বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন বলে আশঙ্কা করছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। করোনাকালে এবং এরপরে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি কী দাঁড়াল, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কোনো জরিপ নেই। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানিয়েছে, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে (৪২ শতাংশ)। যদিও সরকার তা মেনে নেয়নি, আর নিজেরাও কোনো জরিপ করেনি।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে আমরা বলতে চাই সরকার মানুষের দারিদ্রতার বাস্তবতাকে মেনে নিক এবং সেইভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। সরকারের কাজ শুধু যদি করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেতো বিপদ। আয়কর দিতে গিয়ে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের যেখানে কঠিন অবস্থা, সেখানে দরিদ্র মানুষ কীভাবে এবং কেন ২,০০০ টাকা আয়কর দেবেন? বরং যারা আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন, সেইসব ধনী মানুষকে শক্ত করে ধরুন এবং দরিদ্রদের আয়কর দেওয়ার চাপ থেকে মুক্তি দিন।
- লেখক: যোগাযোগ কর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।