পানির সংকট: এক কঠিন বাস্তবতায় আমরা
আমরা যেদিন থেকে বোতলে পানি কিনে খেতে শুরু করেছি, সেদিন থেকেই আমাদের অজান্তে এবং না বুঝেই পানি সংকটের বাস্তবতার একটি ধাপে পা দিয়েছি। আমরা স্বীকার করে নিয়েছি পানির সংকট আছে।
আমরা মনে করেছি, বোতলের পানি "নিরাপদ"; টিউবওয়েল কিংবা পুকুরের পানি খেলে নির্ঘাত ডায়রিয়া হবে। ঢাকার কলের পানি ফুটিয়ে খাওয়া যায়, কিন্তু ঢাকার বাইরে গ্রামের পানি 'অ-নিরাপদ"।
এই ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দিয়েছে। ত্রিশটি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পানির ৫০০ মিলি লিটারের বোতলের দাম ১৫ বা ২০ টাকা। এরও আবার ব্র্যান্ড আছে , ব্র্যান্ড-ভেদে তৃষ্ণা মেটাবার চাহিদাও আছে। দেশে বছরে ৩৫-৪০ কোটি লিটার বোতলের পানি বিক্রি হয়, এবং ২০% হারে ব্যবসা বাড়ছে (TBS, 22 March, 2021) ।
কোন বিদেশী বাংলাদেশে আসলে তার প্রথম দরকার বোতলের পানি, জগের ব্যবহার উঠেই যাচ্ছে, গ্লাসের প্রয়োজনও আর থাকছে না। মিটিংয়ে গেলে ২৫০ মিলি লিটারের বোতল ধরিয়ে দেয়া হয়। বোতলের পানি প্রতীকীভাবে পানি সংকটকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে। একইসাথে পানির অপচয়মূলক ব্যবহারও হচ্ছে।
এই সংকটের সাথে জড়িয়ে আছে ব্যবসায়িক স্বার্থ; এই ব্যবসা প্রায় হাজার কোটি টাকার, যার কারণে বোতল ছাড়া অন্য পানি আর নিরাপদ হতে পারবে না। মনে রাখা দরকার, এই বোতলগুলো প্লাস্টিকের, প্লাস্টিক দুষণও আমাদের দেশে জাঁকিয়ে বসেছে।
এক সময় ছিল পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে গ্রামে গ্রামে টিউবওয়েল বিতরণ করা হয়েছিল। স্বচ্ছল পরিবারে নিজস্ব টিউবওয়েল থাকতো; তাদের অবস্থা যে ভালো, সেটাই ছিল তার প্রমাণ ।
গ্রামে মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে ছেলের বাড়িতে টিউবওয়েল দেখলে কনের বাবা-মায়ের আনন্দ হতো। গত শতাব্দীর সত্তুরের দশকে ইউনিসেফ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে টিউবওয়েল বসানোর প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ৬৭% মানুষ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করেছে।
কিন্তু, টিউবওয়েলের পানি মানে তো মাটির তলার পানি। ১৯৯৩ সালে জানা গেল মাটির তলায় প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক দুষণ ঘটে; এবং ক্রমে কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহার এবং অন্যান্য পরিবেশ দূষণের কারণে আর্সেনিকের পরিমাণ এত বেড়ে গেল যে ৯০% মানুষ আর্সেনিকের হুমকিতে পড়ে গেল। টিউবওয়েলে পানি পরীক্ষা করে লাল (আর্সেনিক থাকলে) এবং সবুজ (দূষিত না হলে) রঙ লাগানো হল। আর্সেনিক আতংকের ফলে টিউবওয়েল-ও বিপজ্জনক হয়ে গেল। রইল শুধু বোতলের পানি।
পানি প্রকৃতির দেয়া সম্পদ, রাসায়ন বিজ্ঞান অনুযায়ি H2O, দুইভাগ হাইড্রোজেন, এক ভাগ অক্সিজেন। কিন্তু এই ফর্মূলা ব্যবহার করে পানি উৎপাদন করা হয় না, প্রকৃতির দেয়া পানিকেই নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে পানি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজে লাগে, অর্থাৎ মিষ্টি পানি – তা বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১%; বাকী ৯৯ শতাংশের বেশির ভাগই লবণাক্ত সমুদ্রের পানি, কিংবা বরফ হয়ে জমে থাকা পানি। বাংলাদেশ তার ভৌগলিক অবস্থার কারণে নদী পরিবেস্টিত হয়ে হিমালয়ের বরফ গলা পানি পায় এবং আমাদের কৃষি ব্যবস্থা তার সাথেই গড়ে উঠেছে। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা, দৈনন্দিন জীবনযাপন রান্নাবান্না পয়ঃপরিস্কার সবকিছুই এর সাথে জড়িত। পানি সংকট আমাদের থাকার কথা নয়, কিন্তু আছে। সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি, আমরা দেখছি পানির সব ধরণের ব্যবহারেই পানির সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি হয়ে উঠছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেছে, তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, খরা দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে - এগুলো প্রাকৃতিক কারণ। কিন্তু এই প্রাকৃতিক কারণের মধ্যেও মানুষের কর্মকাণ্ডের অবদান রয়েছে। মানুষসৃষ্ট কারণের তালিকা করলে, দেখা যায় তার শেষ নেই। বাংলাদেশের মানুষ পানি নিয়েই বিশ্বে প্রাকৃতিক দিক থেকে সম্পদশালী হতে পারতো। নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের জন্যেও পানি সরবরাহ করা যেত। পানি হতে পারতো একটি গুরুত্বপুর্ণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য। কিন্তু আমাদের দেশের পানির উৎসগুলোকে নষ্ট এবং ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। পানিকে সম্পদ হিসেবে আমরা দেখিনি কখনো। খুব সস্তা কিছু বোঝাতে হলে "পানির দরে বিক্রি হয়েছে" বলা হয়। অর্থাৎ পানির নামমাত্র মূল্য আছে। অথচ বোতলে ঢোকার পর ৫০০ মিলি-লিটারের দাম হয়ে গেছে ২০ টাকা। পানির দর কি হলো?
বিশেষজ্ঞরা পানি সংকটের বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। স্থলজ জলাভূমি ও জলাশয়গুলোর আয়তন, পরিধি ও ধারণক্ষমতা সংকোচন, পানি সংকটের ইঙ্গিত দেয়। দেশের নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, প্লাবনভূমি, বাঁওড়, দীঘি ও পুকুরগুলোয় আগের মতো পানিও থাকে না। অন্যদিকে এগুলো থেকে পানি উত্তোলন করে ফসল সেচ, মাছ চাষ ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আবাদি জমির মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সেচ চাহিদাও বেড়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলাভূমির পানি শেষ হয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ দুষ্কর হয়ে পড়ে।
ব্যাপকমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে সেচের আওতাধীন বহু এলাকায় পানির স্তর হস্তচালিত নলকূপের কার্যকর নাগালের নিচে নেমে গেছে বলে জাতীয় পানি নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। শহর ও নগর এলাকায় পানির চাহিদা মেটাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রা পানি সংকটকে আরো প্রকট করে তুলছে [বণিক বার্তা, মার্চ ১১, ২০২৩]।
পানি ব্যবহারের নানান দিক আছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ২০০০ থেকে ২৫০০ কিলোক্যালোরির হিসাব আছে; সেভাবে দৈনিক ২.৫০ থেকে ৩ লিটার পানি খাওয়াও জরুরি। এ ছাড়া রান্না, গোসল, ঘর পরিস্কার করা এবং গ্রামে কৃষিকাজ, গবাদিপশু পালন ইত্যাদির হিসাব তো আছেই। কিন্তু, বাংলাদেশে এত মিঠা পানি কি আছে ? উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পানিসম্পদ যা আছে তার মাত্র ১% মানুষের ব্যবহারের জন্য তোলা হয়; এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাগে কৃষির জন্যে (৮৬%), গৃহকর্মের জন্যে ১২% এবং শিল্পের জন্য ২%।
কৃষিতে পানির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, এবিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। আন্তর্জাতিকভাবেও এই তথ্য পাওয়া যায়। আধুনিক কৃষির আগে, মাটির ওপরের পানি দিয়েই সেচ কাজ হতো, কিন্তু গভীর নলকূপ বসিয়ে মাটির তলার পানি তুলে শুষ্ক মৌসুমে ধান আবাদ করার কারণে মাটির তলার পানি ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের পানি পেতে হলে- নলকূপের মালিককে টাকা দিতে হয়। বিঘাপ্রতি এবং ঘন্টাপ্রতি দাম নির্ধারিত থাকলেও কৃষককে ১ বিঘা জমিতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা গুনতে হয়। পানির ওপর ব্যাক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় পানি তোলার যন্ত্রের মাধ্যমে। এর জন্য অনেক বিবাদ, ক্ষমতার ব্যবহার, ও নির্যাতন সইতে হয়- গরিব কৃষককে। সেচের পানির দাম দিতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও নতুন নয়। কাজেই কৃষিতে পানির ব্যবহার বেশি এই কথা বলার সময় বলতে হবে- আধুনিক কৃষির কথা। একমাত্র তথাকথিত আধুনিক কৃষিতেই সেচের ব্যাপার ঘটে এবং সেখানেই শুনতে হয়, কৃষকের আত্মহত্যার কথা। ইকোলজিকাল বা পরিবেশসম্মত কৃষিতে মাটির তলার পানির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়। পানি নিয়ে নির্যাতন এই কৃষি ব্যবস্থায় নেই।
ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য, কাজেই কৃষিতে ধান প্রধান ফসল হিসেবে তা উৎপাদিত হচ্ছে। সব ফসলের হিসাবে ধান প্রায় ৬০% অংশ জুড়ে আছে। আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদন হয়, সেচ নির্ভর ধান হয় শুষ্ক মৌসুমে, যেখানে অধিক পরিমাণে সেচের প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা ডিভিশন এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃষ্টিপাত অপর্যাপ্ত হলে আমাদের দেশে এক কেজি ধান উৎপাদনে গড়পড়তা ১ হাজার ৪০০ লিটার পানি সেচের প্রয়োজন হয়। তবে এলাকাভেদে সেচপানির এ চাহিদা এক হাজার লিটারের কাছাকাছি থেকে আড়াই হাজার লিটার ছাড়িয়ে যায়। দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রতিকেজি ধান উৎপাদনে গড়পড়তা ১ হাজার ৬০০ লিটারের ওপর পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
এক কেজি বোরো ধানে সেচের পানির পরিমাণ গড়ে ১,৬০০ লিটার, কোথাও ২,৫০০ লিটারও লাগে। মোট সেচের আওতাভুক্ত আবাদি জমি হচ্ছে ৫.৫৮ মিলিয়ন হেক্টর, তার মধ্যে ৫৭% শ্যালো টিউবওয়েল , ১৯% ডিপ টিউবওয়েল এবং ২৪% লো-লিফট পাম্প দিয়ে সেচ করা হয়। সেচের আবাদি জমির ৮০% ধান উৎপাদনের জন্য লাগে, তার মধ্যে বোরো ধানই প্রধান ব্যবহারকারী। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ৯৭% সেচ করা হয় ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে। (Businesspostbd.com, 15 january, 2022
জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পানি সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু শুধু অনাবৃষ্টিকেই দোষারোপ করলেই সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে না এবং এর সমাধানও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কৃষি এবং অন্যান্য কাজে অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি তোলার কারণে পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। খুলনা বিভাগে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে, গত বছর পানির স্তর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গিয়েছিল বলে জানা যায়। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি অতি-উত্তোলনকারী দেশের মধ্যে– বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অন্যান্য দেশগুলো হচ্ছে চীন, ভারত , ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্তান এবং তুরস্ক। এসব তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২২।
এভাবে চলতে থাকলে নিঃসন্দেহে দেশের মানুষের মধ্যে পানি সংকটের হাহাকার পরবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের বরাতে বিবিসি [১১ মার্চ, ২০২৩] জানাচ্ছে খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের একজন থেকে প্রতি ৫ জনের একজন পানি সংকটে ভুগছে। এই উপকূলীয় এলাকার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে পরিবারের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এই কাজটি করছে নারীরাই। তাদের কেউ কেউ বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানিও পান করছে। এতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে উপকূলের মানুষ বিশেষ করে নারীরা।
চরম সংকটের এই লগ্নে– এক্ষুণি ব্যবস্থা না নিলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।