তরবারি হোক প্রতীকী হাতিয়ার, আস্থা বাড়ুক বিচার ব্যবস্থায়
পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রধান বিচারপতির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে একটি তরবারি উপহার দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ হাস্য-কৌতুক চলছে। তবে এই ধরনের উপহারের উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে অবশ্যই ভাবার আছে। পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রধান বিচারপতিকে তরবারি উপহার দিলে সাধারণ মানুষ তার অর্থ খুঁজবে- এটাই স্বাভাবিক। তরবারি যুদ্ধের প্রতীক। অতীতকালের সম্রাটরা নানা ধরনের তরবারি তৈরি করতেন, এমনকি স্বর্ণ দ্বারা হীরা লাগানো তরবারির সন্ধানও পাওয়া যায়। তরবারিকে ন্যায়দণ্ডের প্রতীক হিসেবেও দেখানো হয়েছে। অনেক শাসক তার জনগণের জন্য অনেক কল্যাণ করেছেন এই তরবারির শক্তিতেই। মধ্যযুগে বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন এই তরবারির শক্তিতেই। এই আধুনিককালেও মধ্যপ্রাচ্যে বিচারের রায় কার্যকর করতে তরবারির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত কেউ কেউ সামগ্রিক দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। দেশে যে দুর্নীতি আছে তার প্রমাণ আছে বলেছেন। একটি রাষ্ট্রের তিনটি কাঠামোর প্রত্যেকটি অঙ্গেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বক্তব্যে বিষয়টি বলেছেন। এই তরবারিই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের প্রতীকী হাতিয়ার।
সমাজে দুর্নীতির জন্ম হয় নৈতিক দায়বদ্ধতা না থাকলে। যে কোনো সমাজে দুর্নীতির প্রসার লাভ করে যখন সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষরা, যারা দেশের শাসনভাগে নিয়োজিত থাকেন তারা যখন নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেন। নিজ দলের সমর্থক, আত্মীয়-স্বজনকে নানাভাবে প্রতিষ্ঠা করেন; সেখান থেকেই দুর্নীতি প্রসারলাভ করতে শুরু করে। সেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটে সর্বস্তরে। দেশে এমন কোন পেশা বা সংস্থা নেই যেখানে দুর্নীতি অনুপস্থিত। এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের উন্নয়ন জনগণের বোঝা হিসেবেই চেপে বসে যার উদাহরণ পৃথিবীর নানা দেশে রয়েছে।
দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরও দায়িত্ব বর্তায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন পাওয়া মানুষের অধিকার। সেই নির্বাচন যারা বিতর্কিত করবে তাদের সকলের বিরুদ্ধে সংবিধান অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দায়িত্ব রয়েছে আমাদের উচ্চ আদালতের । দেশের এই চরম বিভক্তের সময় দুই-একজন সাবেক বিচারপতিকে দেখছি বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করতে। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখছেন। এমনকি প্রকাশ্যেই সরকারকে উপদেশ দিচ্ছেন। আমাদের সংবিধান দ্বৈত নাগরিকদের দেশের সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য করেছে, তেমনিভাবে অন্যান্য সাংবিধানিক পদগুলোতেও এই দ্বৈত নাগরিকরা অযোগ্য বিবেচিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের কেউ কেউ দ্বৈত নাগরিক হওয়া সত্বেও পূর্ণমেয়াদে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যত বড় কথাই বলা হোক না কেন, আমাদের সক্ষমতা আমাদের নিজেদেরকে বিবেচনা করতে হবে। বেশ কিছু দেশে ইতিমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। সম্প্রতি যে দেশগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে, নাইজেরিয়া তাদের মধ্যে একটি। এই দেশটি ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থেকেও একটি সফল নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা জানি, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পৃথিবীর অনেক দেশে যথাযথভাবে কার্যকর করতেও ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণ, ইরান ও নাইজেরিয়া। এই দুটি দেশ পেরেছে তাদের মাটির নিচের সম্পদ তেলের কারণেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখনো টিকে আছে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞার সুবিধা ভোগ করছে চীন। সস্তায় তেল কিনছে এই দুই দেশ থেকে।
আমরা ইরান বা নাইজেরিয়া নই। মার্কিনকে টেক্কা দেওয়ার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের নেই। সেকারণে ভাবতে হবে, আমরা কোন ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগুচ্ছি কিনা। বিচার বিভাগ সকল কিছুর সমাধান, এই বিশ্বাস আমাদের সংবিধান আমাদেরকে দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা বিচার বিভাগের সেই স্বাধীন ভূমিকার প্রতি তাকিয়ে আছি। প্রচলিত অর্থে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু বাধা রয়েছে অনেক। আমরা বিচার বিভাগীয় নের্তৃত্বে আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চাই, তারাই পারবেন সকল বাধা দূর করে একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাই হলো- জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।